জনশুমারি ও বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী

“দেশে এখন হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে হিন্দু ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারির চেয়ে এবারের জনশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে দশমিক ৫৯ শতাংশ।” –লিখেছেন চিররঞ্জন সরকার।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 30 July 2022, 12:24 PM
Updated : 30 July 2022, 12:24 PM

১৯৪৭ সালের পর থেকেই আমাদের দেশে হিন্দু জনসংখ্যা একটু একটু করে কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনেও সেই চিত্র দেখা গেল। দেশে এখন হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে হিন্দু ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারির চেয়ে এবারের জনশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে দশমিক ৫৯ শতাংশ। পক্ষান্তরে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯১ শতাংশ। ২০১১ সালে যা ছিল ৯০.৪ ভাগ।

স্বাধীন দেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। তখন হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর আরও চারটি আদমশুমারি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হিন্দু। এবার আরও কমল। তার মানে কি এদেশে হিন্দুর সংখ্যা ধারাবহিকভাবে কমতেই থাকবে? এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে?

এ প্রশ্নের উত্তরটা মোটেও প্রীতিকর নয়। আসলে এদেশে এখন এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে হিন্দুরা নিজেদের সম্মান, মর্যাদা নিয়ে থাকতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নাগরিক অধিকার নেই। নিরাপত্তা নেই। সামাজিক-প্রশাসনিক সুরক্ষা নেই। মাইকে ঘোষণা দিয়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ করলেও, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেও তা ঠেকানোর কেউ নেই। গত তিন দশক ধরে একই ধরনের ঘটনা বার বার ঘটলেও এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।

অথচ ক্ষমতাসীনরা মুখে কত ভালো ভালো কথা বলেন। তাই যদি হবে তাহলে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার একটি ঘটনারও বিচার হচ্ছে না কেন? আসলে বাংলাদেশ আর আগের জায়গায় নেই। আগের জায়গায় নেই আওয়ামী লীগও।

বাংলাদেশ কেবল মুসলিমদের রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে কমবেশি সব দলেরই অবদান আছে। সংক্ষেপে সেই ইতিহাসটা একটু তুলে ধরা দরকার। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং ন্যায় ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য ধারণ করেই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সেই সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চারটি মূলনীতির উল্লেখ ছিল- ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানের চার মূলনীতিকে হত্যা করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা যায় নির্বাসনে। আসে ‘পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় বাংলাদেশের উল্টোযাত্রার সেই শুরু।

জিয়া-এরশাদের সামরিক সরকার এবং তাদের তাবেদার অসামরিক সরকারগুলো এই উল্টোযাত্রাকেই এগিয়ে নিয়েছে। জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে জামায়াতে ইসলামীসহ সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। আর স্বৈরশাসক এরশাদ এসে ইসলামকে করলেন ‘রাষ্ট্রধর্ম’। রাতারাতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের বানিয়ে দিলেন ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’।

জিয়া-এরশাদের সামরিক জমানার অবসানের পর এলো খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক শাসনামল। কিন্তু বেগম জিয়ার বিএনপি তো কার্যত জিয়াউর রহমানেরই আদর্শিক উত্তরসূরী। ফলে সেখানে পরিবর্তন কাম্য ছিল না। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু সংবিধান সংশোধনে তার প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সেবারও কোনো পরিবর্তন সম্ভব হলো না। আবার ক্ষমতায় বসলেন খালেদা জিয়া। দোসর হিসেবে ক্ষমতার ভাগীদার হলো জামায়াত। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাম্প্রদায়িক দুই ব্যক্তি মন্ত্রী হলেন। উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের উত্থান ও বিকাশ হলো রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। এরপর সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরল শেখ হাসিনার সরকার। চলছে একটানা তিন মেয়াদ।

প্রথম মেয়াদেই সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। এরই মাঝে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জিয়া-সাত্তার-সায়েম এবং এরশাদের শাসন ‘অবৈধ’ ঘোষণা হলো। ফলে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলে, তা অবৈধ বিবেচিত হলো। একই সূত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকারও অবৈধ। কিন্তু ১৯৮৮ সালে প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত ৮ম সংশোধনী বহাল রয়ে গেল। বাংলাদেশের জন্মপরিচয় আর রাষ্ট্রীয় মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ওই ৮ম সংশোধনী অবৈধ ছিল না? এই প্রশ্নে ‘কবি নীরব’ হয়ে গেল!

টানা তিন মেয়াদের প্রথম মেয়াদেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলো শেখ হাসিনার সরকার। বহু সংশোধনী প্রস্তাব পাস হলো একসঙ্গে। তাতে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরে এলো। কিন্তু ‘বাস্তবতা’র দোহাই দিয়ে রয়ে গেলো ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। রয়ে গেলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকার।

এতে করে আসলে এ সংবিধানের একটি কিম্ভুত চরিত্র দাঁড়াল! পঞ্চদশ সংশোধনী-উত্তর বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম হলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, অপরদিকে এ রাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হলো ইসলাম। ধর্ম এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সবই রইল। রইল ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকারও।

রাষ্ট্র যখন একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেয়, তখন সেই গরিষ্ঠ ধর্মওয়ালারা জোশের ঠ্যালায় লাফাতে লাফাতে দুর্বল অংশকে অবজ্ঞা অপমান করে। আর ধর্মপরিচয়ে লঘুরা হীনমন্য হয়ে যায়।

এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর দমন-পীড়ন নির্যাতন প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অপমান, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, বিদ্রূপ, হামলা, হুমকির কারণে নীরবে দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে চলেছে। এখনও প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও থেকে কোনো না কোনো হিন্দু পরিবার অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের জমি দখল, পরিবারের নারীদের উপর নানামুখী নির্যাতনসহ নির্যাতনের নিত্যনতুন কৌশল ফলিয়ে তাদেরকে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। ‘শত্রু সম্পত্তি’ থেকে আওয়ামী লীগের সরকার ‘অর্পিত সম্পত্তি’তে এলেও তার হাজার হাজার অভিযোগ নিষ্পত্তি না করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। অর্পিত সম্পত্তির দখলের ক্ষেত্রে বিএনপি-আওয়ামী লীগ, ডান-বাম কেউই পিছিয়ে নেই।

লাগাতার নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও আজ পর্যন্ত কোনো হিন্দু নিগ্রহের ঘটনার বিচার হয়নি। ওদিকে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসকে প্রতিনিয়ত আঘাত করা হচ্ছে। বিভিন্ন মাহফিল থেকে সব সময় হিন্দু ধর্মকে হেয় করে কথা বলা হয়। ফেইসবুক-ইউটিউব জুড়ে হিন্দুবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্যে ঠাসা কনটেন্ট। টিপ পরলে অপমান। শাঁখা পরলে টিটকারি। নিয়মিত দেবদেবীর মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হচ্ছে। ‘দুই নৌকায় পা’, ‘ভারতে বাপের বাড়ি যায় না কেন’ এইসব কথা নিয়মিত বলা হয়। সমানাধিকারের প্রশ্ন তো নেই-ই, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সামান্য করুণাভিক্ষা দেওয়া ছাড়া এদেশে যেন আর কিছুই বরাদ্দ নেই।

লাগাতার মার খেয়ে, অপমানিত হয়ে, জমি-জায়গা হারিয়ে যাদের পক্ষে সম্ভব তারা দেশ ছাড়ছে। আর যাদের দেশ ছাড়ার সাধ্য-সামর্থ্য নেই তারা এখনও দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে আছে। আর ফুটবলের মতো লাথি খাচ্ছে। লাথি মারছে কারা? হ্যাঁ, দুই দলই মারছে। আমাদের দেশে তো দল মূলত দুটি। একটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ, আরেকটা হচ্ছে অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ। দুপক্ষের লাথি-গুঁতো খেয়েই এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ কোনোমতে টিকে আছে।

তবে যে ধারা চলছে, তাতে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না!

হ্যাঁ, হিন্দুদের বাংলাদেশের নাগরিক মনে করলে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখা কমে যাওয়া বা তাদের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে চাইলে সবার আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঘোষণা দিতে হবে যে, এই হিন্দুদের নির্যাতন করা যাবে না। নির্যাতন করলে তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে হবে। ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর যেকোনো অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনার দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনকে কড়া বার্তা দিতে হবে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। প্রয়োজনে চাকরিচ্যুত করা হবে। সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার চর্চা বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন হলো এই কাজগুলো কে করবে? যাদের করার কথা তারা নিজেরাই যে চেতনায় হিন্দুবিরোধী হয়ে যায়নি, সেটাই বা হলফ করে কে বলবে?