এবার ‘শেষ দেখবেন’ তাবিথ

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী তাবিথ আউয়াল বলেছেন, এবার শেষ পর্যন্ত লড়বেন তিনি, প্রয়োজনে শেষের পরেও লড়ে ফল ছিনিয়ে আনবেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2019, 05:27 PM
Updated : 27 Dec 2019, 06:19 PM

ঢাকা দুই ভাগ হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ২০১৫ সালে প্রথম নির্বাচনে উত্তরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ।

ওই দিন ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরেক ব্যবসায়ী প্রয়াত আনিসুল হক।

তার প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ভোট হবে আগামী ২০ জানুয়ারি। এবারও বিএনপির হয়ে মেয়র পদে লড়তে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে তা জমা দিয়েছেন তাবিথ আউয়াল।

তাবিথ ছাড়াও উত্তরের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ইশরাক হোসেন শুক্রবার বিকাল ৪টার দিকে মনোনয়নপত্র জমা দেন। নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছে এক লাখ টাকা জামানতসহ মনোনয়নপত্র জমা দেন তারা।

কয়েক হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মিছিল নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে এসে ফরম জমা দিতে আসেন তাবিথ ও ইশরাক। তবে রিপন এসেছিলেন একাই।

দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার পর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তাবিথ ও ইশরাক।

বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম জমা দিতে আসেন বিএনপির প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নেতারা

তাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, ক্ষমতাসীন দল থেকে বলা হচ্ছে যে, বিএনপি নির্বাচনকে বির্তকিত করার জন্য অংশগ্রহন করছে। শেষ পর্যন্ত আপনারা নির্বাচনের মাঠে থাকবেন না। আপনারা কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবেন?

জবাবে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল বলেন, “আমি প্রকাশ্যে বলতে চাচ্ছি- নির্বাচন আমাদের, জনমত আমাদের। নির্বাচন থেকে আমরা সরবই না।

“আমরা শেষ পর্যন্ত, শেষের পরের থেকেও লড়াই করে নির্বাচনের ফলাফলই ছিনিয়ে আনব না, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার পরেই আমরা মাঠ থেকে ফেরত যাব।”

দক্ষিণে দলের একমাত্র মনোনয়ন প্রত্যাশী ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বড় ছেলে ইশরাক হোসেন বলেন, “এটা ভুল কথা। যদি কেউ বলে থাকে যে, নির্বাচনকে আমরা বিতর্কিত করার চেষ্টা করছি- এটা মোটেও ঠিক না। আমরা কেন, সারা দেশবাসী দেখেছে যে, ৩০ তারিখ বা ২৯ তারিখ কী ধরনের নির্বাচন বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে হয়েছে। ওইটি কোনো নির্বাচন হয় নাই। তবে আমরা নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি বুঝে দলের যারা সিনিয়র নেতৃবৃন্দ আছেন তাদের সাথে পরামর্শ করেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব যদি দল আমাদের মনোনয়ন দেয়।

“আামি কর্মীদের উদ্দেশে বলব, বারে বারে গণতন্ত্রের উপর আঘাত এসেছে এবং গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। আপনারা হতাশ হবেন না। ইনশাল্লাহ, গণতন্ত্র ফিরে আসবে আমাদের মাঝে।”

‘নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, সরে যাওয়া উচিত’

দলের মনোনয়ন পেতে ফরম সংগ্রহ করে জমা দিলেও বিএনপির বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন বলছেন, এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলেই তিনি মনে করছেন এবং সেদিক থেকে তার বিবেচনায় এই নির্বাচন থেকে তাদের সরে যাওয়া উচিত।

ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে লড়তে দলীয় মনোনয়ন ফরম নিয়ে তা জমা দিলেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পক্ষে নন বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান রিপন

দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে নির্বাচনে যাওয়ার- এই নির্বাচনে যাওয়ার কোনো অর্থ নাই। কারণ হচ্ছে, আমাদের পার্টি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জেলে। উনাকে এখন পর্যন্ত আমরা মুক্ত করতে পারি নাই। শেখ মুজিবুর রহমান যখন জেলে ছিল তখন তাকে মুক্ত করেই গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া হয়েছিল।

“আমরা জাতীয় নির্বাচনের সময় এ রকম অনেক কিছু বলতে পারতাম, করতে পারতাম কিন্তু আমাদের নেত্রীকে ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে গিয়েছি। কোনো লাভ হয় নাই, আমাদের দাবি পূরণ হয় নাই এবং নির্বাচন কী হয়েছে তা আপনারা সবাই জানেন। এই সরকার এবং এই দল যখন ক্ষমতায় থাকবে এবং এর অধীনে যখন নির্বাচন কমিশন থাকবে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব না।”

নেত্রীর মুক্তি ও ‘সুচিকিৎসা’ না হওয়ার প্রতিবাদ স্বরূপ দলের এই নির্বাচন ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “আমি নিজে আজকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, এই নির্বাচনে গিয়ে লাভ হবে না। বরং অবৈধ সরকারকে আরও বৈধ্যতা প্রদান করা হবে। এটা ৩০ তারিখে যে নির্বাচন হয়েছে ওই জাতীয় আরেকটি নির্বাচনের খেলা হবে।

“নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে। এই প্রহসনের পার্ট হতে আমি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী না। যেহেতু আমি ব্যক্তিগতভাবে দল করি, আমি দলের শৃঙ্খলা ও সিদ্ধান্ত মানি। সেজন্য আমি মনোনয়নপত্র নিয়েছি, মনোয়নপত্র জমা দিয়েছি।”

ব্নিপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিকাল ৪টায় নয়া পল্টনে মিছিল নিয়ে আসার কয়েক মিনিট আগে একটা হাতবোমা বিস্ফোরিত হয় কার্যালয়ের কিছু দূরে। তবে তাতে সেখানে নির্বাচনী আমেজে ভাটা পড়েনি।

কাউন্সিলর প্রার্থীরা ব্যান্ড দল নিয়ে মিছিল সহকারে এসে মহানগর কার্যালয়ে ফরম জমা দেন। তাদের মিছিলের কারণে সড়কের একপাশে যান চলাচল কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে।

নির্বাচন নিয়ে নিজের ভাবনা উল্লেখ করে তাবিথ আউয়াল বলেন, “আমরা দেশবাসীকে দেখিয়ে দিতে চাই, নগর উন্নয়নে তরুণ নতুন প্রজন্মকে এখন দরকার, মেধাবীদের দরকার। ঢাকা শহর বর্তমানে প্রত্যেকটা সূচকে নিম্ন স্তরে আছে। বাসস্থান বলেন, পানি বলেন, আবহাওয়া দূষণ বলেন-এসব থেকে আমরা চাচ্ছি ঢাকাবাসীকে মুক্ত করতে।

“এই মুক্তির সাথে শুধু আমাদের জীবনের মুক্তি না, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্যও পুরো দেশ বসে আছে, আন্তর্জাতিক মহলও তাকিয়ে আছে। এই আন্দোলন থেকে আমরা সরে আসি নাই।”

নির্বাচনের পরিবেশ কেমন দেখছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এখানে আমার বলার কিছু নাই। সাধারণ জনগণের প্রশ্নই আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরছি, যার কাছে যাচ্ছি আমাকে প্রশ্ন করছে- ভোট দিতে পারবেন কি না, ভোট দিতে পারলে ভোট গণনা হবে কি না, ভোট গণণা হলেও ভোট সঠিকভাবে প্রকাশ করা হবে না।

“এই সকল প্রশ্নের উত্তর প্রধান নির্বাচন কমিশনার দিতে পারবেন। এর মধ্যে উনি দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ নেন নাই, কোনো কথাও বলেন নাই যেখান থেকে আমরা আশ্বাস পেতে পারি যে, আসলে উনাদের যে আগে একটা রূপরেখা ছিল নির্বাচনটাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য, সেখান থেকে উনারা সরে এসেছেন।”

