কথা বলতে ‘না দিতেই’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ফখরুল

“তাদের একটাই লক্ষ্য, নাগরিকদের কথা বলতে দেওয়া হবে না, নাগরিকদের তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হবে না।”

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2023, 11:19 AM
Updated : 11 April 2023, 11:19 AM

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে দেশের নাগরিকদের ‘প্রতিহত করা করা হচ্ছে’ বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

ঢাকার গুলশানে মঙ্গলবার এক সেমিনারে তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে নাগরিকদের নির্যাতন করা হচ্ছে। এখন কী করছে? যে কেউ বাইরে থেকে যদি কোনো লেখা লেখে বা স্ট্যাটাস দেয়… ডয়েচে ভেলের একটা ভিডিও গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে র‌্যাবের ঘটনা নিয়ে। সেই ভিডিওতে একজন সাক্ষ্য দিয়েছিল নাফিজ, তাকে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

“তাদের একটাই লক্ষ্য, নাগরিকদের কথা বলতে দেওয়া হবে না, নাগরিকদের তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হবে না। তারা তাদের মত করে এখনও রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, করেছে সেইভাবে।”

গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক কাঠামো’ শীর্ষক এই সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছিলেন বিএনপি মহাসচিব।

সরকার ওই আইনের মাধ্যমেই ‘নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন দিয়ে নাগরিকদেরকে প্রতিহত করা হচ্ছে যে, তারা তাদের কথা বলবে না, তারা তাদের অভিযোগগুলো বলবে না, তারা লিখবে না, সাংবাদিকরা যেন না লিখে তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

“ঠিক একইভাবে অন্যান্য আইনগুলো দিয়ে আজকে এই নির্বাচনে তারা প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণরূপে দূরে রেখে নির্বাচন পার হয়ে যেতে চায়।”

কেউ যেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে, সেজন্যই সরকার এ আইন করেছে মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “এই সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, দখলদারী একটা সরকার। তারা এসব আইন করে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চায়।

“সামনে নির্বাচন, এই নির্বাচন সামনে রেখে যেন কেউ রুখে দাঁড়াতে না পারে, কেউ যেন তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে এবং নির্বাচনে তাদেরকে কেউ যেন বাধা দিতে না পারে তারজন্য এই সমস্ত আইনগুলো করে নিয়ে যাচ্ছে।”

এ ধরনের ‘কালাকানুন’ বাতিলের দাবি জানিয়ে ফখরুল বলেন, সবার আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করতে হবে। এটা এখন দেশের দাবি, জনগণের দাবি।

“আসুন আমরা আমাদের সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশকে একটা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য, বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার অর্থে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্যে, এখানে সাধারণ মানুষ যাতে তার অধিকার ভোগ করতে পারে, বৈষম্য কমিয়ে নিয়ে এসে সাম্যের একটি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্যে আমরা সবাই একযোগে লড়াই শুরু করি।

“এই যে ভয়াবহ দানব যা আমাদের বুকের ওপরে চেপে বসে আছে, তাদেরকে সরিয়ে সত্যিকার অর্থেই জনগণের একটা পার্লামেন্ট, জনগণের একটা সরকার গঠন করতে পারি, সেই লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাই।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে পরিত্রাণ পেতে ‘সরকারের পতনের বিকল্প নেই’ বলে মন্তব্য করেন ফখরুল।

“এটা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ। এদেরকে সরাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আজকে প্রত্যেকে আমরা ভিক্টিম হচ্ছি, প্রতিটি নাগরিক ভিক্টিম হচ্ছে, দেশের সাধারণ ও গরীব মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”

হাতিরঝিল থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী অপুকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে দাবি তার সন্ধান ও মুক্তির দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।

সেমিনের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় আসামি হওয়া এবং কারাগারে যাওয়া কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৭ মাস কারাবন্দি থাকা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই আইনের সমস্ত ধারাই খারাপ, নির্মম, নির্দয়, মানবাধিকার পরিপন্থী। সেইদিন আমাকে কর্মস্থল থেকে তুলে নেয়া হয়েছিল।”

রাজবাড়ীর সোনিয়া আখতার স্মৃতি বলেন, “সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছি বলে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা করছে। আমাকে রাতে রাজবাড়ীতে থেকে তুলে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা কোথায় রেখেছিল আমি জানি না। আমার দু্ইটা ছোট ছোট বাচ্চা আছে তাদের থেকে নিয়ে তারা আমাকে তুলে নিয়ে ছিল।”

জাহিদ হাসান নামে একজন বলেন, “এই আইনে গুমের পর কিংবা তুলে নেওয়ার পর কী যে অত্যাচার করা হয়, যা আমি বলে শেষ করতে পারব না। আমাকে গুম করেছে আমার কী অপরাধ ছিল? আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু লিখতাম, ব্লগিং করতাম… এই যা।”

মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ বলেন, “আমি শুধু সোশ্যাল মিডিয়া একটু বক্তব্য দিয়েছিলাম, আবেগ থেকে একটু কথা বলেছিলাম সেজন্য আমাকে তুলে নিয়ে গেল।

“আমাকে র‌্যাব অফিসে নিয়ে একের পর এক ইন্টারোগেশন করেছে তার বর্ণনা দিলে শিহরিত হয়ে উঠতে হয়। আমি এখানে তা বলতে চাই। আমাদের রিমান্ডের পর জেলে পাঠানো হয় সেখানে আমাকে কম্বল-বালিশটা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এই হচ্ছে আমাদের স্বাধীন দেশ।”

দীর্ঘদিন ‘নিখোঁজ’ থাকা দৈনিক পক্ষকালের সস্পাদক আলোকচিত্রী শফিকুল ইসলাম কাজল বলেন, “বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন? আমার মনে হয়, গণমাধ্যম এখন মৃতপ্রায়। ৫৩ দিন গুম হওয়াকালে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি, কোথায় আছি, কেমন আছি…।

“আমার চোখ বন্ধ ছিল। আমি ক্রসফায়ারারে মুখোমুখি হয়েছি। অভিযোগ ছিল, আমি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লিখেছি। হয়ত লিখেছি.. এটা আমার অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার। তাই বলে গুম করে নেওয়া হবে, ক্রসফায়ারের নেওয়া হবে, জেল খাটতে হবে।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, গণঅধিকার পরিষদের ড. রেজা কিবরিয়া, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, এনডিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুতফর রহমান সেমিনারে বক্তব্য দেন।