একদিন পরই বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেছেন, এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
Published : 21 Mar 2024, 10:24 PM
জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ যে প্রচার চলছে তাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সমর্থন এবং দলের পক্ষ থেকে সংহতি জানানো নিয়ে দলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে, চলছে নানা গুঞ্জন।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিশ্চিত করেছেন, এ বিষয়টি নিয়ে দলে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, স্থায়ী কমিটিতে আলোচনাও হয়নি। রিজভী এই কাজ করবেন, সেটাও জানা ছিল না তাদের।
রিজভী এক দিনের মধ্যে নিজের অবস্থান পাল্টে অবশ্য এটি তার ব্যক্তিগত অবস্থান বলেছেন, যদিও আগের দিন গায়ের ভারতীয় শাল পোড়ানোর পর দলের পক্ষ থেকেই সংহতি জানানোর কথা বলেছেন।
বিএনপির রাজনীতির শুরু থেকেই দলটির নেতারা ভারতের সমালোচনা করে আসছিলেন। এমনকি ৯০ দশকের শেষ ভাগে আওয়ামী লীগ আমলে ঢাকা-কলকাতা বাস রুট চালুর প্রতিবাদে ৭২ ঘণ্টার হরতালও ডাকা হয়েছিল। পরে তা বাড়ানো হয় আরো ২৪ ঘণ্টা।
তবে গত কয়েক বছরে দলটির নেতারা ভারতের বিষয়ে বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে ‘ভারসাম্য’ ও ‘সাবধানতা’ অবলম্বন করছিলেন। এর মধ্যে রিজভীর এই ঘটনাটি ঘটল।
বুধবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে দলের সমর্থন জানিয়ে তার গায়ে থাকা কাশ্মীরি শাল পুড়িয়ে দেন।
তিনি বলেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ঢেউ দৃশ্যমান তাতে মনে হয় দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। সুতরাং জনগণের দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ ৬৩টি গণতন্ত্রকামী দল এবং দেশপ্রেমিক জনগণ ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করছে।”
তার এই ভূমিকা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির চারজন সদস্যের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তারা সবাই বলেছেন, দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে এই বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি যে, বিএনপির তরফ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিতে হবে।
একজন বলেন, “ভারত গত কয়েকটি নির্বাচনে প্রকাশ্যে ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের পক্ষে অবস্থা নিয়েছে। আমরা দলের পক্ষ থেকে তা স্পষ্টভাবে বলে যাচ্ছি, এখনো বলছি। কিন্তু ভারতীয় পণ্য বর্জনের মতো ঘোষণা আসবে, এমন সিদ্ধান্ত হয়নি।”
দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের আরেক সদস্য বলেন, “রিজভীর চাদর পোড়ানোর দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে দলের নীতিনির্ধারকদের নজরে পড়ে।কিন্তু দলের পক্ষ থেকে কোনো দেশের পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়নি।”
দলের একজন সাবেক সাংসদ বলেন, ‘‘ভারতীয় পণ্যের সাধারণ মানুষরা বর্জন করবে। এটাতে রাজনৈতিক দলের যুক্ত হওয়াটা সঠিক কাজ হয়নি।”
গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপির তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বলে আসছেন। এ নিয়ে প্রতিদিনই শত শত পোস্ট আসে ফেইসবুকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের পোস্টেও হাজার হাজার কমেন্ট পড়ে প্রতিদিন।
বিএনপির তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরাও প্রকাশ্যেই তাদের অবস্থান জানাচ্ছেন। ঢাকা মহানগরের মহিলা দলের কর্মী আফরোজা খান শিউলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ভারতীয় পণ্য বর্জন নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশের যেসব পণ্য তৈরি হয় তার চেয়ে ভারতীয় পণ্য যে খুব যে ভালো তা বলব না। পারফিউম, কসমেটিক্স, টয়লেটিক কিছু পণ্য আছে সেগুলো আমরা ব্যবহার করি এই যা।”
আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারত প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের মানুষ তা মেনে নিচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, “ভারতের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে মানুষ কথা বলছে, এটাই বাস্তবতা। বিএনপি জনগণের দল হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়, তাহলে এটা ভুল হবে।”
অবশ্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির প্রকাশ্যে এমন অবস্থান সঠিক হয়নি, এমন মতও আছে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আল আমীন মোহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ভারত বিরোধী বিএনপির অবস্থান ইতিবাচক। বিএনপি জনমত সৃষ্টি করছে এটাকে আমি সঠিক বলে মনে করি।কিন্তু সে দেশের পণ্য বর্জন নিয়ে বিভিন্ন ছোট-খাট দল প্রচার চালাচ্ছে। বিএনপির মত বড় রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে সমর্থন জানানো, প্রকাশ্যে ভারতীয় পণ্য ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে করি না। এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি কেন যুক্ত হবে?”
বাংলাদেশের মোট আমদানির ২০ শতাংশ ভারত থেকে আসে। তবে এর বেশিরভাগই তুলা, শিল্পের কাঁচামাল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য। তবে পণ্য বর্জনের যে ডাক, তা মূলত জামা কাপড়, গৃহস্থালি প্রসাধন ও মুখরোচক খাদ্য পণ্যকে ঘিরেই।
বাংলাদেশে ভারতীয় এই ধরনের পণ্যের ব্যবহার তালিকা খুব বড় নয় বলে মনে করেন মালিবাগের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক কামরুল ইসলাম। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘ইন্ডিয়ান পণ্যের ব্যবহার বাংলাদেশে মানুষের কাছে এত জনপ্রিয় নয়। টুথ পেস্ট, মাউথওয়াশ, অলিভ ওয়েল, সানফ্লাওয়ার ওয়েল, কাপড় কাঁচার পাউডার, বিভিন্ন ধরনের গায়ের সাবান, চকলেট আর চিপসের একটা বাজার তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা কেনেন এগুলো।
“কিন্তু সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়াসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব ঘরে ব্যবহারের পণ্য আসে তার সঙ্গে ভারতীয় পণ্যের ব্যবহারের তুলনা করার সময় এখনো আসেনি।”
রিজভীও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার বক্তব্য পাল্টেছেন। আগের দিন ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিএনপির পক্ষ থেকে সংহতি জানানোর কথা বললেও বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, ‘‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে আমি আমার ব্যবহার করা ভারতীয় চাদর ফেলে দিয়েছি। আমি নিজের চিন্তা থেকে চাদর ছুড়ে ফেলেছি।
“একজন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনকে আমি যৌক্তিক মনে করি। সে কারণে সেই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছি আমি।”