“অনেক গোপন তথ্য ছিল। কিন্তু প্রকাশকরা এটা প্রকাশ করতে রাজি হল না। আমার মেয়ে সুমনা রাজি না, আমার ছোট ভাই খায়রুলও রাজি না। কারণ, এগুলো অনেক স্পর্শকাতর বিষয়,” বললেন সিপিবির সাবেক সভাপতি।
Published : 10 Feb 2023, 06:44 PM
‘অনেক স্পর্শকাতর’ কথা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খানের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন নিয়ে লেখা ‘বলা ও না বলা কথা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।
এ বইয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, জিয়াউর রহমানের অবস্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন থাকার পরও নেতৃত্বে না আসতে পারার কারণ এবং নিজের সামনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার গল্প তিনি তুলে ধরেছেন।
শুক্রবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়।
উৎসবের মধ্যেও লেখক মনজুরুলের একটি আক্ষেপ ঝরে পড়ে। তিনি জানান, তিনি লিখেছিলেন ‘অনেক কিছু’। কিন্তু প্রকাশক আর স্বজনরা রাজি না হওয়ায় সব কিছু প্রকাশ করতে পারেননি।
তিনি এমনও বলেছেন, তার মৃত্যুর পরে হলেও যেন সেসব কথা সামনে আসে। তাহলে ‘অনেক সত্য’ উঠে আসবে।
প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বইটি লিখেছেন মনজুরুল। বইটি লেখার চিন্তা কীভাবে এল, অনুষ্ঠানের শুরুতে তা তুলে ধরেন তিনি।
এই সিপিবি নেতা বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, নির্বাচন কারচুপি- এগুলো নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলোচনা হত। এগুলো নিয়ে যখন কথা বলতাম, সেগুলো শুনে অনেকে অবাক হত। প্রচলিত যে ধারণা, সে ধারণার বাইরে ছিল আমার আলোচনা।
“তখনই তারা আমাকে এই সম্পর্কে লিখতে বলেছিল। লেখার সময় হয় না, লেখার অভ্যাসও তেমন নাই। ৬৭ সনে আমার লেখা একটা বই প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর করোনাভাইরাসের সময় অনেকটা সময় পাওয়া গেল। লেখা শুরু করলাম। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই লেখা চলতে থাকল। সেখানে অনেক কথা লিখলাম।”
পাণ্ডুলিপি লিখেও প্রকাশ হলো না অনেক কথা
শেষ পর্যন্ত পাণ্ডুলিপির অনেক কিছু বাদ দিয়ে বই প্রকাশের কথা জানিয়ে মনজুরুল বলেন, “সেখানে অনেক গোপন তথ্য ছিল। কিন্তু প্রকাশকরা এটা প্রকাশ করতে রাজি হল না। আমার মেয়ে সুমনা রাজি না, আমার ছোট ভাই খায়রুলও রাজি না। কারণ, এগুলো অনেক স্পর্শকাতর বিষয়। সেটা প্রকাশকরা আমার আপত্তি সত্ত্বেও বাদ দিয়েছে।”
বাদ পড়া এই বিষয়গুলো নিয়ে আলাদা বই লেখার ইচ্ছে আছে বলেও জানান সিপিবির সাবেক সভাপতি।
তিনি বলেন, “পরবর্তী সংস্করণে বা এই বিষয়গুলো যেন আলাদা লিখেতে পারি সেই ভাবনা আছে। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনী সে রকম কোনো বিচিত্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নয়, আমার কোনো ভুল ভ্রান্তি থাকলে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করব।”
এই কমিউনিস্ট নেতার আশা, এটাও না পারলে তার মৃত্যুর পরে যেন বিষয়গুলো প্রকাশিত হয়। তাতে ইতিহাস জানতে পারবে সবাই।
কী আছে বইয়ে
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সিপিবির আরেক সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “এই বই ভালো করে পাঠ করবেন, দেখবেন, রাজনৈতিক ইতিহাস বা রাজনৈতিক ঘটনাবলী এটা না, কিংবা এটা সেনসেশনাল কিছু না। এটা হল মনজুরুল আহসান খানের মনের ভেতরের যত ভাবনা। এটা হল জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, আমলাতন্ত্র, কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে লেখা।”
সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, “এখানে দেশ ভাগ আছে, এখানে দাঙ্গা আছে, এখানে মানুষের কষ্টের কথা আছে, এখানে নিজের (মনজুরুল আহসান খানের) শৈশব কৈশোরের কথা ফুটে উঠেছে।”
অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “সামাজিকভাবে এই বইয়ের একটা গুরুত্ব আছে। এই বইতে যা আছে, তা কিন্তু কম না। অনেক তথ্য আছে। না বলা সাধারণ কিছু কথা এই বইতে আছে যা পাবলিকলি তিনি বলেননি।”
বইয়ের কিছু অংশ তুলে ধরে এম এম আকাশ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত কমিউনিস্টরা নেতৃত্ব না দিলেও দুইটা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। একটা হল ভিয়েতনাম, আরেকটা হল চীন। সেখানে তো কমিউনিস্টরা নেতৃত্ব দিয়েছে, আমাদের দেশে কেন পারল না? এটার সরাসরি উত্তর না থাকলেও কিছুটা অংশ তুলে ধরা হয়েছে।”
আকাশ জানান, বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের ধারণাও ফুটে উঠেছে এ বইয়ে। তিনি বলেন, “জাম্বুরা নাড়তে নাড়তে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি সমাজতন্ত্র চাই, কিন্তু সেটা গণতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্র চাই।’ আর বাকশাল সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য এই বইতে আছে। স্পষ্ট ভাষায় খুব সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছেন।”
জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বইয়ের কিছু অংশ তুলে ধরে এম এম আকাশ বলেন, “জিয়া সম্পর্কে আমাদের পার্টির মধ্যে মূল্যায়ন নিয়ে একটা তথ্য আছে। আমাদের পার্টি এক সময় মূল্যায়ন করেছিল ‘সীমিত অর্থে জাতীয়তাবাদ’। পরে এটাকে ভুল হিসেবে স্বীকার করা হয়। কিন্তু ‘সীমিত জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে উনি (মনজুরুল) একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য তুলে ধরেছেন মোজাফফর আহমেদের বক্তব্য দিয়ে। যেটাকে আমি মনে করি এখন আমাদের কাছে বেশি অনুকরণীয়।
“মোজাফফর আহমেদ বলেছেন, ‘জিয়া সীমিত অর্থে জাতীয়তাবাদী, এটা ছিল আমাদের তৎকালীন ফর্মুলা’। তিনি (মনজুরুল) এটার বিরোধিতা করেছেন। মোজাফফর আহমেদ বলেছেন, ‘আমি তো কখনও জিয়াকে সমীত অর্থ জাতীয়তাবাদী বা তার একটা কিছু পজেটিভ আছে সেটা বলিনি। আমি বলেছি, জিয়া খারাপ, মোশতাক আরও খারাপ।’
“আমরা যখন বিএনপি, আওয়ামী লীগ নিয়ে ফরমেশন করি, তখন এই কথাটা মনে রাখতে পারি। এই ফাউন্ডেশনটা আমাদের জন্য হেল্পফুল হবে।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, শ্রমিক নেত্রী জলি তালুকদারসহ পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
সিপিবিতে টানাপড়েন
পাকিস্তান আমলে রাজনীতিতে জড়ানো মনজুরুল আহসান খান ১৯৯৯ সালে সিপিবির সপ্তম কংগ্রেসের মাধ্যমে সভাপতির দায়িত্ব পান। ২০১২ সালে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মনজুরুল আহসান খান দলের উপদেষ্টা।
সিপিবির উপদেষ্টা থাকাকালে ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে মনজুরুল আহসান খানের নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লেখেন, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যমুনা সেতু ও পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। দেশ ক্রমেই উন্নত দেশের পর্যায়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মানচিত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।”
এরপর ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি মনজুরুলকে ছয় মাসের জন্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মনজুরুল আহসান খান একটি দৈনিক পত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধের একটি অংশ ও অন্য একটি দৈনিক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারের বক্তব্য বর্তমান সরকার সম্পর্কে দলের দৃষ্টিভঙ্গী, মূল্যায়ন ও রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
ছয় মাস পর ২০২১ সালের ২৫ জুলাই আরেক বিজ্ঞপ্তিতে মনজুরুলকে আবার উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০২২ সালের ৪ মার্চ সিপিবির যে নতুন কমিটি করা হয়, তাতে মনজুরুলকে আর কোনো পদেই রাখা হয়নি।