দেশে সরকার আছে কি না, সন্দেহ ফখরুলের

“বুদ্ধিজীবীরা যখন চাটুকারিত্বের চরম শীর্ষে যায়, তখন খুব কষ্ট হয়,” বলেন বিএনপি মহাসচিব।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2023, 01:43 PM
Updated : 16 March 2023, 01:43 PM

ক্ষমতাসীনরা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে নিজস্ব বিধান চালু করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেছেন, “সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের নির্বাচন আমরা বরাবরই দেখেছি যে- এই নির্বাচন হয় সুষ্ঠু নির্বাচন এবং এটা একটা আদর্শ যে- যারা দায়িত্বে থাকেন তারা আইনজীবী, যারা নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করেন- তারাও আইনজীবী এবং সুষ্ঠু ও সৌহার্দ পরিবেশে নির্বাচন হয়।

“গতকাল তারা (ক্ষমতাসীনরা) এই ব্যবস্থাটা ভেঙে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছেন। অর্থাৎ এই যে আওয়ামী লীগ- যাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলো, রাষ্ট্র যেটাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল, রাষ্ট্র তো একটা চুক্তি- সেই চুক্তিটি তারা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়েছে। তাদের নিজস্ব বিধি, বিধান, সংবিধান তারা চালু করেছে।”

বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ে ১২ দলীয় জোটের উদ্যোগে ‘আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২৭ দফা রূপরেখার গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, “এই ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো গণতন্ত্র তো নেই, কোনো আইনের শাসনও নেই এবং কোনো গভর্মমেন্ট আছে কি না- সেটাও আমার সন্দেহ হয়।”

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের ‘অফিসার্স অব দ্য কোর্ট’ বলা হয়ে থাকে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “সেই বিচারালয়ে যারা কাজ করেন বা বিচার ব্যবস্থায় সহযোগিতা করেন, তাদের যে বার্ষিক নির্বাচন হয়-এটা একটা ঐতিহ্য। এটাকে সবাই সম্মানের চোখে দেখেন। এটাকে জাতির বিবেক হিসেবেও দেখা হয়।

“সেই নির্বাচনে গতকাল যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে- এটা জাতির জন্য, এদেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য একটা জঘন্যতম কলঙ্কজনক ঘটনা। আমরা ইতিমধ্যে এই ঘটনার নিন্দা করেছি, আমরা ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

‘বুদ্ধিজীবীরা চাটুকারিতায়’

মির্জা ফখরুল বলেন, “আমার মাঝে মধ্যে খুব কষ্ট হয় যখন দেখি, এদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন, কিছু বিভিন্ন পেশার লোকেরা আছেন- তারা এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করে কথা বলে, এই নেত্রীকে সমর্থন করে কথা বলেন এবং চাটুকারিতার চরম শীর্ষে যায়- তখন খুব কষ্ট হয় যে, কোন রাষ্ট্রের জন্য আমরা যুদ্ধ করলাম। জামাল (মোস্তফা জামাল হায়দার) ভাইকে জিজ্ঞাসা করি, ইব্রাহিম (সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম) ভাইকে জিজ্ঞাসা করি…কী করলাম ভাই, কেন করেছি।

“এদেশ আমরা চাইনি ভাই, পরিষ্কার করে চিৎকার করে বলতে পারি। এতে যদি কেউ আমাকে ফাঁসি দেন, ফাঁসি দিতে পারেন- আমি এই বাংলাদেশ চাইনি।”

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আজকে মানুষ ভাত পায় না, চাল পায় না। লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মা তার সন্তানকে ডিম দিতে পারে না প্রোটিনের জন্য। এগুলো কোনো মিথ্যা কথা?

“এগুলো বলতে গেলেই আপনাদের একজন গোয়েবেলসকে হার মানায়- মন্ত্রী আছেন, তথ্যমন্ত্রী, সমানে বলতে থাকেন- আমরা নাকি দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চাই, সমস্যা তৈরি করতে চাই, আগুন সন্ত্রাস করার জন্য নাকি আমরা তৈরি হচ্ছি।”

ফখরুল বলতে থাকেন, “আগুন সন্ত্রাস তো শুরু করেছ তোমরা, যা কিছু করেছ তোমরা। লজ্জা করে না এদের- যখন এরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে। তোমরাই তো তত্ত্বাবধায়কের বিধান নিয়ে এসেছিলে এই জামাত (জামায়াতে ইসলাম) এবং জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে এবং ১৭৩ দিন হরতাল করেছ।

“সেই হরতালে একটা ঘটনায় শেরাটনের সামনে বাসের মধ্যে গান পাউডার দিয়ে ১১ জনকে পুড়িয়ে মেরেছ, হাজার হাজার লোককে মেরেছ, লগিবৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষকে মেরেছ। আর এখন তোমরা বলো যে, না এটা সভ্য দেশে নাই। আরে তোমরা সভ্য নয় বল, এটা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) দরকার আছে।”

‘১০ দফার দাবি ১৮ কোটি মানুষেরই’

১০ দফা দাবিতে বিএনপি ও সমমনারা যে যুগপৎ আন্দোলন করে আসছে, তা ১৮ কোটি মানুষকে বাঁচানোর আন্দোলন বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।

তার ভাষ্য, “এই বাংলাদেশ টিকে থাকবে কি থাকবে না, গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না, নাকি অন্যান্য দেশ- উত্তর কোরিয়ার মতো পুরোপুরি একটা রেজিমেন্টেড কর্তৃত্ববাদী একটা দেশে পরিণত হবে, আজকে আপনাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

“শুধু ১২ দল, বিএনপি, ১০ দল… এটা কোনো দলের ও জোটের আন্দোলন নয়, আজকের আন্দোলন এই সংগ্রাম সমস্ত ১৮ কোটি মানুষের বেঁচে থাকার আন্দোলন, সংগ্রাম। আসুন আমরা নেমে পড়ি। আমরা নেমে পড়েছি। গত ২২ অগাস্ট থেকে আমাদের ১৭ জন ভাই প্রাণ দিয়েছে। আমরা প্রতিদিন যুদ্ধ করছি, লড়াই করছি।”

যমুনা নদীকে সরুর ভাবনা প্রসঙ্গে

যমুনা নদীর প্রশস্ততা কমাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে পরিকল্পনা করছে, সে প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, “আপনি চিন্তা করতে পারেন যমুনা নদী, আমাদের হাজার বছরের ধরে প্রবাহমান যমুনা নদী চলছে। নদীর সমস্যা থাকে, বন্যা হয়, প্লাবন হয়, পলি পড়ে, খরা আসে।

“কিন্তু এই নদীকে ছোট করে দেওয়ার চিন্তা- ১২০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট। এটাকে কি বলবেন আপনি? এর মধ্যে ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়ে গেছে। একটা সীমা থাকে, চক্ষু লজ্জা থাকে-এদের কিচ্ছু নাই। এতো মোটা চামড়া হয়ে গেছে, সেই চামড়া যদি ভেদ করতে না পারে- আপনি কেন স্বাধীন আছেন?”

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় যমুনা নদীর তীর রক্ষা এবং ঝুঁকি প্রশমনে টেকসই অবকাঠামো শীর্ষক প্রকল্পটি পাঠায় পরিকল্পনা কমিশনে। এতে প্রস্তাব করা হয়েছে, যমুনা নদীর প্রশস্ততা প্রতি বছর বড় হয়ে যাচ্ছে, বর্ষার তা ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারও হয়ে যায়। নদীর প্রশস্ততা সাড়ে ৬ কিলোমিটার সংকুচিত করা হবে।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে বেশ কয়েকজন বিরোধিতা করেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। ১ হাজার ১০৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের সভাপতিত্বে ও বিএলডিপির অতিরিক্ত মহাসচিব তমিজ উদ্দিন টিটুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্ররাহিম, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, বাংলাদেশ এলডিপির আবদুল করিম আব্বাসী, শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) আহসান হাবিব লিংকন, এনডিপির আবু তাহের, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরাম, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আবদুর রকীব, মাওলানা আবদুল করিম, ন্যাপ-ভাসানী আজহারুল ইসলাম, জাগপার রাশেদ প্রধান, ইকবাল হোসেন।

সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু করতে গত ২২ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট বিলুপ্ত হয়ে ‘১২ দলীয় জোট’ গঠিত হয়।