দলটির দর্শন, ইশতেহার, সাংগঠনিক কাঠামো, গঠনতন্ত্র সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির মাঠে তাদের কর্মকাণ্ডই বলে দেবে কতটা টেকসই দল তারা হয়ে উঠবে।
Published : 02 Mar 2025, 02:34 AM
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মত ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বা বামপন্থিদের মত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়নি জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতাদের নিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
ডান, বাম ও বিভিন্ন মত, ধর্ম ও পথের তরুণদের সামনে রেখে ভোটের রাজনীতিকে লক্ষ্য ধরে মাঠে নামা দলটি ‘ন্যায় ও সমতার’ ভিত্তিতে ‘বহুত্বপূর্ণ’ সমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। তারা নতুন স্বাধীনতার কথাও বলেছে।
এনসিপি ‘সেকেন্ডে রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা ও গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান রচনার সংকল্প তুলে ধরেছে, যা নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতুহল তৈরি হয়েছে।
দেশে মধ্যপন্থি এত দল থাকতে একই লক্ষ্যে যাত্রা করা তরুণদের এই দলটি দেশের মানুষের কাছে কতটা আবেদন তৈরি করতে পারবে, সে প্রশ্নও রয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নিয়ে এখনই বিস্তারিত বলার সময় আসেনি। কারণ দলটির দর্শন, ইশতেহার, সাংগঠনিক কাঠামো, গঠনতন্ত্র সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া যায়নি।
এছাড়া রাজনীতির মাঠে বহু নতুন বিষয় আসবে, সেসব নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ডই বলে দেবে এনসিপি কতটা টেকসই দল হয়ে উঠবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু তারা দুটি বিষয়ের কথা বলেছে- সেকেন্ড রিপাবলিক এবং মধ্যপন্থা। এ মধ্যপন্থা আসলে আদর্শগত মধ্যপন্থা কিনা সেটি স্পষ্ট করেনি।”
গতবছর জুলাই-অগাস্টের প্রবল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান।
ক্ষমতাচ্যুত দলটির শীর্ষ সারির নেতাদের কেউ কেউ ধরা পড়েছেন, অনেকে বিদেশে কিংবা আত্মগোপনে চলে গেছেন।
আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন। দলটির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দুই-একটি দলের শীর্ষ নেতাও গ্রেপ্তার হয়েছেন। মিত্র দলগুলোর প্রায় কোনোটিই আর মাঠে সক্রিয় নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটল। তার সঙ্গে আছেন আন্দোলন পরিচালনার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠন করা ছাত্রশক্তির নেতা ও ডাকসুর সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক আখতার হোসেন।
রাজনৈতিক দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নাহিদ ইসলাম তথ্য উপদেষ্টার পদ ছেড়ে এলেও সরকারে রয়ে গেছেন আন্দোলনে তার দুই সঙ্গী আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম।
শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউতে এনসিপির আত্মপ্রকাশ মঞ্চে দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, “আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।”
বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি ‘বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণকে’ লক্ষ্য হিসেব নেওয়ার কথা তুলে ধরেন দলটির আহ্বায়ক।
এনসিপির সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলছেন।
পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের শূন্য জায়গা এনসিপির পক্ষে দখলে নেওয়া সম্ভব হবে কি না, সে প্রশ্নও থাকছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপি যদি সবাইকে নিয়ে রাজনীতি করতে চায়, তাহলে দলটির সম্ভাবনা আছে।
তারা এটাও বলছেন, দেশে মধ্যপন্থি তকমার কোনো দলই মধ্যপন্থায় থাকতে পারেনি। হয় ডানে না হয় বামে ঝুঁকেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আমেনা মহসিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনি যখন বাস্তবিক মাঠে নামবেন তখন কিন্তু রিয়েলিটি বদলে যায়। মানে তখন প্র্যাগমেটিক হতে হয়, একটা পপুলার অ্যাপিল আনতে হয়।
“এবং সেটার একটা ক্রেডিবিলিটি, একসেপ্টেবিলিটি… সেই জায়গাগুলো আসে। সেটা ইডিওলজিক্যাল পার্টি না। ওরা সেক্যুলার পলিটিক্স… ধরেন বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ওরকমই দল।”
দেশে ডান ও বাম ধারার রাজনৈতিক দল রয়েছে; আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মত দলের মধ্যপন্থি রাজনীতির বয়ান দিয়ে দীর্ঘ শাসনের অভিজ্ঞতা পেয়েছে সাধারণ মানুষ।
এর সঙ্গে বিভিন্ন শাসন আমলে বিরোধী মতের ওপর চালানো নির্যাতন, দুর্নীতি আর অপশাসনে জনগণকে চিড়েচ্যাপ্টাও হতে দেখছে বাংলাদেশ।
এমন বাস্তবতায় নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে গণফোরাম, কিংবা ২০১৮ সালে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের আন্দোলনের অনুপ্রেরণা নিয়ে গঠিত গণঅধিকার পরিষদসহ আরো বেশ কয়েকটি দল মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সফল হতে পারেনি।
২০২৪ সালের ৩৬ দিনের গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসন ধসিয়ে দেওয়ার সাহস নিয়ে গঠিত এনসিপি মধ্যপন্থার রাজনীতির কথা বললও দলটির যাত্রা কতটা মধ্যপন্থায় থাকবে তা নিয়েও সরব রাজনৈতিক অঙ্গন।
দল ঘোষণার পর প্রথম দিনই এনসিপির ১৫১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে মুনতাসির রহমান নামে এক এলজিবিটিকিউ সমর্থকের পদ পাওয়া নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে নেতাদের।
দলটির আত্মপ্রকাশের পর যে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে, তা হল- তাদের মূল নেতৃত্বে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘নগণ্য উপস্থিতি’।
‘ইনক্লুসিভ’ বাংলাদেশ গড়ার ও বৈষম্যের অবসান ঘটানোর কথা বললেও এনসিপির কমিটিতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব না থাকার বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মধ্যপন্থা বলতে নট রাইট, নট লেফট। একমোডেটিভ। এই দলটি কেমন তা বুঝতে আরও সময় লাগবে।
“এখন এলজিবিটিকিউ সামনে এসেছে। তাদের এখানে নারী ও পুরুষের সম্পদের বণ্টনের হিসাব সামনে আসবে। এখানেই শেষ না। তাই তখন বলা যাবে, এত আর্লি না।”
এনসিপি গঠন হল যেভাবে
‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ প্রতিশ্রুতি নিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের কাতারের নেতাদের নেতৃত্বে প্রথমে জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে একটি সংগঠন করা হয়। এর পর রাজনৈতিক দল গড়ার বিষয়টি তারা সামনে আনে।
কমিটি করার সময়ই মধ্য, ডান, বাম, জামায়াতে ইসলামী সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির, কওমিপন্থি, আদিবাসী ও নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।
সংখ্যালঘু ও নারীদের উপস্থিতি কম থাকলেও এনসিপির উদ্যোগের মূল কেন্দ্রে সাবেক শিবির নেতৃবৃন্দের একটি বলয় যুক্ত থাকার বিষয়টি তাদেরই সামাজিক মাধ্যমের আলোচনায় উঠে আসে।
পরে রাজনৈতিক দল গড়ার সময় শিবিরের সেই বলয়ের বাইরে কমিটি হলেও নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তাদের অনেকের শিবির সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিভিন্ন মহলে আলোচিত।
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা আংশিক আহ্বায়ক কমিটিতে মধ্য, ডান, বাম, শিবির, কওমিপন্থি ও আদিবাসী প্রতিনিধির পাশাপাশি ১৫ জন নারী স্থান পেয়েছেন।
আহ্বায়ক কমিটি শীর্ষ দশ পদে আছেন আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিভা, প্রধান সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ ও মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।
সাবেক গণ অধিকার পরিষদ, ছাত্র শক্তি, ছাত্র ফেডারেশন, রাষ্ট্রচিন্তা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং আগে কোনো দল না করাদের নিয়ে এ দশজন সাজানো হয়েছে।
আহ্বায়ক কমিটিতে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা অনিক রায়, কওমি ঘরানার আলেম ও ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নাতি আশরাফ উদ্দীন মাহদী, আদিবাসী অলিক মৃ, দলিত সম্প্রদায়ের কৈলাস চন্দ্র রবিদাস ও ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক দুই সভাপতিসহ শিবিরের সাবেক চারজন এ দল থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলেও এতে জায়গা পেয়েছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিবির সেক্রেটারি। একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরও আছেন কেন্দ্রীয় এই কমিটিতে।
রাজনীতিতে কতটা আবেদন তৈরি করতে পারবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা কেমন প্রভাব ফেলবে সেটি আসলে এখনো একেবারে প্রারম্ভিক একটা জায়গায় রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা তাদের কাজও দেখিনি, পরিধিও দেখিনি।”
দলটির সূচনা থেকে নানারকম দ্বন্দ্ব, বিরোধ ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার অভিযোগ সঙ্গী হয়েছে; সে বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “দলটির কর্মসূচি, কর্মপদ্ধতি এবং তাদের কর্মকাণ্ড না দেখলে বলা যাবে না যে দলটি বিরাজমান রাজনীতির উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে।”
নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশা কী, এ প্রশ্নে জোবাইদা নাসরিন বলেন, “বিরাজমান রাজনৈতিক দলগুলো যেমন- আওয়ামী লীগ, বিএনপি এগুলোর প্রতি মানুষের এক ধরনের তেতো অভিজ্ঞতা হয়েছে। সে জায়গা থেকে এর বাইরের দলের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকতে পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক।
“কথা হল যে কোনো দলকেই জনমুখী হতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। জনগণের নির্ভরতার জায়গা তৈরি করতে হবে। সে জায়গা থেকে ছাত্রদের দলটি কতটা জনমুখী হবে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আমলে নেবে, সেটি আমার মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই এনসিপি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকবে কি না সেটি বিবেচিত হবে।”
বাংলাদেশে দুই ধরনের রাজনৈতিক দল আছে– এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি হল নির্বাচনমুখী, আরেকটা হল মাঠে থাকা দল। এনসিপি নির্বাচনকেন্দ্রিক হলে তাদের একক নির্বাচন করার অবস্থা থাকবে কি না, সেটা আইনগতভাবে এবং দলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিদ্যমান আইনে একক দল হিসেবে সামনে যে নির্বাচন সেটা আইনগতভাবে এবং দলের ভিত্তি অনুযায়ী তাদের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করেন এই রাজনীতি বিশ্লেষক।
নতুন দলের সংগঠক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপের প্রসঙ্গে টেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আমেনা মহসিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওরা আমাকে ইতিবাচক ধারণা দিয়েছে। ওরা বলছে, যারা তরুণ তারা সাধারণ মানুষের পাল্স ফিল করতে পারে। এবং তাদের মধ্যে (শিক্ষার্থীদের) এ ধরনের একটা ধারণা যে যারা মেইনস্ট্রিম পার্টির লিডারশিপে আছে, তারা বিচ্ছিন্ন থাকে সাধারণ মানুষ থেকে।
“তারা ইয়াংদের কথা শুনতে চায় না, তাদের সাইকোফ্যান্সি (তোষামোদ পাওয়ার প্রবণতা)- এগুলো এসে যায়। এগুলো এদের মধ্যেও আসতে পারে। এটা এমন না যে আসবে না, তা আমরা বলতে পারি না।”
সবাইকে নিয়ে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে করা রাজনীতিই নতুন দলকে কেবল টেকসই করতে পারে বলে মনে করেন আমেনা মহসিন।
তার ভাষায়, “আমি বলতে চাই, আপনি যদি রাজনীতিতে সারভাইভ করতে চান, নিজেকে ক্রেডিবল ফোর্স হিসেবে দাঁড় করাতে চান, তাহলে সবাইকে নিয়ে, ইনক্লুসিভ হয়ে আপনাকে এগোতে হবে। বরং আমি এটাকে পজিটিভ দিক হিসেবে দেখি।
“আপনি যদি রাজনৈতিক ধারার মধ্যে এসে যান, তখন কিন্তু আপনাকে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হবে। নিজেকে সাসটেইন করার জন্য।”
জানিপপ চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ তরুণদের আরও দল সামনে আসার সম্ভাবনার কথা বলেন।
তিনি বলেন, “এখন যে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তাতে সামনে আরও দল আসবে। এখন একটি দল প্রকাশ্যে এল। আরও দল আসবে।”
কলিমউল্লাহর ভাষায়, এ দলটি কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে তা তারা সামনে বিভিন্ন বিষয় কীভাবে সামলাবে তার ওপর নির্ভর করে।
“আমার মনে হয় না, বাংলাদেশের কোন দল মধ্যপন্থার রাজনীতি করে। হয় তারা ডান নয়ত তারা বাম। সবাইকে একমোডেট করে রাজনীতি করে না।
“এই দলটি সামনের দিনে সেসব বিষয়ে কীভাবে সামলাবে তার ওপর বলা যাবে এ দলটি কোন ধারার এবং তখন বোঝা যাবে তাদের প্রভাব কতটুকু রাখতে পারছে।”
সামনে আরও দল আসার ইঙ্গিত মেলে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সংগঠক নাইম আহমাদের ফেইসবুক পোস্টেও।
শিবিরের এ নেতা জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের দিন নিজের ফেইসবুক পেইজে লেখেন, “আমি আমার সাংগঠনিক যোগাযোগের সক্ষমতার ওপর আস্থা রাখি। জুনায়েদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাবেক সভাপতি আলী আহসান জোনায়েদ) ভাই দেশে ফেরার পর, যদি তিনি নির্দেশনা দেন, আমি আমার সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা উজাড় করে দেব।”
তিনি লিখেছেন, “মোট ৫২০ জন সংগঠককে ভাইয়ের সাথে কানেক্ট করতে চাই। এটা মিনিমাম। আমি বিশ্বাস করি অল্প সময়ের মধ্যেই আমি এটি বাস্তবায়ন করতে পারব। এজন্য আপনাদের সার্বিক সহায়তা প্রয়োজন। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, সময় খুবই কম! দেশের ৬৪টি জেলা ঘুরে কাজ করতে চাই!”
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক পদে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আলী আহসান জোনায়েদের নাম আলোচনায় ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, তিনি নতুন দলে থাকছেন না।
জোনায়েদের এই পোস্ট ফেইসবুকে শেয়ার করে রাফে সালমান রিফাত (ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আরেক সাবেক সভাপতি) লিখেছেন, তিনিও নতুন দলে থাকছেন না।
শিবিরের আরেক সাবেক নেতা আরেফীন মোহাম্মদ হিযবুল্লাহও নতুন দলে থাকছেন না বলে জানা গেছে। হিযবুল্লাহ ইতোমধ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির সহমুখপাত্র পদও ছেড়েছেন।
যা বলছেন অন্য দলের নেতারা
‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’ বিলোপের মাধ্যমে ‘অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের’ এনসিপি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা এবং নতুন সংবিধান রচনা করার ঘোষণা দিয়েছে।
দল গঠন, সরকারের তরফে সহযোগিতা মেলার অভিযোগ, গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততাসহ নানা সমালোচনার মধ্যে এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটে; এর মধ্যে গণপরিষদ নির্বাচন চাওয়া ও নতুন স্বাধীনতার কথাও আসে ছাত্র নেতাদের তরফে।
গত অক্টোবরে সামনে আনার পর ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণাটি এবার এনসিপির ঘোষণাপত্রে এল, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
তার ভাষ্য, ‘‘গণপরিষদ কেন হবে? এর মধ্যে তো আরও একটি উদ্দেশ্য আছে।
“যারা গণপরিষদের বিষয় সামনে আনছে, যারা সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয় সামনে আনছে, হয় তারা বোঝে না, অথবা বোঝে, আমাদের এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আরো দীর্ঘায়িত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র আছে।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাল তারা (এনসিপি) যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা সেখানে নতুন স্বাধীনতার কথা বলেছে। নতুন করে সংবিধান লেখার কথা বলেছে। নতুন স্বাধীনতা মানে কী? স্বাধীন তো একটা দেশ একবারই হয়।
“আমরা তো স্বাধীন দেশেই আছি। নতুন স্বাধীনতা মানে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধকে নাকচ করে দিয়ে করতে চায়। তারা সেই বয়ানটাকে সামনে আনবে কি না সেটি জানতে চাই।”
গত ২৯ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ওই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি দিয়ে সে দিন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নাৎসি বাহিনীর মত অপ্রাসঙ্গিক এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে।”
এনসিপির ঘোষণাপত্রে নতুন সংবিধান রচনার বিষয়টির সমালোচনা করে সিপিবি নেতা প্রিন্স বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ভিত্তি যথাযথ বলে মনে করেন তারা।
তিনি বলেন, এই সংবিধানের অসম্পূর্ণতা আছে, এটা আমরা ৭২ সালেই বলেছি। যার জন্য এটা সংস্কার করে অসম্পূর্ণতা দূর করতে চাই। কিন্তু, যে নতুন সংবিধান লেখার কথা বলা হচ্ছে এ ব্যাপারে তারা (এনসিপি) কী বলতে চায়, সেটা আমরা জানতে চাই।”
নতুন দলটি গণপরিষদ নির্বাচন এবং অন্যান্য বিষয়ে যে কথা বলছে তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে মনে করেন প্রিন্স।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে অতিথির চেয়ারে থাকা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “বর্তমান গণতান্ত্রিক মুক্ত পরিবেশে যখন দেশটি সংস্কার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের পথে হাঁটছে তখন তরুণদের এ দলটির আগমনকে আমরা স্বাগত জানাই।”
তার ভাষায়, “দীর্ঘ দিন রাজনৈতিক ময়দানে রাজনীতির যে তিক্ত অবস্থা ছিল, মারামারি, হানাহানি ছিল তা মুক্ত রাখতে এ দলটি অবদান রাখবে।”
এ ধারা বজায় রাখতে পারলে তরুণরা সচেতন ও শিক্ষিত সমাজে প্রভাব রাখতে পারবে বলেও মনে করেন গোলাম পরওয়ার।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব পদে মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, “এখনই তাদের সফলতা বা ব্যর্থতার সম্ভাবনা বা শঙ্কা মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না।
“তবে তারা যদি সদিচ্ছা ও সাহস নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং তাদেরকে সকল দল সহযোগিতা করে তাহলে সফল হবে।”
এনসিপির মধ্যপন্থি রাজনীতির বিষয়ে তার দলের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সবসময় ইসলাম, দেশ ও মানবতার কথা বলে। এ স্বার্থের জন্য যদি কোনো দল কাজ করে আমরাও তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। এর বিপরীতে কেউ গেলে তার সঙ্গে আমরা নাই।”
শুরুতেই ধাক্কা ‘এলজিবিটিকিউ’
নতুন রাজনৈতিক দলের কমিটিতে মুনতাসির রহমান নামে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যিনি ‘এলজিবিটিকিউ সমর্থক’– এমন খবর দিয়ে শুক্রবার রাত থেকেই সামাজিক মাধ্যমে কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর শনিবার সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের দায়িত্ব পাওয়া দুই মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম।
একই বক্তব্য দুইজনই তাদের নিজেদের ফেইসবুক আইডিতে পোস্ট দেন। তাতে লেখেন, “রাজনীতির আগেও আমার পরিচয়, আমি একজন মুসলমান। আমি আমার এই পরিচয় ধারণ করি, সবসময় করেই যাব।
“আমার বিশ্বাসকে কিংবা আমার দেশের মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত করে কোনো রাজনীতি আমি কখনও করব না। স্পষ্ট কণ্ঠে জানিয়ে দিতে চাই, ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থি কিছুই আমার বা আমাদের রাজনীতিতে কখনও জায়গা পাবে না।”
যা হয়েছে, সেটা একটি ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ ছিল দাবি করে তারা লেখেন, “আমরা নির্ভুল নই। কোনো ভুল করলে আপনারা আমাদের নিজের ভাই মনে করে ভুল ধরিয়ে দেবেন, এবং ‘যদি’, ‘কিন্তু’, 'অথবা' ব্যতীত আমরা আমাদের ভুল সংশোধন করে নেব।”
তাদের এ পোস্ট শেয়ার করে দলের অন্য নেতাদেরও নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করতে দেখা যায়।
মুনতাসির রহমান জুলাই আন্দোলনের সময় ‘সেইফ হোম’ জোগাড় করে দেন বলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মাহিন সরকার তুলে ধরেন।
ফেইসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, “মুনতাসির ভাই আমাদের সেফ হোমের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু উনার এমন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত নই। আল্লাহর কসম! বঙ্গদেশে আমরা সমকামিতাকে চাই না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা তরুণ গবেষক মীর হুযাইফা আল মামদূহ এ বিষয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহর উদ্দেশে বলেন, “তাহলে পার্টির নাম জাতীয় মুসলিম পার্টি রাখলেই হইত! নাগরিক রাখার ভান করার কী দরকার ছিল মিয়াভাই?”
তার নিজের ফেইসবুক আইডিতে দেওয়া পোস্টে এনসিপির রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “অথচ আমাদের দরকার ছিল এমন রাজনীতি, যেখানে কাণ্ডারি বলবেন, আমার ধর্মবিশ্বাস এই- কিন্তু আমার রাজনীতি কোনো ধর্ম কিংবা বিশ্বাসের কাছে নতজানু হবে না। বরং প্রতিটা প্রাণ ও প্রকৃতির পক্ষে থাকবে, তার বিশ্বাসের ভিন্নতা মেনে নিয়েই।”
মীর হুযাইফা আল মামদূহ জুলাই আন্দোলনে প্রথম থেকে সক্রিয় ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারো ব্যক্তিগত জীবন বা মতাদর্শ নিয়ে কোন সাংগঠনিক বক্তব্য আমি দিতে চাই না। আর আমাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয়নি।”
শুরুতেই সমালোচনার ধাক্কা
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য পিরোজপুর থেকে আসার জন্য বাস ‘রিকুইজিশন’ করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিত প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম দাবি করেছেন, এ ব্যাপারে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।
তবে বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা বলেছে, “এনসিপির জন্মলগ্নেই এরূপ ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিকতার দায় অন্তর্বর্তী সরকার এড়াতে পারে না।”
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’-এর ব্যানারে এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী পুরোনো চর্চা পরিহার করার জন্য এনসিপি, তার সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকদেরকে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।