যুক্তরাষ্ট্রের সড়ক থেকে জিয়ার নাম অপসারণের নেপথ্যে

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 10 Sept 2021, 06:45 PM
Updated : 10 Sept 2021, 06:45 PM

সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের নামে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড রাজ্যের বাল্টিমোর  শহরের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছিল চলতি বছরের জুন মাসে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় এবং কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের সোচ্চার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সে নামকরণ প্রত্যাহার এবং ফলক অপসারণ করে নিয়েছে বাল্টিমোরের নগর কর্তৃপক্ষ। শহরের মেয়র ব্রেনডন স্কট যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির অপতৎপরতায় এবং তাদের দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে বাল্টিমোরের ২০০ ওয়েস্ট সারাটগা স্ট্রিটে 'জিয়াউর রহমান ওয়ে' নামফলক লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।  

খবরটি পেয়ে অবাক এবং মর্মাহত হন কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীসহ দলটির অনেক নেতা-কর্মী। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে অন্য দেশের একজন সামরিক স্বৈরশাসকের নামে রাস্তা হতে পারে না। তারা প্রতিজ্ঞা করেন, যে করেই হোক এ সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য নগরকর্তাকে জানানোর মধ্য দিয়ে ওই নামফলক অপসারণের উদ্যোগ নিবেন। 

এরই ধারাবাহিকতায় প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী ঢাকায় বিভিন্ন জনের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। সপ্তাহ তিনেক আগে একদিন সেলিম মাহমুদ এবং  বিপ্লব বড়ুয়া এবং আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক উপকমিটির সদস্য আইনজীবী কুমার দেবল আমার বাড়ি আসেন। বেশকিছুক্ষণ সলা পরামর্শের পর আমরা কৌশল নির্ধারণ করি। 

হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যেসব নিন্দামূলক মন্তব্য করেছে, সেগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে বাল্টিমোরের মেয়রের কাছে পাঠানোর দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। 

আমি সে অনুযায়ী, বাল্টিমোরের মেয়রকে যা লিখলাম তা হলো-

২০১১ সালের মার্চ মাসে হাইকোর্ট বিভাগ এক মামলার রায়ে জিয়াউর রহমানকে ঠাণ্ডার মাথার খুনি বলে উল্লেখ করে। পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল এবং হাইকোর্ট বিভাগ জিয়া, মোশতাক এবং বিচারপতি সায়েম- এ তিনজনকে অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক পন্থায় বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করার দায়ে শুধু ভৎর্সনাই করেনি বরং তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলেও আখ্যায়িত করেছে। রায়ে বলা হয়েছে, এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার এবং অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের জন্য মামলা হওয়া উচিত এবং জনগণ যেন সর্বকাল তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। উচ্চ আদালতসমূহ আরও বলেছে, জিয়া গং তাদের শপথ ভঙ্গ করে আগ্নেয়াস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করে দেশে সংবিধানের এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। দুই আদালতের বিচারপতিরা আরও লিখেছেন, আইন অনুযায়ী জিয়া গংদের কোন যোগ্যতা ছিল না দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার, যা করে তারা শপথ ভঙ্গের অপরাধে অপরাধী।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আমি লিখি,

যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দেওয়া সাক্ষ্যগুলো নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করে, জাতির জনকের হত্যায় জিয়ার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, যে কথা কিনা জিয়ার অতি আপনজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তার পুস্তক 'চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট' এ পরিষ্কার করেই লিখেছেন। এছাড়াও ১৯৭৬ সালের ২ অগাস্ট লন্ডনে এক টেলিভিশন টক শো-তে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি- কর্নেল ফারুক এবং রশিদ অকপটেই প্রকাশ করেছে যে তারা জাতির পিতার হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে তৎকালীন দ্বিতীয় সেনা প্রধান জিয়ার সাথে আলাপ করেছে এবং জিয়া তাদের পুলিশে না দিয়ে বরং উৎসাহিত করে তখনই রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছিল। এছাড়া ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের বহুল প্রচারিত 'সানডে টাইমস' পত্রিকায় একটি পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে সাজাপ্রাপ্ত খুনি কর্নেল ফারুক জাতির পিতা হত্যায় জিয়ার ভূমিকার বিষদভাবে উল্লেখ করে। 

