বিএনপির অবরোধে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা আওয়ামী লীগেরও।
Published : 31 Oct 2023, 12:29 AM
নির্বাচন ঘিরে রাজপথে চলতে থাকা সমাবেশের কর্মসূচি সংঘর্ষে গড়ালে জনমনে উদ্বেগের মধ্যে আট বছর বাদে ফিরে এল বিএনপির অবরোধ; আগের রাতে বাসে আগুন দিয়ে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টাও হল।
মঙ্গল থেকে বৃহস্পতি তিন দিনের সেই অবরোধ কর্মসূচি সফলে সোমবার অনলাইন সংবাদ সম্মেলন থেকে আহ্বানও করেছে দলটি। আর গত কয়েক মাস ধরে বিএনপির কর্মসূচির দিন শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে আগের মতোই রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
বিএনপির সঙ্গে পরে আলাদাভাবে জামায়াতে ইসলামিও অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে।
অবরোধের আগে পুলিশ, র্যাব ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে। কর্মসূচির আগে ও পরে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) চট্টগ্রামে টহল দেওয়া শুরু করেছে।
এর মধ্যে অবরোধেও যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চালানোর ঘোষণা এসেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি থেকে।
আর এ কর্মসূচিকে ঘিরে নাশকতার শঙ্কা প্রকাশ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সব ধরনের সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
অবরোধের আগে এমন পদক্ষেপের মধ্যে হরতালের আগের দিনের মতো সোমবার রাতেও যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। গাজীপুরে মহাসড়কে যাত্রীবাহী একটি বাসে এবং চট্টগ্রামে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
এদিকে রাজনৈতিক এমন কর্মসূচিতে নাশকতার আশঙ্কায় ঢাকার বেশির ভাগ স্কুল শিক্ষার্থীদের বাড়িতে থাকতে বলেছে। অনেক স্কুল শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে বলেছে।
‘মামলা-হামলা-গ্রেপ্তারে থামবে না বিএনপি’
দেশব্যাপী সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধের আগের দিন সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনে থাকা বিএনপির ঘোষিত কোনো কর্মসূচি ছিল না। এদিন সন্ধ্যায় অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনে এসে আবারও নিজেদের দাবি তুলে ধরার পাশাপাশি সবার প্রতি অবরোধ কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানান দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেন, “গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলন মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার দিয়ে কখনোই থামানো যাবে না।”
তার অভিযোগ, পুরো দেশকে আতঙ্কে ফেলে দেওয়ার জন্য ‘সরকারি মদদে পরিকল্পিত সন্ত্রাস’ শুরু হয়েছে।
রিজভী বলেন, সরকারকে হটাতে যে আন্দোলন বিএনপি করছে, ‘মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার দিয়ে’ তা ‘কখনোই থামানো যাবে না’।
যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি ছাড়াও সমমনা দল ও জোট আলাদাভাবে অবরোধ কর্মসূচি করবে।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিএনপি যুগপৎভাবে বিভিন্ন দল ও জোটকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করে গত ১২ জুলাই।
এরপর থেকে টানা তিন মাসে ঢাকাসহ সারাদেশে রোড মার্চ, পদযাত্রা, গণমিছিল, কালো পতাকা মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, সমাবেশ-বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করে।
এরপর গত ২৮ জুলাই তারা ঢাকায় মহাসমাবেশের পরদিন ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি করে। এক দফা দাবিতে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের পর আবার দেশব্যাপী কর্মসূচি থেকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতিশ্রুতিই দেয়।
তবে সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনসহ ৯টি স্থানে মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপিসহ সমমনারা। কিন্তু বিএনপির সমাবেশ শুরুর দেড় ঘণ্টার মধ্যে সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষে যা পণ্ড হলে হরতাল ডাকে দলটি। পর অবরোধের এ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দেয়।
‘সতর্ক পাহারায়’ আওয়ামী লীগ
বিএনপির অবরোধ কর্মসূচির পাল্টায় মাঠে থাকার কথা বলেছে আওয়ামী লীগও। দলের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া এক বিবৃতিতে জানান, "আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার এক যৌথ সভা করে সিন্দান্ত জানান, সকল জেলা, মহানগর, উপজেলা পৌরসভা শাখা আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ অব্যাহত থাকবে।
"পাশাপাশি সকল সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা পাড়া মহল্লায় সতর্ক পাহারায় থাকবে।"
রাজপথে থাকার বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, "ঢাকা শহরে সকল ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারায় থাকবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আর নগর আওয়ামী লীগ নেতারা সকাল থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থাকবেন।“
সারাদেশে চলবে গাড়ি: মালিক সমিতি
বিএনপির ডাকা তিন দিনের অবরোধে ঢাকাসহ সারাদেশে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন চালু থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
সোমবার দুপুরে সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মালিক শ্রমিকদের যৌথসভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে এনায়েত উল্যাহ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এতে বলা হয়, বিএনপি'র ডাকা মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবারের অবরোধ উপেক্ষা করে ঢাকাসহ সারাদেশে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন চলাচল অব্যাহত থাকবে।
এসময় পণ্য ও যাত্রী পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সারাদেশের পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরকে অনুরোধ জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বিএনপি-জামায়াত সমাবেশ ও হরতাল কর্মসূচির নামে দলীয় সন্ত্রাসীরা ঢাকাসহ সারাদেশে ১৩টি গাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে ধ্বংস করেছে এবং শতাধিক গাড়ি ভাংচুর করেছে। এছাড়া ঢাকায় অছিম পরিবহনের গাড়িতে থাকা নাঈম নামে একজন শ্রমিককেও পুড়িয়ে হত্যা করেছে।”
এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, আন্দোলনের নামে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদেরকে জরুরিভাবে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে সমিতির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়।
সেইসঙ্গে অবরোধের দিনগুলোতে সড়কে গাড়ি চলাচল যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য রাজধানীসহ জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণস্থানে নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জোরদার করতে পুলিশ প্রশাসনকে অনুরোধ করেন সমিতি নেতারা।
যাত্রী পেলে লঞ্চ চালাবেন মালিকরা
যাত্রী আর নিরাপত্তা পেলে অবরোধের মধ্যে লঞ্চ চালানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন লঞ্চ মালিকরাও।
এমভি রিয়াদ লঞ্চের মালিক মো. মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন লঞ্চে যাত্রী অনেক কমে গেছে। তারপর অবরোধের মত কর্মসূচি থাকলে যাত্রী কমে যাওয়ায় আশংকা থাকে। তবে যাত্রী আর নিরাপত্তা পেলে লঞ্চ চালাব।”
সদরঘাট নৌ-থানার ওসি আবুল কালাম বলেন, থানায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্য ছাড়াও বাইরে থেকে অনেক পুলিশ থাকবে। নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, নৌপথে পুলিশ পেট্রোল ডিউটি দিবে।
পুলিশের শঙ্কা
বিএনপির ঘোষিত তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে নাশকতার আশঙ্কা করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। তবে এজন্য সব ধরনের সর্তক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) খ. মহিদ উদ্দিন।
সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি এ শঙ্কা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন।
অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, “নাশকতা যে করবে (বিএনপি) সমসাময়িক ঘটনা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে । কারণ নাশকতার যে ‘অ্যাটিটিউড’ যা অবিশ্বাস্য রকমের ‘অ্যাটিটিউড’ সে শঙ্কা আছেই। অবরোধের যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে সেই কর্মসূচি শঙ্কামুক্ত এটি বলার এখন অবকাশ নেই। বর্তমানে যে জিনিসটি আমাদের পরিলক্ষিত হচ্ছে এখন তারা চোরাগুপ্তাভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ঘটনার প্রয়াস নিচ্ছে।”
তিনি এ ব্যাপারে সকল পেশাজীবি মানুষের সহযোগিতা চেয়ে হামলাকারী- দুষ্কৃতিকারীদের ব্যাপারে স্থানীয় থানায়, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’ এ তথ্য দেওয়ার আহবান জানান।
তিনি বলেন, “গত ২৮ তারিখের ঘটনা একটি নজীরবিহীন ঘটনা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।
“প্রধান বিচারপতির বাসভবন, জাজেস কোয়ার্টার, এমনকি হাসপাতাল যেখানে সকল ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়- সেখানে পুলিশের সদস্যরা চিকিৎসা নেন তা কিন্তু না সেখানে এখন সকল শ্রেণি পেশার মানুষ চিকিৎসা নেন। সেই জায়গাগুলোকেও আহত করা হয়েছে।”
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কর্মসূচি পালন করা যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার আবার কর্মসূচি পালন না করাও গণতান্ত্রিক অধিকার।
এদিকে রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব জানিয়েছে, বিএনপি ঘোষিত অবরোধে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে র্যাব ফোর্সেস এর ১৫টি ব্যাটালিয়নের তিন শতাধিক টহল নিয়োজিত থাকবে। পাশাপাশি দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম চলমান থাকবে। যে কোনো উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় র্যাব ফোর্সেস এর স্পেশাল টিম ও স্টাইকিং ফোর্স রিজার্ভ রাখা হয়েছে। যে কোনো নাশকতা ও সহিংসতা প্রতিরোধে র্যাব সদস্যরা নিয়োজিত থাকবে।
অবরোধের আওতামুক্ত
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা রিজভী তিন দিনের অবরোধে সংবাদপত্রের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সিলিন্ডার পরিবহনের গাড়ি আওতামুক্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন।