কেন্দ্র পাহারা কমিটি ও ভোট বাক্স পরীক্ষা করতে বললেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা

ভোটের দিন ‘কেন্দ্র পাহারা’ কমিটি গঠনের পাশাপাশি সকালে ভোটের বাক্স পরীক্ষা করার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।

সুমন মাহমুদ টঙ্গী থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2018, 02:26 PM
Updated : 15 Dec 2018, 08:00 PM

শনিবার ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ অভিমুখে নির্বাচনী প্রচারে যাওয়ার পথে টঙ্গীতে এক সভায় এই আহ্বান জানান জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব।

তিনি বলেন, “এলাকার মুরব্বি, মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার সুপার ও শিক্ষকদের নিয়ে ১০১ জনের পাহারা গণ কমিটি গঠন করুন। এই কমিটির সবাই ভোট শেষ হওয়ার আগে কেন্দ্র ঘেরাও করে রাখবেন। কেউ কেন্দ্র ছাড়বেন না।”

কমিটি গঠনের পাশাপাশি সকালে কেন্দ্রে ঢুকে ভোটের বাক্স পরীক্ষা করারও নির্দেশ দেন আ স ম রব।

তিনি বলেন, “ওরা (ক্ষমতাসীনর) যাতে ভোটকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে না থাকতে পারে সেজন্য আপনারা ভোর রাত ৪টার আগেই কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নেবেন। ভোটের আগের দিন বেশি রাত করে ঘুমাতে যাবেন না, ভোরে উঠতে হবে।

“সকাল ৮টা থেকে ভোট শুরু হয়। কেন্দ্রে গিয়ে প্রথমেই আপনার কাজ হচ্ছে, প্রতি ভোটের বাক্স পরীক্ষা করুন, কোনো বাক্সে ব্যালট আছে কি না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ রয়েছে প্রতিটা পোলিং বুথ ও প্রতিটা কেন্দ্রে সব ভোট একসাথে করে প্রিজাইডিং অফিসার, কেন্দ্রের অফিসার স্বাক্ষর করে সিল মেরে রেজাল্ট শিট নিয়ে আসবেন। শপথ নেবেন- জান দেব, তো ভোট দেব না। রেজাল্ট ছাড়া কেন্দ্র ছাড়বেন না।”

বেলা ২টায় ঢাকার উত্তরার জসিমউদ্দিন সড়কের বাসা থেকে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নিয়ে ময়মনসিংহ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন আ স ম আবদুর রব। প্রথম পথসভা হয় টঙ্গীর কলেজ গেইটের কাছে ধানের শীষের প্রার্থী সালাহ উদ্দিন সরকারের বাসার সামনে খালি জায়গায় প্যান্ডেল টাঙিয়ে।

স্বল্প পরিসরের এই জায়গায় কয়েক হাজার নেতা-কর্মী ধানের শীষ হাতে নিয়ে সমবেত হন। খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে মুহুর্মুহ শ্লোগান দেন তারা।

রব বলেন, “ধানের শীষে ভোট দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। এক একটি ভোট বেগম জিয়ার মুক্তি ত্বরান্বিত করবে।”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরাজয়ের ভয়ে নির্বাচন বন্ধের পথ খুঁজছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনের মাঠে নামা জেএসডি সভাপতি রব।

তিনি বলেন, “সরকারের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয় পেয়েছেন। উনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। সুযোগ খুঁজতেছে নির্বাচন কীভাবে বন্ধ করা যায়, নির্বাচন থেকে কীভাবে পালিয়ে যাওয়া যায়।

“আমরা ১৮ কোটি মানুষের পক্ষ থেকে বলতে চাই, আমরা ইনশাল্লাহ ভোটে জয়লাভ করব। আপনাকে (শেখ হাসিনা) যদি চলে যেতে চান তাও দেব অথবা আমরা আপনাদের ওপর কোনো অত্যাচার করব না। আমরা কথা দিয়েছি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী হলে যারা হেরে যাবে তাদের সাথে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করব।”

ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন সরকারকে পাশে রেখে বক্তব্য দেন আ স ম আবদুর রব।

বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও গায়েবি’ মামলা বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে রব বলেন, “আমরা আমাদের কর্মীদের শান্ত থাকতে বলব, সাহস নিয়ে থাকতে বলব, ধৈর্য নিয়ে থাকতে বলব ২৯ তারিখ পর্যন্ত। কিন্তু ৩০ তারিখ ভোট বিপ্লব হবে। এই লড়াই ভোটের লড়াই, এই লড়াই খালেদা জিয়ার মুক্তির লড়াই, এই লড়াই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াই, এই লড়াই স্বৈরশাসনের পতনের লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে।”

মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বাইরে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “গতকাল আমরা বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম। ওরা (আওয়ামী লীগ) আমাদের শহীদ করতে চেয়েছিল। এই হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা। সব কিছুর একটা সীমা আছে।”

স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি ও দুর্নীতিবাজদের ভোট না দেওয়ার যে আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, তারও জবাব দিয়েছেন রব।

তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জঙ্গি, স্বাধীনতাবিরোধী, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারী তাদের নাকি আমরা মনোনয়ন দিয়েছি। আমি একটু জিজ্ঞাসা করি উনাকে। আমি গতরাতে ঘুমাতে পারিনি বঙ্গবন্ধু কবরের মধ্যে চিৎকার করতেছে, মারে তুই এটা কী করলি? ২৫ মার্চ রাত্রে যে কমান্ডো আমাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে গেল তুলে সেই বেটার হাতে নৌকা তুলে দিছত? এরপর কি হাসিনার মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্বাধীনতার কথা শোভা পায়?

“গরিবের কথা বলেন, ব্যাংক লুটের কথা বলেন। যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লুট করেছে, রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করেছে, ভল্টের সোনা লুট করেছে, খনির কয়লা লুট করেছে, পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়ে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন শেষ করেছে, দুর্নীতিবাজ, খুনি, স্বৈরাচারের দোসর, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুণ্ঠনকারীদের আপনি নমিনেশন দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনার মুখে ব্যাংক লুটেরাদের কথা শোভা পায় না।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথানে নিরস্ত্র মানুষই জিতেছে, নব্বইয়ের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে নিরস্ত্র মানুষই জিতেছে। আসলে যারা অত্যচারিত হয় আল্লাহ তাদের পক্ষে থাকেন।

“আজকে সারা দেশে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা জেলখানায়। পুরনো মামলার এজাহারে তাদের নাম নেই, তাদেরকে জেলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি যে আসনটি প্রধানমন্ত্রীর, যে আসনে আমরা কখনোই বিজয়ী হই না, সেখানেও সেই ধানের শীষের প্রার্থী এস এম জিলানিকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অর্থাৎ ভয়েই আছে তারা। ভয় হচ্ছে পরাজয়ের ভয়। লাভ নেই কিছু। এদেশের মানুষ বরাবরই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছে। এবারা বিজয়ী হবে জনগণ ইনশাল্লাহ।”

ঐক্যফ্রন্টের আরেক শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “কেবলমাত্র শ্লোগান দিয়ে জিততে পারবেন না। যারা ক্ষমতায় আছে ওরা ইবলিস, সব করতে পারে তারা। এসব বুঝে নিজে নিজের মাথা খাটিয়ে নিজের কেন্দ্রে তাদের পরাজিত করতে চেষ্টা করতে হবে।

“আমি বলতে চাই, মামলা দিয়ে, গ্রেপ্তার করে ওরা আমাদের লড়াই বন্ধ করতে পারবে না। এই লড়াই হচ্ছে ভোটের লড়াই। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ওরা দেবে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দিলে ওরা লেভেল হয়ে যাবে। তাই ওরা যত কিছু করুন ২৯ তারিখ পর্যন্ত মাটি কামড় দিয়ে পড়ে থাকতে হবে। আমরা এখন জবাব দেব না। ৩০ তারিখ ওদের জবাব দেবে জনগণ।”

বিএনপির গাজীপুর মহানগর সভাপতি হাসান উদ্দিন সরকারের সভাপতিত্বে এবং সরাফত আলী সুক্কুর ও মাহবুব আলমের পরিচালনায় পথসভায় গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, গাজীপুরের মহানগর সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন, গাজীপুর-২  আসনের ধানের শীষের প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমেদ বক্তব্য রাখেন।

এই পথসভায় জেলা বারের সাবেক সভাপতি ড. শহীদুজ্জামান, মহিলা দলের জেলা সভানেত্রী শিরিন চাকলাদার, বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খানসহ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, মহিল দল ও ছাত্রদলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

পথসভার জন্য পুলিশের নিয়ে টঙ্গীর সফিউদ্দিন একাডেমিতে সব কিছুর আয়োজন করলেও সকালে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তার দখল করে নেয় বলে আয়োজকরা অভিযোগ করে। পরে প্রার্থীর বাসার সামনে এই পথসভার আয়োজন করা হয়।

এরপর শ্রীপুরের মাওনার পথসভায় বক্তব্য রাখেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।

সেখানে পথসভায় কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, “‍যতদিন বেঁচে থাকব বঙ্গবন্ধকে ‍বুকে লালন করে বেঁচে থাকব। আমি বলছি, আওয়ামী লীগ কোনো মতেই বঙ্গবন্ধুর দল এখন আর নেই। শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু কোনোমতেই এক নয়।

“আমি বলতে চাই, আজকের লড়াই বঙ্গবন্ধুর সাথে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক লড়াই। ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সব লোক একদিকে আর রাজাকারদের বগলতলে শেখ হাসিনা নিয়েছেন। সেজন্য বলতে চাই, বার বার প্রতিবার এখান থেকে রহমত আলী এমপি হয়েছেন। এবার রহমত আলী কোথায়? একজন টাকাওয়ালা মানুষকে টাকা খেয়ে নমিনেশন দিয়েছে তলাফাটা নৌকা মার্কায়। এবার ভারত থেকে ট্যাংক আসলেও শেখ হাসিনা ভোট নিতে পারবেন না।”

৩০ ডিসেম্বর সবার ভোটের মাধ্যমে ৩১ ডিসেম্বর বা নতুন বছরের প্রথম দিনই খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

গাজীপুর-৪ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ইকবাল সিদ্দিকীকে শিক্ষানুরাগী অভিহিত করে তাকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান কাদের সিদ্দিকী।

শাহজাহান ফকিরের সভাপতিত্বে এই পথসভায় মাহমুদুর রহমান মান্না, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও প্রার্থী ইকবাল সিদ্দিকী বক্তব্য রাখেন।

ময়মনসিংহ অভিমুখে সাতটি পথসভায় বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের।

গত ১৩ ডিসেম্বর সিলেটে হযরত শাহজালাল ও  হযরত শাহ পরানের মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর এটি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রথম রোড মার্চ।