জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান মানছেন না রওশন এরশাদ

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তার ভাই জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হলেও তা মানতে রাজি নন দলের জ্যেষ্ঠ কো চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2019, 07:45 AM
Updated : 23 July 2019, 11:44 AM

তিনি বলছেন, জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করার আগে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে জি এম কাদের এখনও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানই আছেন।

জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতার প্যাডে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের নিয়ম তুলে ধরে ওই দাবি করেছেন এরশাদপত্নী রওশন। 

এরশাদের ‘ইচ্ছায়’ পার্টির নেতৃত্ব পাওয়া জি এম কাদের বলেছেন, দলে কোনো সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করবেন তারা।

এরশাদ জীবিত থাকাকালেই জাতীয় পার্টির পদ বণ্টন ও অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিয়ে জি এম কাদেরের সঙ্গে রওশনের দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য।

অসুস্থ থাকা অবস্থায় এরশাদ গত এপ্রিলে তার ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। এর পর থেকে রওশন ও তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে দলীয় কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছিল না।

গত ১৪ জুলাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ।

তার চার দিনের মাথায় এক সংবাদ সম্মেলনে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নাম ঘোষণা করা হয়। এরশাদের স্ত্রী রওশন ওই সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থিত ছিলেন না।

দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ সেদিন ওই ঘোষণা দিয়ে বলেন, মৃত্যুর আগে এরশাদই এ সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন।

এরপর গত শনিবার এরশাদের বড় ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে গুলশান-২ নম্বরে ভাবি রওশনের বাসায় যান জি এম কাদের।

রওশন সেদিন পার্টির নতুন চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে আশির্বাদ করেন বলে দলের প্রেস সচিব সুনীল শুভ রায় সাংবাদিকদের জানান।

কিন্তু দুই দিনের মাথায় রওশনের স্বাক্ষরে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় উল্টো কথা।

সেখানে বলা হয়-

“সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের মারফত জানতে পেরেছি, জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা আদৌ কোনো যথাযথ ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।

“ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্বপালনকালে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র ধারা ২০ (২) এর খ-এ দেওয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। যথা- ‘মনোনীত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রেসিডিয়ামের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করবেন।’ চেয়ারম্যানের অবর্তমানে ধারা ২০ (২) এর ‘ক’-কে উপেক্ষা করা যাবে না।

“আশা করি বর্তমানে যিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী চেয়ারম্যান না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।”

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পার্টির ‘অনেক সিনিয়ার নেতা’ রওশনের ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত।

তাদের মধ্যে সাতজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দুইজন এমপির নামও ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যুক্ত করা হয়েছে। 

এরা হলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ ফখরুল ইমাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ সেলিম ওসমান, সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকা, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ নাসরিন জাহান রত্না, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী, সাংসদ রওশন আরা মান্নান, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে মঙ্গলবার রওশন এরশাদকে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রওশনপন্থী নেতা মীর আব্দুস সবুর আসুদ মঙ্গলবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হ্যাঁ, ওই হাতে লেখা চিঠি রওশন এরশাদ ম্যাডামেরই। আমরা অনেকে এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছি।”

এ বিষয়ে প্রশ্নে করলে জি এম কাদের সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিঠিটা দেখেছি। এখনই এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না।”

এরপর মঙ্গলবার দুপুরে বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে জি এম কাদের গেলে সাংবাদিকরা তা নিয়ে প্রশ্ন করেন তাকে।

তিনি তখন বলেন, “এই হাতে লেখা বিবৃতিটি কাঁচা, এটা বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়।

কাদের একইসঙ্গে বলেন, “হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাদের পরিবারে পিতৃতুল্য ছিলেন, সেইভাবেই বেগম রওশন এরশাদ আমাদের মায়ের মতো। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশনায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছি। এখনও পল্লীবন্ধুর নির্দেশনাতেই চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছি।”

গঠনতন্ত্রের ব্যত্যয় ঘটনার বিষয়ে জি এম কাদের বলেন, “জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ গঠনতন্ত্র অনুসরণ করেই চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। তারা যে নামেই সম্বোধন করবে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। জাতীয় পার্টিতে কাজ করাটাই আসল কথা।”

“কোনো সমস্যা থাকলে আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করব,” বলেন তিনি।

জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব বহু পুরনো। ২০১৬ সালে এরশাদ তার ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো চেয়ারম্যান করলে তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন স্ত্রী রওশন এরশাদ। তখন দলে সিনিয়র কো চেয়ারম্যান পদ তৈরি করে তাতে আসীন করেন রওশনকে।

জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব বহু পুরনো, গত এপ্রিলে এক মঞ্চে উঠে দলীয় ঐক্যের ঘোষণা দেন তারা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গুরুতর এরশাদের অসুস্থত আর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান জি এম কাদের। তখন থেকেই দলে রওশনপন্থী নেতাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি।

কদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে এই নেতাদের উদ্দেশ্য করে জি এম কাদের বলেন, “জাতীয় পার্টি এখন যৌথ নেতৃত্বেই চলছে। দলের ৯৯ ভাগ প্রেসিডিয়াম সদস্যের সমর্থন আমার সাথে রয়েছে।”

পরে সেদিন দুপুরেই রওশন এরশাদের বাড়ি গিয়ে দোয়া চেয়ে আসেন তার দেবর কাদের।

সেদিনের ঘটনাকে বরফ গলার ইঙ্গিত বলে মনে হলেও রওশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এরশাদহীন জাতীয় পার্টির বিভক্তিকে আরও স্পষ্ট করে তুললো।