‘শেষ মিথ্যে’ বলে কিছু নেই

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 28 June 2021, 08:22 PM
Updated : 28 June 2021, 08:22 PM

জার্মানির সাবেক একনায়ক ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হোতা অ্যাডলফ হিটলারকে মানুষ যেমন মনে রেখেছে, তেমনি গোয়েবলস এর কথাও মনে রেখেছে। হিটলারের পক্ষে গোয়েবলসের প্রচারণার যে কৌশল ছিল আজও তা নাকি নজীরবিহীন। সে মিথ্যাকে এমনভাবে প্রচার করতো মানুষ নাকি শেষমেষ মিথ্যাকেই সত্য বলে ধরে নিত এবং বিশ্বাস করতো। যেকোনও কিছুকে বিশ্বাস করানোই কঠিন বা আসল। সেটা প্রেম, প্রতারণা কিংবা ব্যবসা বা অন্য কিছু যা-ই হোক।

কোন মানুষ মিথ্যে বলছে কিনা সেটা কী আগে থেকে বিন্দুমাত্র টের পাওয়া সম্ভব? নাকি মানুষ মিথ্যে বলায় বেশি দক্ষ, মিথ্যা নিরূপনে খুব দুর্বল? আমরা জানি, বেশিরভাগ মানুষ প্রয়োজন, অপ্রয়োজন কিংবা টিকে থাকার জন্য মিথ্যে বলে। 

মিথ্যে বলাও নাকি এক ধরনের প্রতারণা। প্রিয়তমা চুল কেটে আসার পরে জানতে চায় কেমন লাগছে? সরাসরি কয়জন বলতে পারে- ভালো না! শিক্ষক কিংবা অফিসের বসের পোশাক ভালো না লাগলেও কয়জন সরাসরি বলে? উল্টো হয়তো বলে- –বস ইউ আর লুকিং ড্যাম স্মার্ট! এ বলায় মিথ্যাও আছে, হয়তো তেলও আছে। 

পুরুষ কখন বেশি মিথ্যে বলে বা প্রতারণা করে? যখন সে আসলে প্রেম করতে চায়। ঋণ নেওয়ায় সময়ও মানুষ বেশি মিথ্যে বলে কিংবা কাঁদে। আদিকাল থেকে মানুষের এ স্বভাব বহাল আছে। এটা ঐতিহ্যবাহী। 

বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণার ফলে দেখা যায় শুধু মানুষ নয়, পশু,পাখি এমন কী মাছের ভেতরও মিথ্যা বলার এ প্রবণতা আছে। মানুষ যেমন প্রেমের সময় অনেক কিছু বাড়িয়ে বা মিথ্যে বলে থাকে তেমনি পশু-পাখিও একই কাজ করে। পাখি হয়তো শরীরের এক অংশে উত্তেজনা জমিয়ে যেভাবে ডাকে, শরীরের অন্য অংশে সে উত্তেজনা বা গলাতে সে একই আবেগ রাখে না। সেই আবেগ হয়তো সে অন্য সঙ্গীদের জন্যও তুলে রাখে কিছু। পশু কিংবা মাছও তাই। এক সঙ্গীর কথা এরা অন্য সঙ্গীদের কাছে আড়াল রাখে। সিংহ কবে একজন সিংহীর ডাক পাবে সে নিজেও জানে না। তাই ডাক পাওয়ার জন্য তাকে হয়তো অনেক কিছু করতে হয়। ভালোবাসাটা পাওয়াই হয়তো জরুরী। ভালোবাসা বা প্রেম শারীরিক কিছু অভ্যাসও তৈরি করে। সঙ্গীর সাথে ছাড়াছাড়ি হলে এ অভ্যাস মানুষের মতো পশু, পাখি বা মাছকেও ভোগায়। নতুন করে সঙ্গী পেতে তাই আসল প্রেমের সাথে খানিক মিথ্যে বা প্রতারণাও ফিরে আসে। তবে কেউ কেউ মিথ্যে বা প্রতারণাকে শিল্পে পরিণত করতে জানে।

যেমন ধরুন মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব ওরফে নটবরলাল এর কথা। অনেকেই তার সম্পর্কে শুনেছেন, লেখা পড়েছেন বা তাকে নিয়ে হওয়া সিনেমাও দেখেছেন। কীভাবে নটবরলাল মিথ্যেকে সত্যি বলে উপস্থাপন করতেন? কীভাবে তিনি প্রতারণাকে 'শিল্পে' রূপ দিতে পারতেন? তিন তিনবার তাজমহল বিক্রি করা চাট্টিখানি কথা? তাজমহল তিনবার বিক্রির পাশাপাশি হরহামেশা ছদ্মবেশও ধারণ করতে পারতেন। তার আটচল্লিশটির মতো ভিন্ন পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছিল পুলিশ। লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন এমনকি ভারতের সংসদ ভবন বিক্রি করে দিয়েছিলেন সব সংসদ সদস্যসহ! শিল্পপতিদের সই নকল করতে পারতেন। জেল থেকে পালাতে পেরেছিলেন অভিনবভাবে। ব্যাগভর্তি টাকার কথা বলে জেলরক্ষীদের সাহায্য নিয়ে পালান। পরে জেলরক্ষীরা টের পায় ব্যাগ ভর্তি পত্র-পত্রিকা ছাড়া আর কিছু নেই। দশবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নটবরলাল, শেষবার যখন গ্রেপ্তার হন তখন তার বয়স ৮৮। এরপরও নাকি হুইলচেয়ারে করে জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন। জেল পালানো ও তার মৃত্যর ঘটনা এখনও রহস্য হয়ে আছে।

নটবরলালের মতো আরেক প্রতারক বা শিল্পিত মিথ্যুকের নাম কাউন্ট ভিক্টর ল্যাস্টিগ। সেও আইফেল টাওয়ার দুই-দুইবার বিক্রি করে দিতে পেরেছিল। কীভাবে কোটিপতিদের মুগ্ধ করতো ল্যাস্টিগ সেও এক রহস্য। সাতচল্লিশটা পরিচয় ছিল ল্যাস্টিগের, পাসপোর্ট ছিল অনেকগুলো। টাকা ছাপানোর কৌশলও জানতো সে। পাঁচটি ভাষায় কথা বলতে পারতো এ ল্যাস্টিগ, অনেক নারীর হার্টথ্রব ছিল সে। আসলে প্রেম ও প্রতারণা অনেক সময় সমান্তরালভাবে হাটে। ল্যাস্টিগকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল, পরে সে ফ্রান্স থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল।

নটবরলাল বা ল্যাস্টিগদের দিন ফুরোলেও কোন না কোনভাবে প্রতারণা চলছেই। ভারতের একটা আলোচিত প্রতারণা হচ্ছে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তি বিক্রির প্রচেষ্টা। ভারতের বিজেপি সরকারের আমলে গুজরাটের এক নদীর তীরে বানানো এ মূর্তি নিলামে তুলতে চেয়েছিল এক ভারতীয়। বিজ্ঞাপন দিয়েছিল এমন- 'করোনার জন্য হাসপাতাল বানাতে প্রচুর টাকা দরকার। বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তিটি নিলামে তোলা হবে'! পরে এই প্রতারককে গ্রেপ্তার হতে হয়।

বাংলাদেশেও প্রতারণা বা প্রেমের ঘটনা কম নেই। ধরুন এ করোনাকালে কেউ আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসলো। বাসায় এসে করোনার নমুনা নিয়ে গেল। সাথে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকাও নিয়ে গেল। তারপর আপনার নমুনা পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল। যার হয়নি সে নকল করোনায় ভুগলো, আর যার হয়েছিল সে হয়নি ভেবে স্বাভাবিক জীবন যাপনে গিয়ে আরও অনেককে অসুস্থ করে তুললো। জেকেজি হেলথ কেয়ার (জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা) এর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের এক আলোচিত ঘটনা। গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল এ প্রতিষ্ঠানের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীকে। এদের প্রতিদিনের আয় ছিল কয়েক লাখ টাকা।

প্রেমের ঘটনাতেও মিথ্যে বা প্রতারণা জড়িত থাকে। বাংলাদেশের এক বিখ্যাত মানুষের বিদেশি প্রেমিকা বা স্ত্রীর কাছে 'হাইকোর্ট ভবনটা'কে নিজেদের বাড়ি বলার গল্প এখনও আলোচিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রেমের টানে 'বিদেশিনী'দের বাংলাদেশে আসার একাধিক গল্প আছে, আবার প্রতারিত হয়েছে ভেবে বিদেশে ফেরত যাওয়ার ঘটনাও কম নেই। আসলে গানের মতো জীবন সবসময় হয় না। যেমন- ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও আমার শিউলি নাও/ দুজনে অমর প্রেমে হই ঋণী।

সব প্রেম অমর হয় না। লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, সোনালী-ত্রিস্তান কিংবা রোমিও-জুলিয়েটদের প্রেম কাহিনী ভেঙ্গে সারা পৃথিবীতে অসংখ্য ছবি হয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। এমন কী 'দেবদাস' নিয়েও মাতামাতি কম হয় নি। সামান্য কোন মিথ্যেতে পার্বতী যদি দেবদাসের হতো তাহলে দেবদাস বেচারাকে আজীবন মদ খেয়ে পস্তাতে হতো না।

গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের একটি প্রেম ও বিয়ের ঘটনা বেশ আলোচিত হয়েছে। ঘটনাটা এমন-

প্রথমবার মিথ্যে পরিচয়ে বিয়ে করার পর ধরা পরেছেন আবদুল আলীম। বিয়ের আগে বছর খানিক ধরে প্রেমও করেছেন। পাত্রী কলেজ ছাত্রী। আলীম প্রেমিকার কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন পুলিশের 'এএসপি' হিসেবে! পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হবার পর জানা গেল আবদুল আলীম পুলিশের এএসপি নন। তিনি বাদাম বিক্রেতা। মাঝে মাঝে পুলিশের সোর্স হিসেবেও কাজ করেছেন। তাকে বগুড়ার পলাশবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবদুল আলীমের আগের চার বিয়ে সম্পর্কে পুলিশ অবশ্য তেমন কোন তথ্য দেয় নি। ধারণা করা যেতে পারে আবদুল আলীম আগের চার বিয়েতে চারটি ভিন্ন পরিচয় ধারণ করেছিলেন।

আসলে ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত সবাই ভালো বা সৎ থাকে। ধরা পরলেই সব শেষ। তবে গবেষক বা পুলিশদের কাছে মিথ্যেবাদী বা প্রতারকদের ধরার কিছু টিপস আছে। জানি না এসব টিপস কারো কাজে লাগবে কিনা-

এক. মিথ্যেবাদীরা তুলনামূলক কম কথা বলে। তারা মনে রাখার চেষ্টা করে তারা কার কাছে কী বলেছিল। মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে এরা সব কথা বলতে চায় না।

দুই. একাধিক মোবাইল সিম ব্যবহার করে। প্রেম বা প্রতারণার সময়ে সচারচর নিজের বাসা ব্যবহার করে না।

তিন. এরা খুব সময় নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয়। নিজেকে খুব দুঃখী প্রমাণের চেষ্টা করে।

চার. প্রেম চলার সময়ে মূলত প্রেমিক যে খরচ করে সেটার উৎস যাচাই করাটা জরুরি।

পাঁচ. যে কেউ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে অভিভাবকদের জানানোটা অবশ্য কর্তব্য।

এরপরও অনেকেই বাসায়, অফিসে, খেলার মাঠে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রেমিক অথবা প্রেমিকার কাছে মিথ্যে বলবেই। প্রতারণার ঘটনা ঘটবেই। সহজ উপদেশ তাই – করোনার সময়ে যেমন মাস্ক পরে সাবধান থাকেন, ঠিক তেমনি মানুষের মুখোশ থেকে সাবধান থাকুন। 

আর এ গল্পটা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার ভেবে দেখুন-

এক ছেলের নাম আবদুল। তার পাঁচ  পাঁচজন প্রেমিকা। এর ভেতরে দুজন প্রেমিকা জেনে গেল সব। তারা ফুসলিয়ে আবদুলকে দেখা করতে এনে পুলিশের হাতে তুলে দিল। পুলিশ জানতে চাইলো- আবদুল আপনি কয়জনের সাথে প্রেম করেন?

 –  স্যার একজনই। বাকিরা শুধুই বন্ধু!

–  আপনার বাবা কী করেন? কোন মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তা?

 –  জ্বি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।

 –  ঢাকায় বাড়ি কয়টা?

 – বাড়ি না স্যার ফ্ল্যাট। তিন ভাইবোনের তিনটা আর বাবা-মার জন্য একটা।

 – নেশা করেন? মানে মদ, গাজা, ইয়াবা এসব নিয়মিত খান?

 – আল্লাহর কসম না স্যার। 

 – তাহলে আবদুল আপনার কোন বদগুণ নাই বলতে চাচ্ছেন?

 – আছে স্যার। আমি মাঝে মাঝে মিথ্যে কথা বলি!

আবদুলরা ভালো করে জানে যে প্রেম, রাজনীতি আর যুদ্ধে 'শেষ মিথ্যে' বলে কিছু নেই।