ওমানের চিঠি: বাঙালি চিকিৎসক ও আরব রোগী

নামাজ শেষে রুমে ফিরে এলাম। তিন বেডরুমের পরিপাটি ফ্ল্যাটের এক রুমে থাকে রাসেল, ফিলিপিনো ল্যাব টেকনিশিয়ান আর দুই রুমে আপাতত আমি ছাড়া আর কোন ডাক্তার নেই।

মো. রায়হান হোসেন, ওমানের মাসকট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2017, 10:57 AM
Updated : 9 Oct 2017, 11:07 AM

রাসেল জানালো, তিনদিনের মধ্যে আরও তিনজন বংলাদেশি ডাক্তর আসছেন। এমনিতে একটু একাকি মনে হচ্ছিলো, তিনজনের আসার কথা শুনে মনটাই ভালো হয়ে গেলো। সত্যিকার অর্থে দেশি মানুষ আর মায়ের ভাষায় কথা বলার মধ্যে কি যে আনন্দ এটা মাতৃভূমি না ছেড়ে আসলে কখনো বুঝা যায় না । কখনো কখনো মনে হয় ভালোবাসাটাকে উপলব্ধি করার জন্য দূরত্বটাও প্রয়োজন।

দুপুরের খাবার অনেক দেরি করে খাওয়ায় রাতের খাবারের প্রতি তেমন একটা আগ্রহ নেই। রুমে দেখলাম প্রচুর পরিমানে শুকনা খাবার রাখা আছে, আমি অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম।

নতুন ভোরের আলোয় ঘুম ভেঙে আড়মোড়া দিয়ে মোবাইল ঘড়িতে চোখ পড়তেই দেখি সাতটা বাজতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। তৈরি হবার আগেই অফিসের নাম্বার থেকে ফোনে জানানো হলো নিচে রবি গাড়ি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, জলদি নামতে হবে।

নিচে এসে দেখি রবি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বসে আছে, হাই-হ্যালো বলার সময় মিললো না। গাড়িতে উঠামাত্র সে উড়োজাহাজের গতিতে ছুটে চললো অফিসের পথে।

থাকার যায়গা থেকে অফিসে যেতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। এই দশ মিনিটে রবির সঙ্গে অনেক কথা হলো। প্রায় বছর তিনেক সে মাসকটে আছে, বাংলাদেশে দুটো বাচ্চা আর পরিবারের মায়া ত্যাগ করে শুধু একটু স্বচ্ছলতার আশায় মাসের পর মাস একাকি প্রবাস জীবনে অক্লান্ত পরিশ্রমে দিন কাটে তার। সারা মাস কষ্ট করে কাটানোর শেষবেলাতে ওমানি রিয়ালগুলোকে ২১০ দিয়ে গুণ করে দেশে পাঠালে বউ-বাচ্চার মুখে যে হাসি ফোটে সেই অমূল্য হাসি রবির একাকি প্রবাস জীবনের কষ্টকে একেবারে ধুয়েমুছে দেয়।

বাচ্চা দুটোকে দেখার সাধ হয় তার প্রতিদিন, ইচ্ছে হয় বাবা ডাক শুনতে। সারাদিন ধকলের পর বাচ্চাগুলোকে বুকে জড়িয়ে আদর করতে পারলে কতই না ভালো লাগতো সেটা ভেবে তার চোখের কোণ ভিজে ওঠে, এমন লাখ রবীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের কারণেই সচল আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতি।

কথা বলতে বলতে হেড অফিসে চলে এলাম। অফিসের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই ভারতীয়, কিছু ওমানি, কিছু ফিলিপিনো আর গুটিকয়েক বাংলাদেশি আছেন। প্রথম পরিচয় হলো এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সাঈদ সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী এলেনের সঙ্গে। এলেন ফিলিপিনো মেয়ে, ধবধবে সাদা চামড়ার অধিকারি, চৌকস, মেধাবী আর বিনয়ীও বটে। সে আমাকে অফিসের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো আর বললো চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে এক্ষুনি।

চেয়ারম্যানের রুমটা খুব সুন্দর করে গোছানো, সৌখিনতার ছোঁয়া তার রুমের প্রতিটি কোণে। ভদ্রলোক ওমানি পোশাক কান্দুরা আর মাসার পরে আছেন, আরবিয় আভিজাত্য তার চেহারায়। আমি অনুমতি নিয়ে রুমে ঢুকতেই তিনি হাস্যোজ্জ্বল হয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন। সাঈদ সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো শাহবাগে বোয়েসেলের অফিসে, তখন তিনি তার প্রতিষ্ঠানের জন্য ডাক্তার নিয়োগের প্রাথমিক সাক্ষাৎকার নিতে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি আমাদের এগারোজনকে বাছাই করেছিলেন।

