বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি: সহজিয়া খায়েশের আক্কেল সেলামী

ঘরের বধু বাংলাকে অবহেলা করে বারোয়ারি ইংরেজির প্রতি অতি মনোযোগের ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে বাঙালির ইহকাল ও পরকাল দুই-ই নষ্ট হতে বসেছে।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 23 Nov 2022, 12:42 PM
Updated : 23 Nov 2022, 12:42 PM

কদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের গবেষণা মেলায় ‘গবেষণা’ শব্দটি ভুল বানানে লেখা হয়েছিল। সম্প্রতি আবার ভুল হলো ইংরেজি বানান, ‘ফিফটি থ্রিত’। এই দুই ভুলের ভাষাবৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-রাজনৈতিক কারণ বিশ্লেষণ বর্তমান প্রবন্ধের বিষয়বস্তু।

আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না! বাংলা বানান ভুল হয় হোক না! কিন্তু অত সোজা যে ‘ইঞ্জিরি’, তাতেও কেন ভুল হলো। (নজরুলের ভাষায়) ‘পড়বি পড় মালির ঘাড়ে,’– ভুল হলো ‘গলগ্রহ’ স্যুভেনির টাইয়ের ওপর। গলার কাঁটা বোধহয় একেই বলে, একেবারে ‘টাইডাই’, তাও কাতারে বিশ্বকাপ শুরুর আগমুহূর্তে।

প্রথমে ‘গবেষণা’ প্রসঙ্গ। ‘মূর্ধন্য ‘ণ’ বর্ণ আছে বাংলায়, কিন্তু মূর্ধন্য নাসিক্য ধ্বনি নেই। ‘ণ’ বর্ণটা বাদ দিলেই ল্যাটা চুকে গিয়ে বাংলা লেখাটা সহজ হয়ে যায় বটে, কিন্তু একাধিক কারণে মূর্ধন্য ‘ণ’ বাদ দেওয়া যায় না।

‘নদী তুমি কোথায় হইতে আসিয়াছ? মহাদেবের জটা হইতে!’ ভাষা এক বহমান সত্তা, অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের পানে বয়ে চলেছে ভাষার নদী। অতীতকে বাদ দিয়ে কোনো ভাষা চলতে পারে না। উজানের গঙ্গাকে অস্বীকার করে ভাটির পদ্মা কি টিকতে পারে? ভাষা একই সঙ্গে যাদুঘর এবং কারখানা। এর কারখানা অংশটি শুধু রাখবেন, যাদুঘরটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেবেন আইসিস কিংবা তালেবানের মতো, সেটি হতে পারে না।

মূর্ধন্য ‘ণ’ বাংলা ভাষার অতীতের একটা বিষয়, উচ্চারণে হারিয়ে গেছে বটে, লেখায় এখনও বহাল আছে। মূর্ধন্য ণ যে উচ্চারণেও এককালে ছিল, তার প্রমাণ, দক্ষিণ ভারতের ভাষাগুলোতে, বিশেষ করে তামিলে তিন তিনটি ‘ন’ ধ্বনি আছে: ‘দন্ত্য ন’, ‘মূর্ধন্য ন’ এবং ‘কণ্ঠ্য ৯’ (তৃতীয় নাসিক্য ধ্বনিটি লেখার বর্ণ বাংলায় নেই বলে ৯ সংখ্যা দিয়েই লিখলাম)। তামিলের সঙ্গে বাংলার সম্পর্কের বহু প্রমাণ আছে, আপাতত একটি প্রমাণ দিচ্ছি: বাংলা বহুবচনদ্যোতক প্রত্যয় {গুলি/গুলো/গুলা}-এর উৎপত্তি তামিল থেকে।

ভাষার অন্যতম উপযোগিতা হচ্ছে পূর্বজদের রচনা পাঠ করা। আজকের শিশুকে তার পিতা-পিতামহের রচনা পড়তেই হবে, কারণ তা না হলে বার বার সে একই চাকা আবিষ্কার করে যাবে। আজ যদি আমরা মূর্ধন্য ণ বাদও দিই, গত হাজার বছরের বাংলা রচনায় মূর্ধন্য ণ বাদ হয়ে যাবে না। শিশু যদি মূর্ধন্য ণ না চেনে, তবে পিতামহের রচনা পাঠ করতে তার কমবেশি সমস্যা হওয়ার কথা।

আমাদের মস্তিস্কে ভাষার জন্যে যে জায়গা বা জায়গাগুলো বরাদ্দ আছে, তাতে দুটি অংশ আছে– ব্যাকরণ ও শব্দকোষ। ধরে নেওয়া হয় যে কিছু শব্দ তাদের গঠন ও উচ্চারণসহ শব্দকোষে লিপিবদ্ধ আছে। শিক্ষিত মানুষের শব্দকোষে শব্দের বানানটাও লিপিবদ্ধ থাকে বলে আমার বিনীত দাবি। ওই বানানের সঙ্গে যখন কোনো বানান না মেলে, আমরা সন্দেহ করি, বানানটা ভুল বা গ্রহণ-অযোগ্য।

‘গবেষণা’ বানানটা বেশিরভাগ বাংলাভাষীর শব্দকোষে, আমাদের পূর্বজদের রচনায় মূর্ধন্য ‘ণ’ বর্ণ সহযোগেই লিপিবদ্ধ আছে। সুতরাং রাতারাতি দন্ত্য ‘ন’ দিয়ে এই বানান লেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ইংরেজি থুক করে ফেলা ‘কফ’ শব্দের বানান কি ‘সি-ও-ডবলএফ’ লেখা সম্ভব? ‘পুট’ শব্দের অনুকরণে ‘কিন্তু’ অর্থে ‘বাট’-এর পরিবর্তে ‘বুট’ উচ্চারণ কি গ্রহণযোগ্য হবে? বেশিরভাগ ইংরেজিভাষীর শব্দকোষে লিপিবদ্ধ এই দুই শব্দের উচ্চারণ ও বানানের কারণেই আমরা তা করতে পারি না।

এটা সত্য যে ‘গবেষণা’ বানান দন্ত্য ‘ন’ দিয়ে লেখার ভুলটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ বাংলা ভাষার একটি ধ্বনির বিপরীতে একাধিক সদৃশ বর্ণ রয়েছে। একইভাবে মস্তিষ্কের অ্যানালোজি (বাংলায় আমি বলি ‘অনুসার’) ইংরেজি ‘পুট’ শব্দকে ‘পাট’ হিসেবে উচ্চারণ করতে উৎসাহিত করতে পারে আপনাকে। কিন্তু ইংরেজি যে জানে, কখনই সে স্বাভাবিকতার এই সব দাবিকে পাত্তা দেবে না।

স্বাভাবিকতা প্রকৃতির ধর্ম বটে, কিন্তু প্রকৃতির সব ধর্মই মানুষের ধর্ম নয়। প্রকৃতির অনেক স্বাভাবিকতাকে মেনে নেয় মানুষ, কিন্তু কিছু স্বাভাবিকতাকে অস্বীকারও করতে হয় তাকে। মাটিতে আনুভূমিক শুয়ে থাকা খুব স্বাভাবিক, সাপ কিংবা কুমির তাই করে। কিন্তু মানুষকে ভোরের আলো ফুটতেই উলম্ব হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়। প্রকৃতির অনেক নিয়ম মেনে, কিছু নিয়মকে প্রয়োজন ও সুবিধামতো অস্বীকার করেই বস্তুত আদিম মানুষ আধুনিক মানবে বিবর্তিত হতে পেরেছে।

‘পুট’-কে যারা ‘পাট’ বা ‘বাট’-কে ‘বুট’ উচ্চারণ করে ফেলে, তাদের নিয়ে আমরা হাসি। কেউ ‘গবেষনা’ বানান ভুল লিখলে আমরা যে হাসি না, তার পেছনে সমাজ-রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। বাংলা ভাষাকে আমরা সাধারণত ইংরেজির নিচে স্থান দিই বলে একান্ত বাধ্য না হলে বাংলা বানান ভুলকে আমরা গ্রাহ্য করতে চাই না। লুঙ্গিতে গিঁট দিতে না শিখলে কোনো ব্যাপার নয়, প্যান্টের জিপার বন্ধ না করতে জানলেই আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

‘গবেষণা’-এর পরিবর্তে ‘গবেষনা’ লেখাটা কিছুটা ধ্বনিতত্ত্ব, কিছুটা লিপিগত, কিছুটা শব্দকোষগত সমস্যা। ‘ফিফটি থ্রিত’ লেখার পেছনে ব্যাকরণও গুরুত্বপূর্ণ কলকাঠি নেড়েছে। কীভাবে? ‘সংখ্যাশব্দ’ বা কার্ডিনাল নাম্বার এবং ‘ক্রমবাচক শব্দ’ বা অর্ডিনাল নাম্বারের মধ্যে পার্থক্য আছে অনেক ভাষাতেই। ইংরেজিতে ‘ওয়ান’ হচ্ছে সংখ্যাশব্দ আর ‘ফার্স্ট’, ‘সেকেন্ড’, ‘ফোর্থ’ ... এগুলো হচ্ছে ক্রমবাচক শব্দ। ইংরেজিতে ক্রমবাচক শব্দকে ‘তারিখ শব্দ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ক্লাসের ‘দি ফার্স্ট বয়’ বলা হয়, আবার ‘দি ফার্স্ট অব জানুয়ারি’ও বলা হয়।

আমরা জানি, ‘প্রথম’ হচ্ছে ‘ফার্স্ট’, দ্বিতীয় হচ্ছে ‘সেকেন্ড’, ‘তৃতীয়’ হচ্ছে ‘থার্ড’। ‘ফার্স্ট’ শব্দের শেষে সংখ্যা প্রাতিপদিক বা স্টেমের সঙ্গে {স্ট}, ‘সেকেন্ড’ শব্দের শেষে {ন্ড} এবং ‘থার্ড’ শব্দের শেষে {র্ড} প্রত্যয় (ভাষাবিজ্ঞানে রূপতাত্ত্বিক সত্তাকে দ্বিতীয় বন্ধনীর মধ্যে প্রদর্শন করার একটি রেওয়াজ আছে) যুক্ত হয়। এর পর থেকে সব শব্দে প্রাতিপদিকের সঙ্গে {থ} প্রত্যয় যুক্ত হয়: ‘ফোর্থ’, ‘টেনথ’। কিন্তু এই নিয়মের ব্যতিক্রম আছে: ২১, ২২, ৩১, ৪৩ ইত্যাদি শব্দে আবার যথাক্রমে ‘ফার্স্ট’, ‘সেকেন্ড’ এবং ‘থার্ড’ শব্দত্রয় প্রত্যয় হিসেবে যুক্ত হয়: ‘টুয়েনটি ফার্স্ট’ ‘টুয়েনটি সেকেন্ড’, ‘থার্টি ফার্স্ট’, ‘ফর্টি-থার্ড’। আইনের এই উপধারারও আবার ব্যতিক্রম আছে: ১১, ১২, ১৩– এই তিন শব্দে {থ}প্রত্যয় যুক্ত হয়।

ক্রমবাচক শব্দগঠনের উপরোক্ত প্রক্রিয়া বেশ জটিলই শুধু নয়, এতে একাধিক ধরনের আইন বা নিয়ম আছে, অনেকটা বাংলাদেশের ট্রাফিক সংস্কৃতির মতো। একবার বলা হচ্ছে, লাল আলোতে গাড়ি থামবে। আবার বলা হচ্ছে, মন্ত্রী বা সরকারি দলের কোনো মাস্তানের গাড়ি থামালে খবর আছে। প্রতিমন্ত্রী বা বিরোধীদলের মাস্তানের গাড়ি হলে ‘থামলে ভালো লাগে’। এমন জটিল একটি যাননিয়ন্ত্রণ সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশের রাস্তায় সর্বক্ষণ জ্যাম লেগে থাকে। যেকোনো ভাষাও এই ধরনের নিয়মে ভরপুর। জ্যামও লাগে, যেমন লেগেছে সম্প্রতি ‘গবেষণা’ বা ‘ফিফটি-থার্ড’ লিখতে গিয়ে।

শব্দগঠনের নিয়ম বা ব্যাকরণেরও কমপক্ষে দুই ধরনের নিয়ম আছে: ১) সাধারণ (‘জেনারেল’) এবং ২) বিশেষ (‘স্পেসেফিক’)। সাধারণকে ‘সামান্য’ও (সমান>সামান্য কিংবা সম+অন্য) বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। সাধারণ নিয়ম প্রতিবেশ নির্বিশেষে বা প্রায় সর্বত্র কার্যকর হয়। বিশেষ প্রতিবেশে কার্যকর হয় যে বিশেষ নিয়ম তাকে বলে ‘মার্কড’ বা ‘চিহ্নিত’ নিয়ম, সাধারণ নিয়মকে বলে ‘আনমার্কড’ বা ‘অচিহ্নিত’ নিয়ম। পাণিনির ব্যাকরণেও এই দুই ধরনের নিয়মের কথা আছে। ‘মার্কড’ বা বিশেষ নিয়মকে চমস্কির সঞ্জননী ব্যাকরণে বলা হয় ‘এলস হোয়ার কন্ডিশন’। লাল আলোতে গাড়ি থামার নিয়মটি সাধারণ, সামান্য, অচিহ্নিত, সর্বব্যাপী নিয়ম। মন্ত্রীর গাড়ি না থামা বিশেষ, চিহ্নিত নিয়ম।

নিয়মগুলোর স্বরূপ বোঝাতে এবং ইংরেজি ব্যাকরণের জটিলতার প্রমাণ দেয়ার জন্য অতি পরিচিত একটি উদাহরণ দিই। ইংরেজিতে বেশিরভাগ বিশেষ্যের বহুবচন রূপ গঠনের জন্য বিশেষ্য প্রাতিপদিক বা স্টেমের সঙ্গে ‘এস’ বা ‘ইএস’ যুক্ত হয়। উচ্চারণকালে ব্যাপারটা কিন্তু অত সরল-সোজা নয়। প্রাতিপদিক বিশেষ্য অঘোষ বা আনভয়েসড ধ্বনি (যেমন /প/, /ত/, /ক/) (ধ্বনিতাত্ত্বিক সত্তাকে তীর্যক চিহ্নের ভেতরে প্রদর্শন করা ভাষাবিজ্ঞানের একটি রেওয়াজ) দিয়ে শেষ হলে যোগ হবে {স}, যেমন, ‘বুক-বুকস’। ঘোষধ্বনি (যেমন /ব/, /দ/, /গ/) দিয়ে শেষ হলে যোগ হবে {য}, যেমন ‘ব্যাগ-ব্যাগয’।

শীষ ধ্বনি বা সিবিল্যান্ট (যেমন, /স/, /শ/, /য/) দিয়ে শেষ হলে {ইস/ইজ/এস/এজ}, যেমন ‘রোয-রোযিস/রোযিয/রোযেস/রোযেয’। শেষোক্ত এই একাধিক প্রত্যয়ের মধ্যে কোনটি যুক্ত হবে, সেটা আবার নির্ভর করবে উপভাষার ওপর। দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা প্রাক্তন উপনিবেশিতরা সাধারণত বলি ‘রোজেস’ বা ‘রোজেজ’, ইংল্যান্ডে ‘নুভো রিশ’ বা বুর্জোয়ারা, যেমন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন ‘রোজিজ’।

এই {স}, {য} কিংবা {ইস/ইজ/এস/এজ} পরস্পরের সহরূপমূল বা অ্যালোমর্ফ অর্থাৎ একেকটি একেক প্রতিবেশে বসে এবং একটি যে প্রতিবেশে বসে, অন্যজন ঠিক একই প্রতিবেশে বসতে পারে না। যেহেতু প্রাতিপদিক কোন বিশেষ ধ্বনি দিয়ে শেষ হচ্ছে, তার উপর বহুবচনের প্রত্যয় যোগ করা নির্ভর করছে, সেহেতু এটা রূপতত্ত্ব বা শব্দগঠনের ফনোলজিক্যাল কন্ডিশনিং বা ধ্বনিতাত্ত্বিক শর্ত।

আমরা উপরে বলেছি, প্রাতিপদিক ঘোষধ্বনি দিয়ে শেষ হলে {য} প্রত্যয় যুক্ত হবে। ‘চাইল্ড’ শব্দও যেহেতু ঘোষধ্বনি দিয়ে শেষ হচ্ছে, {য} প্রত্যয় তার সাথে গিয়ে যুক্ত হতে চাইতেই পারে। কিন্তু না, বিনয়ের সঙ্গে ