পেটের পেছনটা কিছুটা জলপাই রঙে মোড়া আর মাঝখানটা সাদাটে। মায়াবী চোখে ভাবলেশহীন চাহনি তার। ক্ষুধার্তের চোখে সেই মায়া কাজ করে না, প্রস্তুতি শুরু হলো তাকে ফ্রাই করার। রেজাউল ভাই কিং ফিশ নিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ালেন। আমি আমার পাকস্থলিকে নয়-পাঁচ বুঝিয়ে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললাম।
সাথে ময়দা, ইস্ট, হালকা চিনি, চিজ, আর ভিলেজ বাটার মিশিয়ে ২৩০ ডিগ্রি তাপে বিশেষ যত্নে তৈরি হওয়া প্রায় এক মিটার লম্বা ‘লাভাস’ নামের টার্কিশ স্পেশাল ব্রেড যার উপর হালকা করে ছিটানো সিসাম সিডস । টেবিলজুড়ে ক্ষুধা মেটানোর ব্যাপক আয়োজনে যোগ হল টমেটো, শসা, পার্সলে, সবুজ বেল মরিচে জলপাইয়ের তেলে তৈরি টার্কিশ সালাদ, সাথে ফ্রেশ লেমন মিন্ট জুস। এমন সুস্বাধু খাবার দেখে যে কারো জিভে জল আসলে দোষের কিছু নেই।
আজ বুঝলাম পুরো ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে টার্কিশ খাবারের এত কদর কেন। শ্বাস-প্রশ্বাস আর কথা বলার জায়গাটুকু বাদ রেখে পাকস্থলীর পুরো ফাঁকা জায়গা ৬.৫ রিয়ালের বিনিময়ে আজ কিং ফিশের জন্য বরাদ্ধ দেয়া হল। মুখের প্রতিটি কোষে কিং ফিশের সেই স্বাদ ছড়িয়ে গেলো। জিভে এলো জল।
রেস্তোরাঁর কাউন্টার ছেড়ে যাবার আগে লোকজনকে ‘শুকরান’ বলতে শোনলাম। রেজাউল ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম ‘শুকরান’ মানে ধন্যবাদ। আমার শেখা একমাত্র আরবি শব্দ রেজাউল ভাইয়ের সঙ্গেই ব্যবহার করার উত্তরে যখন বললেন ‘আফওয়ান’ বুঝে নিলাম এর মানে ‘স্বাগতম’।
রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম কোণে, সারাদিন আলো বিকিয়ে শেষ বিকেলে এসে তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, বড্ড নির্মলতা সেই ছাপে। এখানকার আকাশে দূষণ কম থাকায় আকাশকে আরো স্বচ্ছ লাগে, হালকা লালচে রঙের আকাশের দিকে দৃষ্টি হারিয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের পড়ন্ত সেই বিকেল।
মাগরিবের আজান হচ্ছে, সুমধুর সেই আজানের ধ্বনিকে উপেক্ষা করার সাধ্য খুব বেশি লোকের নেই। দলে দলে লোক মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আমিও সেই দলে যোগ দিলাম। সুন্দর পরিপাটি মসজিদের ওজুখানায় ওজু সেরে ড্রিংকিং পয়েন্টে পানি পান করে মসজিদের দরজায় পা রাখার সাথে সাথে সুগন্ধী কিছু একটা টের পেলাম। এটা ওমানি বিশেষ সুগন্ধী, এদেশের ঐতিহ্যের বিশেষ অংশ।
চারকোণা ছোটপাত্র থেকে ধূপের মতো ‘অ্যারাবিয়ান ওঊদ’ বা আরবিয় সুগন্ধী ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, মনে হয় অন্তরকে পূণ্যতায় ভরিয়ে তোলছে। অসম্ভব সুন্দর সব ঝাড়বাতিতে চোখ আটকে যায়। মসজিদের মেঝে বিশেষ কার্পেটে মোড়া। দেয়ালের সাথে লেগে থাকা সেলফে অসংখ্য কোরআন শরীফ। ধ্যানমগ্ন হয়ে অনেকেই কোরআন পড়তে ব্যস্ত, পবিত্র সেই দৃশ্য।
কিছুক্ষণের মধ্যে ইমাম সাহেবের একামতের সাথে নামাজ শুরু হলো। আমি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত বেঁধে নামাজে মনোযোগ দিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার আশপাশের বাকিরা কেউ আমার মতো করে হাত বাঁধেনি। প্রথমে কিছুটা হতচকিত হলেও পরে বুঝলাম তারা হাত ছেড়েই নামাজ পড়েন।
ইমাম সাহেবের সুমধুর তেলাওয়াত মনে এক শুদ্ধ অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। মনে হতে থাকে আমি এক অসম্ভব সুন্দর শব্দের ভেতরে আছি। সেই শব্দের অর্থ হয়তো বুঝতে পারছি না, তবে উপলব্ধি করতে পারছি তার গভীরতা।
সালাম ফিরিয়ে লক্ষ্য করলাম এরা পাশের জনের সঙ্গে বিনীতভাবে হাত মেলাচ্ছেন। আমিও তাদের অনুকরণ করলাম, নামাজের পর পারস্পরিক এই হাত মেলানো নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ও আন্তরিকতা আরও বাড়িয়ে তোলে এটা নিশ্চত।
মসজিদের বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমি হেঁটে চলেছি আমার থাকার জায়গার দিকে, পেছনে পড়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের নিচে জমে উঠেছে আলো আঁধারের খেলা।
এখানকার সব অফিস শুরু হয় সকাল সাতটায়। কাল সকালে কী কী করতে হবে তার একটা ধারনা নেয়ার জন্য মোবাইলে যোগাযোগ করলাম ওমানে কর্মরত বাংলাদেশি ডাক্তার হারুন অর রশিদের সঙ্গে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তিনি, তার সঙ্গে পরিচিত হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।
এশার নামাজের আজান হচ্ছে। রাত বাড়ছে। হাজার বছরের আরবিয় রাত। দিনের সেই তিব্র তাপমাত্রা ক্রমশ সহনীয় হয়ে আসছে। মৃদু হিমেল হাওয়ায় আমি হেঁটে চলেছি ওমানি মসজিদের দিকে।
লেখক: মেডিকেল অফিসার, রিনাইসেন্স পিএসি ক্লিনিক, ওমান
ই-মেইল: dr.mrhossain87@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |