এরশাদের চেয়ার ভাই জিএম কাদেরকেই দিল জাতীয় পার্টি

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে তার ভাই জিএম কাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2019, 08:07 AM
Updated : 18 July 2019, 01:58 PM

জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা এ দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ বৃহস্পতিবার বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন।

তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১ (ক) ধারা অনুযায়ী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, তার অবর্তমানে জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান হবেন।

“আজ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জি এম কাদেরই আজ থেকে দলের চেয়ারম্যান হবেন৷”

গত দুই মাস ধরে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলে আসা জি এম কাদের এ সময় মহাসচিবের পাশেই ছিলেন। তবে এরশাদের স্ত্রী ও দলের সিনিয়র কো চেয়ারম্যান রওশন এরশাদকে সংবাদ সম্মেলনে দেখা যায়নি।  

সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ গত ১৪ জুলাই ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর।

মৃত্যুর আগে এরশাদ তার ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে গিয়েছিলেন, যা নিয়ে দলে অনেক নাটকীয়তাও হয়েছিল। 

গত জানুয়ারিতে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার আগে ছোট ভাই কাদেরকে দলের ভবিষ্যত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এরশাদ।

কিন্তু দেশে ফেরার পর মার্চ মাসে জিএম কাদেরকে তিনি জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন ‘ব্যর্থতার’ অভিযোগ এনে। আর সংসদে বিরোধী দলের উপনেতার দায়িত্বে আনেন স্ত্রী রওশনকে, যিনি দলের সিনিয়র কো চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন।

এরপর দুই সপ্তাহ না গড়াতেই রংপুর বিভাগের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে আবার ভাইকে নেতৃত্বে ফেরান সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ।

পরে ১৯ মে মধ্যরাতে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদে আসীন করেন।

ওই সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেন, তার অবর্তমানে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব তার ছোট ভাই জিএম কাদের পালন করবেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি অনেক সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। সে কারণে তিনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত জিএম কাদেরই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।

প্রোফাইল: জিএম কাদের

জিএম কাদেরের পুরো নাম গোলাম মোহাম্মদ কাদের, জন্ম ১৯৪৮ সালে। চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। বড় ভাই এরশাদ তাকে আদর করে ডাকতেন সেলিম নামে।

বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি নেওয়ার পর কর্মজীবন শুরু করেন নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে। পরে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, ইরাকের কৃষি মন্ত্রণালয় এবং যমুনা তেল কোম্পানিতেও চাকরি করেন। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্ত হন রাজনীতিতে; বড় ভাই এরশাদ তখন দুর্নীতির দায়ে জেলে।

১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লালমনিরহাট সদর আসন থেকে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে রংপুর-৩ এবং ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে লালমনিরহাট-৩ আসন থেকে জয়ী হয়ে সংসদে যান।  ২০০৯-১৪ মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারে প্রথমে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী এবং পরে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৯ সালের ১৯ মে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে জাতীয় পার্টি।

জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদের বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের তালিকাভুক্ত সংগীত শিল্পী। তাদের মেয়ে ইশরাত জাহান কাদের এবং ছেলে শামস বিন কাদের দুজনই আছেন অস্ট্রেলিয়ায়।

জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই তখন এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। দলের নীতিনর্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তগুলো চেয়ারম্যান একা নেন বলেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন কেউ কেউ।

দলের নেতৃত্ব নিয়ে এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের সঙ্গেও শীতল সম্পর্ক চলছে জি এম কাদেরের। তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার পর থেকেই সিনিয়র কো চেয়ারম্যান রওশন দলের কর্মসূচিতে আসছেন না।

এ অবস্থায় এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির হাল কে ধরবেন, কীভাবে এ দল পরিচালিত হবে- সেসব প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরছিল।

তবে ‘ভারপ্রাপ্ত’ থেকে পুরো দায়িত্ব নিয়ে ভাইয়ের চেয়ারে বসা জি এম কাদের দলের ভবিষ্যত নিয়ে সব নেতিবাচক সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেন।

তিনি বলেন, “জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই, কোনো দ্বন্দ্ব নেই, কোনো মতভেদ নেই।… হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আদর্শকে ধারণ করে, তার নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাব।”

এরশাদের অসুস্থতার কারণে বেশ কিছু দিন ধরেই জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রমে চলছে স্থবিরতা । দলকে আবারও সচল করতে সারা দেশে বিভাগীয় ও জেলা কমিটিগুলোকে আরও শক্তিশালী করার ঘোষণা দেন জি এম কাদের। 

জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা ও উপনেতার পদে পরিবর্তন আনারও আভাস দেন জি এম কাদের। তবে তার আগে দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের মতামত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনে উপ নির্বাচনের জন্য ইতোমধ্যে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। সেখানে কাকে প্রার্থী করা হবে তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা।

উত্তরে জি এম কাদের বলেন, “এখনো সময় আছে। দলীয় ফোরামে আমরা এ নিয়ে আলোচনা করব। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রার্থী সিলেক্ট, যাচাই–বাছাই ও চূড়ান্ত করার পর ফাইনালি আমরা নাম ঘোষণা করব।”

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও আদেলুর রহমান আদেল উপস্থিত ছিলেন এ সংবাদ সম্মেলনে।