‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’ বিলোপের মাধ্যমে নতুন ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ তৈরিতে কাজ করবে নবগঠিত এ কমিটি।
Published : 14 Sep 2024, 11:20 PM
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশ পুনর্গঠনে সব রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য তৈরিতে কাজ করতে চায় নবগঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি।
শনিবার বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক কমিটি এমন অভিপ্রায় তুলে ধরে।
কমিটির তরফে বলা হয়, তারা এমন এক ঐক্য গঠন করতে চায়, যেই ঐক্যের উপর দাঁড়িয়ে শোষণহীন, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমীন বলেন, “স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমাদের মধ্যে কোনো ইস্যুতেই জাতীয় ঐক্য নেই। সকল কিছু নিয়েই আমরা দ্বিধা-বিভক্ত। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো প্রাথমিক রাষ্ট্রীয় কাজও এখানে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখনও ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করতে পারেনি। পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কী প্রক্রিয়ায় তা নিয়েই এতদিনে কোনো ঐক্যে পৌঁছানো যায়নি।”
ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়েছে কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার এখনও বিলোপ হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদ স্রেফ একটি সরকার নয়। এটি একটা ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন আইন, প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক চর্চার মাধ্যমে টিকে থাকে। আমরা সেই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ চাই।
”ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরিতে কাজ করবে নাগরিক কমিটি। এমন একটি বন্দোবস্ত আমরা তৈরি করতে চাই যাতে সামনের দিনে কোনো সরকারপ্রধানকে শেখ হাসিনার মত পালিয়ে যেতে না হয়।“
সংবাদ সম্মেলনে কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন বক্তব্য রাখেন।
রাষ্ট্র পুনর্গঠন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও ‘নতুন বাংলাদেশের’ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সফল করার লক্ষ্যে গত ৮ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করে এই নাগরিক কমিটি।
৫৫ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এবং সদস্য সচিব গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক আখতার হোসেন।
শনিবার সংবাদ সম্মেলেন নাগরিক কমিটি ঘোষিত ৮ দফা বাস্তবায়নে শিগগির সারাদেশে জনসংযোগ কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়।
সংগঠনের সদস্য সচিব আখতার হোসেন সংবাদ সম্মেলনে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ এর কার্যক্রম ও কমিটি স্থগিত করার কথা তুলে ধরে বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। আন্দোলন শুরুর পর থেকে ছাত্রশক্তি স্বনামে আর কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেনি এবং আমাদের ফেইসবুক পেইজেও কোনো অ্যাক্টিভিটিজ ছিল না। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি এই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
“গণঅভ্যুত্থানের পরে ছাত্রশক্তির দুজন দায়িত্বশীল- কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব নাহিদ ইসলাম ও ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হন। একই সাথে ছাত্র রাজনীতির রূপরেখা কী হবে তা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে আমরা অভ্যন্তরীণভাবে সিদ্ধান্ত নেই যে, ছাত্রশক্তির সকল কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হবে এবং কার্যক্রম স্থগিত করা হবে। সেই জায়গা থেকেই আমরা সকল কার্যক্রম স্থগিত করি।”
নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব তার দায়িত্ব পালনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ছাত্রশক্তি ডিজলভ হয়ে গেছে, ছাত্রশক্তি স্থগিত হয়ে গেছে।”
আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, “আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন। তাদের যে স্বপ্ন সেটা বাস্তবায়ন করতে সময় দিতে হবে। সরকারকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি পর্যালোচনাও করতে হবে। তাদের বিষয়ে পর্যালোচনা আমরা জারি রাখব। তাদের কার্যক্রম শুরু হলে আমরা দেখব, এরপর কাজের পর্যালোচনা করে একটা সময় বেঁধে দিব।”
সংগঠনের কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে মুখপাত্র সামান্তা শারমীন বলেন, “২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে আরেকটি সুযোগ এসেছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায়গুলোকে একত্রিত করেই আমরা আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করব। নতুন বন্দোবস্তে আমরা সকল রাজনৈতিক পক্ষকে সাথে নিয়ে তৈরি করতে চাই। বন্দোবস্ত তৈরিতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মতামত নেওয়ার কাজও করবে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
“৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় মব জাস্টিস হতে দেখছি। মন্দিরে, মাজারে, বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিগত পূর্ব শত্রুতার জের ধরেও আক্রমণ হতে দেখছি। এ ঘটনায় আমরা নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।”
যেকোনো ইস্যুতে সরকারের তৎপরতা খুবই মন্থর ও ধীরগতির বলে তুলে ধরে তিনি বলেন, “সরকারকে মনে রাখতে হবে- তারা গণঅভ্যুত্থানের সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে যদি তারা ধারণ করতে না পারে তা হবে দেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। মন্দির-মাজার যারা ভাঙছে তাদের বিরুদ্ধে এখনো কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে না এই প্রশ্ন আমরা সরকারের কাছে রাখছি।”
তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত গণ আন্দোলনে নিহতদের তালিকা সম্পূর্ণ করার দাবি জানিয়ে বলেন, “অনেক আহতরা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। প্রতিদিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর আসছে। সরকারের অবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”
নাগরিক কমিটি রাজনৈতিক দল নয়, তরুণদের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া একটি প্ল্যাটফর্ম দাবি করে সামান্তা শারমিন বলেন, ”আমরা বাংলাদেশকে গড়তে তরুণসহ সকল নাগরিককে এই প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করতে চাই। রাষ্ট্র পুনর্গঠনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চাই। মানুষের গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবতায় পরিণত করতে চাই।
“এরই মধ্যে সংস্কারের লক্ষ্যে ৬টি কমিশন গঠন করেছে সরকার। আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত একত্রিত করে প্রস্তাবনা তুলে ধরব কমিশনের কাছে। আমরা চাই কমিশনগুলো তাদের কাজের সময় আন্দোলনরত সকল শক্তিকে সাথে নিয়ে কাজ করবে। যেন ঐক্যমত্যের মধ্য দিয়ে এসব সংস্কার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।”