নির্বাচনী দাবি তুলে ধরে এই বিএনপি নেতা বলেন, “আমি চাইব, অবিলম্বে ইভিএম থেকে উনারা সরে যাক। এই দুর্নীতিগ্রস্ত মেশিনের কোনো দাম নাই এই মুহূর্তে। একটা বিতর্কিত নির্বাচন করার কোনো দরকার নাই এই মুহূর্তে। আমরা চাইব, গণমাধ্যমকে মুক্ত করে দেওয়া হোক, বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে দিতে যাতে করে আগামী নির্বাচনে ভোট সেন্টারের ভেতরে গিয়ে সব কিছু প্রকাশ করতে পারে।”

ক্ষমতাসীনরাই নির্বাচন বন্ধের চেষ্টায় আছে বলে অভিযোগ করেন তাবিথ আউয়াল।

তিনি বলেন, “গত নির্বাচনে আপনারা কী দেখেছেন? সরকারি মহল থেকে সরকারি দলের প্রার্থীরা বারে বারে হাই কোর্টে রিট করে নির্বাচনকে বন্ধ করেছে। এই নির্বাচনও হুমকির মুখে আছে। বর্তমান সরকারি দলের কাউন্সিলর আবার চেষ্টা করছে হাই কোর্টে রিট করে বন্ধ করার জন্য। আমরা এখন কী দেখছি যে, বিরোধী দল নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছে না, সরকারি দল নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেটা হতে দেব না।”

এই নির্বাচন কমিশনের প্রতি ‘কোনো আস্থা নেই’ জানিয়ে ইশরাক হোসেন বলেন, “গত ২৯ ও ৩০ তারিখ এই কমিশনের অধীনে কী নির্বাচন হয়েছে? আমি তাদের থেকে খু্ব বেশি আশা করতে পারছি না। তারপরেও যেহেতু আমরা একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রয়েছি, সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছি।”

প্রয়াত সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক বলেন, বাবার কাছ থেকে ঢাকাবাসীর প্রয়োজন সম্পর্কে ধারণা নিয়েছেন তিনি।

“আমি নগর সরকারের দাবি জানাতে চাই। কারণ একটি সিটি করপোরেশনে যে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে তার পক্ষে ঢাকা শহরে যে নাগরিক সমস্যাগুলো রয়েছে এবং নাগরিকদের জীবনমানের যে প্রতিজ্ঞা তারা করছে, সেটা তাদের পক্ষে করা সম্ভব না। কারণ তাদের সেই ক্ষমতা অথবা আর্থিকভাবে সেই সক্ষমতা তাদের নাই।”

 মেয়র পদে প্রার্থী ‘চূড়ান্ত শনিবার’

মেয়র পদে তিনজনের দলীয় মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার পর বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী সাংবাদিকদের বলেন, “শনিবার বিকালে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মনোনয়ন বোর্ড তাদের সাক্ষাৎকার নেবেন। আমরা আশা করছি, আগামীকালই প্রার্থী চূড়ান্ত করা ‍যাবে।”

শনিবারই দলীয় মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী

কাউন্সিলর প্রার্থী চূড়ান্ত কীভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কাউন্সিলর বাছাই করার জন্য তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই সেই টিম করবে। মহানগর বিএনপির কার্যালয়ে কাউন্সিলরদের মনোনয়নপত্র জমা হচ্ছে।”

স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানের নেতৃত্বে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে উত্তর এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবদুস সালামের নেতৃত্বে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য কমিটি করেছে বিএনপি।

দক্ষিণে কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়নের জন্য ২২০টি, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৬০টি এবং উত্তরে কাউন্সিলর পদে ১৬২টি ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৩৪টি মনোনয়ন ফরম জমা পড়েছে।