এর পাশাপাশি প্রথমে মোশতাক এবং পরে জিয়া খুনিদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রথমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এবং পরে ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে। যার কারণে জাতির পিতা হত্যা মামলা ২১ বছর করা যায়নি, পরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সে আইন বাতিল করার পর বিচার হয়। 

এখানেই শেষ নয়। জিয়া জাতির পিতা হত্যাকারীদের পদোন্নতি দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে লোভনীয় পদে পদায়ন করেছে, যে ঘটনাসমূহ নিশ্ছিদ্রভাবে প্রমাণ করে, জিয়া জাতির পিতা হত্যায় জড়িত ছিল, যে কথা হাইকোর্টে সাক্ষী দেওয়ার সময় বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিপসুলজও বলেছেন। অন্যান্য মামলার রায়েও হাইকোর্ট উল্লেখ করেছেন যে জিয়া হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে  মূলত হত্যা করেছে। এমতাবস্থায় আব্রাহাম লিংকনের দেশে, প্রধান বিচারপতি জন মার্শালের দেশে- অন্য দেশের একজন অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলদারের নামে, যাকে সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একজন খুনি, একজন দেশদ্রোহী, গণতন্ত্রের এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহতকারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, তার নামে কোন সড়ক থাকতে পারে না।

অন্যদিকে সিদ্দিকী সাহেবসহ যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতারাও অনেক লোকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি প্রতিবাদলিপি পাঠান। ঢাকা থেকে পাঠানো আমাদের নথি এবং গণসাক্ষরের কাগজ বাল্টিমোর মেয়রের হাতে পৌঁছালে তিনি আমাদের সঙ্গে জুম প্ল্যাটফর্মে আলোচনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। 

জুম প্ল্যাটফর্মে ওই আলোচনার আগেই বাল্টিমোরের মেয়র আমাদের পাঠানো হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের রায়ও পর্যালোচনা করেন।  

তার আলোচনার আগ্রহে সাড়া দিয়ে আমরা কয়েকজন বৃহস্পতিবার গভীর রাতে (অর্থাৎ ততোক্ষণে শুক্রবার হয়ে গেছে) জুম অ্যাপে তার সঙ্গে যোগ দেই। 

এতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোহাম্মদ আলি সিদ্দিকী, শামিম চৌধুরী, প্রদীপ রঞ্জন কর, মঞ্জুর চৌধুরী, আইনজীবী শাহ মোহাম্মদ বখতিয়ার, এম এ করিম জাহাঙ্গীর, জালালউদ্দিন জলিল, টি মোল্লা, রুমানা আক্তার এবং শহিদুল ইসলাম যোগ দেন। 

এছাড়া বাংলাদেশ থেকে যোগ দেন- বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (এই প্রবন্ধের লেখক) এবং সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত। জুম মিটিংয়ে অংশ নিয়ে আমরা জিয়ার নাম সড়ক থেকে অপসারণের দাবি উত্থাপন করি।

বাল্টিমোর মেয়রের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন, ক্যাটলিনা রদ্রিগেজ, ডেভিড লিয়ামসহ তার দপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। ওই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সবার কথা এবং মতামত শোনার পর মেয়রের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে- 'জিয়াউর রহমান ওয়ে' নামে যে সড়কটির নামকরণ করা হয়েছিল, বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এমনকি ওইদিনই নেইমপ্লেটও তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়।  

এ সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তির জয়। কেননা আদালত কর্তৃক ঘোষিত একজন খুনি, বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলদার স্বৈরশাসকের নামে পৃথিবীর কোনও গণতান্ত্রিক দেশের রাস্তার নাম থাকতে পারে না। এ মহৎ কাজে যারা অংশ নিয়েছেন তারা সকলেই ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার।