চাইলেই কি যেখানে ইচ্ছা বর্জ্য ফেলা যায়!

বিধান চন্দ্র পালবিধান চন্দ্র পাল
Published : 30 July 2021, 08:42 PM
Updated : 30 July 2021, 08:42 PM

 চাইলেই কি যেখানে ইচ্ছা সেখানেই বর্জ্য ফেলা যায় বা আমাদের ফেলা উচিত? দু-একটি স্থানের ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের দেশে গ্রাম কিংবা শহর, নদী কিংবা পাহাড়, রাস্তা কিংবা যানবাহন কিসের কথা বলবো- প্রায় প্রতিটি স্থানেই যেখানে ইচ্ছা সেখানেই যেন মানুষ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ফেলছে। মানুষ এভাবে কেন বর্জ্য যত্রতত্র ফেলছে? এটা কি শুধুই সচেতনতার অভাবের কারণে? না কি আলসেমি? কেন আমরা এভাবে বর্জ্য ফেলছি বা ফেলতে দিচ্ছি?

প্রচলিত সংজ্ঞা অনুসারে বর্জ্য হলো- আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যা ব্যবহার বা ভোগ করার পর অব্যবহারযোগ্য বা আবর্জনা কিংবা ময়লা আকারে থেকে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে বিভিন্ন উৎস থেকে আসা বা উৎপাদিত যেসব পদার্থ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কাজে আসে না সেগুলোই হলো বর্জ্য।

সংজ্ঞা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বর্জ্য হলো সেটাই যা অব্যবহারযোগ্য এবং দৈনন্দিন জীবনে কাজে আসে না। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা যে সকল বর্জ্য ফেলে দিই, তার বেশিরভাগটাই চাইলে আমরা কাজে লাগাতে পারি কিংবা কাজে লাগানো সম্ভব। তাই সাময়িকভাবে এগুলোকে বর্জ্য বলা হলেও এর বেশিরভাগটাই আসলে বর্জ্য নয়- এগুলো সম্পদ। এগুলোর মাঝে লুকিয়ে আছে অমিত সম্ভাবনা। আমরা কি বর্জ্যের মাঝে থেকে সম্পদ আহরণ করতে চাই? আমরা কি সেই সম্ভাবনা ও গুরুত্ব সত্যিই অনুধাবন করতে পারি? বিশ্বাস করি?

বর্জ্য যে সম্পদ সেটা হয়ত অনেকেই জানেন না, অথবা জানলেও সম্পদ করে তুলতে পারে না। এছাড়া সাংগঠনিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে সে ধরনের উপযুক্ত ও যথেষ্ট আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা এখনও আমরা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি। উদাহরণস্বরূপ বর্জ্য থেকে হস্তশিল্প, বর্জ্য দিয়ে সার তৈরি ইত্যাদি সহজেই সম্ভব। যা ব্যক্তি কিংবা পারিবারিকভাবেও স্বল্পসময় ও অর্থ ব্যয়ে করাটা অসম্ভব কিছু নয়। অন্যদিকে বর্জ্য থেকে শক্তি কিংবা বিদ্যুৎ উৎপাদন, বর্জ্য পানিকে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা ইত্যাদির জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা, উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনা ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন।

আমরা কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, বিষাক্ত ও বিষহীন- সাধারণভাবে এ পাঁচ ধরনের বর্জ্যের কথা জানি। বাতাস দূষণ থেকে রক্ষা, সমস্ত জীবকূলকে রোগ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা, পানির দূষণ থেকে সুরক্ষা, জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ সার্বিকভাবে পরিবেশ দূষণ রোধ করার উদ্দেশ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়ে থাকে।

ব্যবস্থাপনা অর্থ ময়লা বা আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনর্ব্যবহার এবং নিষ্কাশনের সমন্বিত একটি পদ্ধতি। যে পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বর্জ্য বস্তুর উৎপাদন কমানো হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ ও সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তিনটি R নীতি: Reduce (কমানো), Re-use (পুনর্ব্যবহার) এবং Recycle (পুনঃচক্রীকরণ) প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু আমরা কি সেটা করছি? করে থাকলে আসলেও কোথায়, কতটুকু করছি?

আমার ধারণা আমরা বর্জ্যের পরিপূর্ণ ও সমন্বিত ব্যবস্থা এবং ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি বলেই পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের খাল-বিল, নদ-নদীগুলোর দিকে তাকালেই সে চিত্রটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সিলেট শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদীর পারে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য ও পরিবেশ হুমকিতে পড়লেও কেউ বর্জ্য ফেলা বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

হবিগঞ্জের সুতাং নদের জলের দিকে তাকালে এখন মনে হবে যেন রং মেশানো হয়েছে। একসময়ের স্বচ্ছ জল এখন কুচকুচে কালো। এখন মাছ তো দূরের কথা, নদে এখন পোকামাকড়ও পাওয়া যাবে কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এখন আর কেউ এ নদে স্নান বা গোসল করে না। পানির দুর্গন্ধে নদের পার দিয়ে হাঁটাও কঠিন হয়ে যায়। সুতাংয়ের পানি এখন সেচকাজেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অন্য উপায় না পেয়ে যারা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের চর্মরোগসহ নানা ধরনের অসুখ হচ্ছে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কারখানাগুলো যদি ইটিপি ব্যবহার করত, তাহলে সুতাংয়ের এই দশা হয়ত হত না। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, ইটিপি হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিল্প কারখানাসমূহের অপরিশোধিত পানি পরিশোধন করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে দূষিত পানিকে বিশুদ্ধ করা হয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য ও সহযোগিতার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

বছরের পর বছর ধরে উচ্ছিষ্ট প্যাকেট, খোসা, খালি বোতল ও ক্যান ইত্যাদির মাধ্যমে পর্যটনসমৃদ্ধ নদ-নদীর পারের আকর্ষণীয় পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, একইসাথে নদ-নদীসমূহও দূষণের স্বীকার হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ: মানিকগঞ্জের আন্ধারমানিক বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মাপাড়ের কথা বলা যেতে পারে।

করোনাকালীন সময়ে জাতীয় মিডিয়াতে এ ধরনের অসংখ্য খবর আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি। হতবাক হয়ে দেখতে হচ্ছে, গৃহস্থালী বর্জ্যসহ দখলের উদ্দেশ্যে বালু-সুরকি ও মাটি ফেলে কুমিল্লার গোমতী নদী এবং বরিশাল অঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী কীর্তনখোলা বর্জ্য প্ল্যাস্টিকে কীভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের অনেক নদ-নদী হারিয়ে যাওয়া এবং স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বিনষ্টের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তবে আমার ধারণা, অনেক কারণের মধ্যে বর্জ্যই এখন প্রধান কারণ।

অথচ চাইলেই বর্জ্যের মাধ্যমে নদ-নদী, জীববৈচিত্র্য ও চারপাশের পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে সেটা আমরা বন্ধ করতে পারি। অবশ্য সেই চাওয়াটা যদি দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে এবং যদি ধনী-দরিদ্র-ব্যবসায়ী-প্রশাসন-রাজনীতিবিদসহ সব পর্যায়েই সে চাওয়ার গুরুত্ব ও চর্চা লক্ষ্য করা যায়।

এছাড়া শুধু চাইলেই তো হবে না, দেশব্যাপী এজন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও শিক্ষামূলক ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া এবং আইন প্রয়োগসহ সব ধরনের উপযুক্ত ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনাও গড়ে তোলা প্রয়োজন হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, সময় চলে যায়, বর্জ্য ধীরে ধীরে জমতে থাকে- বর্জ্য নদ-নদীর পারে জমে যাচ্ছে, মাটির তলায় জমে যাচ্ছে, নদীর তলদেশে জমে যাচ্ছে। আর এভাবেই বর্জ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো ক্রমে বড় থেকে আরও বড় হয়ে জমে যাচ্ছে। তাই এখনই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচিত এ সমস্যার আশু ও সহজ সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া।

নদীদূষণ রোধে যে আইন আছে তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাটাও বর্তমান সময়ে একান্ত জরুরী। অন্যদিকে নাগরিকদের উচিত, সবকিছুর জন্য সরকারের সহায়তা বা নির্দেশনার অপেক্ষা না করে, বর্জ্য যেখানে ইচ্ছে সেখানে না ফেলে, নিজেরাও সচেতন হওয়া, হাতের কাছে থাকা সমাধান (উদাহরণস্বরূপ: পচনশীল বর্জ্য দিয়ে সার তৈরি করা, বর্জ্য দিয়ে হস্তশিল্প তৈরি করা, প্লাস্টিক বোতল কেটে গাছ লাগানো, প্লাস্টিক সামগ্রী আলাদা করে সংগ্রহ করা ইত্যাদি) ব্যবহার করা।