আমি অবাক হয়ে গেলাম উনার স্মরণশক্তি দেখে, ভদ্রলোক আমাকে চিনতে পেরেছেন। ওমানে চিকিৎসা চর্চা করার সনদ পরীক্ষা ‘প্রোমেট্রিক’-এ ৬০% এর বেশি নাম্বার পাওয়াতে আমাকে অভিবাদন জানালেন আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। সাথে ছোট্ট করে একটা উপদেশ দিলেন যেন সবসময় মুখে হাসি নিয়ে রোগী দেখি, রোগীর জন্য ডাক্তারের মুখের আলতো হাসি নাকি রোগ সারানোর প্রথম মহৌষধ।

আমি সেই দিনের পর থেকে সবসময় সেটা মেনে চলার চেষ্টা করেছি ও খেয়াল করেছি সত্যিই সেটা সব থেকে সুন্দর উপদেশ ছিলো। উনার সাবলীল ইংরেজি বলার জন্য মনে মনে ধন্যবাদ দিয়েছি কারণ আরবি বললে সবই আমার মাথার উপর দিয়ে যেতো।

চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা শেষ করে টি-রুমে পরিচয় হলো আমিরার সঙ্গে। ওমানি মেয়েদের চেহারার যে জৌলুশ তার পুরোটাই আছে তার মাঝে, সাথে যোগ হয়েছে তার বাদামি চুল আর বাদামি রঙের চোখ। আমার ধারণা ছিল নিশ্চয়ই এ আরবিয় সুন্দরীরা খুব অহংকারী হয়। আমিরা এ অফিসের মানবসম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।

আমার গতানুগতিক ধারণা ভেঙে দিয়ে নিজে থেকেই আমিরা পরিচয় দিলো, সাবলীল ইংরেজিতে। তাকে বন্ধুবৎসল প্রকৃতির মনে হলো, তাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। এমন চোখধাঁধানো সুন্দরের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।

আমাকে আরবি শেখাতে আমিরাকে অনুরোধ করলাম। সেও অনেক আন্তরিক, আমাকে শেখালো ‘কেমন আছো’ এর আরবি হচ্ছে ‘কেইফ হালক’ বা ‘কেইফাল হাল’, যার উত্তরে বলতে হয় ‘আলহামদুলিল্লাহ জেইন’ মানে ‘ভালো আছি’।

বেশি সময় হাতে নেই, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে মৌখিক পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে।

চা পান শেষে এবার মন্ত্রণালয়ে যাবার পালা। এই অফিসের গণসংযোগ কর্মকর্তা মাসুদ আমাকে  মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাবে। মাসুদ ওমানি হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের সব যায়গায় তার যোগাযোগ চেনা-জানা খুব ভালো।

বিপত্তি অন্য যায়গায়। আমি ইংরেজিতে তাকে ‘কেমন আছো’ জিজ্ঞেস করার পর তার কাছ থেকে কোন উত্তর ইংরেজিতে আসলো না, বরং আরবিতে কিছু একটা বললো আর তাতে আমি কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হলাম। বুঝলাম আগামী কয়েক ঘণ্টা সে যা বলবে তাতেই আমার চোখ বড় বড় হবে আর হু হা করতে হবে। জানি না, কী না কী আমার জন্য অপেক্ষা করছে আজ!

মাসুদ নিজেই ড্রাইভ করে, তার গাড়ি চালানো দেখে আমার মনে হচ্ছে সে আগে স্পেসশিপ চালাতো। রাস্তার কোন সিগনাল মানার কোন ইচ্ছে তার আছে বলে মনে হচ্ছে না । স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে যাবার রাস্তার একদিকে পাহাড় আর একদিকে সমতল ভূমি, রাস্তাটা বেশ সুন্দর । সাই সাই করে ছুটে চলা গাড়ির গতি একটু নিয়ন্ত্রণের জন্য মাসুদকে বললাম, সে কিছু বুঝলো না। উল্টো আমাকে কী বললো আমিও বুঝতে পারছিনা। আমি ভাবছি ওমানি রোগী যারা আরবি ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানে না তাদের কথাবার্তা তো কিছুই বুঝবো না আমি! কীভাবে রোগ নির্ণয় করবো আর কীই-বা চিকিৎসা দেবো!

আশপাশে বেশ কিছু সুন্দর বিল্ডিং চোখে পড়লো। মাসুদের অদম্য গতিতে ছুটে চলা আর আরবি ভাষার অর্থ না বোঝার কারণে ভেতরে ভয়টা আরো ঘনীভূত হচ্ছে, আমি সুন্দর একটা ভ্রমণকে উপভোগ করতে পারছি না।

মিনিট বিশেকের মধ্যে আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে পৌঁছে গেলাম, মূল গেটটা স্বয়ংক্রিয়, ভেতরের কারুকাজ নয়নাভিরাম । মাসুদের পিছুপিছু হাঁটছি আমি, আর ডানে বামে লক্ষ্য করছি। উপভোগ করছি আরবিয় আভিজাত্য। দোতলায় উঠার লোহার সিঁড়িতে বিশেষ কারুকাজ, যে প্রকৌশলী নকশা করেছেন তিনি অত্যন্ত উঁচু মানের এতে কোন সন্দেহ নেই।

নিচতলার নোটিশ বোর্ডে ওমানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নানা বৈজ্ঞানিক আলোচনা সভার বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে, সাথে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কিছু আন্তর্জাতিক খবর আছে ইংরেজি ও আরবি দুই ভাষাতেই।পড়তে অসুবিধা হয় না। এতো সুন্দর আর পরিপাটী সবকিছু দেখলেই মন ভরে যায়।

ঢুকতেই ওমানের রাজা সুলতান কাবুসের বিশাল প্রতিকৃতি চোখে পড়ে। এই সুলতান কাবুস ৪৭ বছর ধরে ওমানকে শাসন করে আসছেন, তিলে তিলে ওমানকে গড়ে তুলেছেন সযত্নে শিল্পীর মতো আপন হাতে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর তুলনায় ওমানকে বিশ্বের দরবারে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে সুপরিচিত করিয়েছেন, নানা ধর্ম বর্ণের জাতিতে ভেদাভেদ ভুলিয়ে একসঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে নিয়ে এসেছেন। আইন-কানুন সঠিকভাবে মানতে শিখিয়েছেন, সত্যিকারের নেতা বলতে যা বোঝায় তার সবকিছুর এক সংমিশ্রণের নাম সুলতান কাবুস। আর এজন্য ওমানিরাও তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই চোখে পড়লো চিকিৎসক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আল সামরীর অফিস রুম, তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসকদের মৌখিক পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক। ভদ্রলোক আমার সব মূল সনদপত্রগুলো ভালো করে মিলিয়ে দেখে পরীক্ষার জন্য সাত দিনের সময় বেঁধে দিলেন। আমি জানি এ পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হলে দেশে ফিরে যেতে হবে, অতএব পরীক্ষায় পাশের কোন বিকল্প নেই।

আব্দুল্লাহ আমাকে একটা ওয়েব অ্যাড্রেস দিলেন, সেটা ফেইসবুকের একটা অফিশিয়াল পেইজ যেখানে এ মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়। আমি গত কিছু পরীক্ষার ফলাফল দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম, পাশের হার মাত্র ৪০% এর মতো! ভয়টা এবার ভালোমতোই চেপে বসলো।

মনে মনে ভাবছি একটা কড়া কফি খাওয়া দরকার। অদ্ভূত ব্যাপার ঠিক এমন সময় আব্দুল্লাহ আমাকে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দিলেন, আরবিয় কফি। ভদ্রলোক আমার মনে জমা হওয়া কফি খাবার ইচ্ছের খোঁজ কী করে পেলেন জানি না। আমি মন থেকে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে আরবিয় ঐতিহ্যবাহী ছোট কাপে আরবিয় কফিতে চুমুক দেই আর একটু একটু করে দূর হয় আমার দুশ্চিন্তা । আরবিয় কফির স্বাদ আলাদা, প্রতিটি চুমুক সতেজ করে তোলে মনপ্রাণ।

কফি শেষ করে আমি আব্দুল্লাহর কাছ থেকে বিদায় নেই। মাসুদ আরবিতে কিছু একটা বললো, বুঝিনি সেটা কী বলেছে সে। দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে সেটা মাসুদকে বুঝাতেও পারছি না।

মাসুদ গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে, কোথায় নিয়ে যাবে জানি না, আরবিতে কী বললো সেই জানে।কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করার উত্তরটা না বুঝায় এবার আমার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করলো।

মাসুদ পাঁচ মিনিট গাড়ি চালিয়ে হঠাৎ একটা রেস্তোরাঁর সামনে এসে থামলো। সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম এখানে আরবিয় বিশেষ খাবার পাওয়া যায়।এখন মন ভালো হয়েছে, মাসুদের উপর থেকে জমে থাকা রাগটা কমতে শুরু করেছে।

লেখক: চিকিৎসক, রিনাইসেন্স পিএসি হাসপাতাল, ওমান

ই-মেইল: dr.mrhossain87@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!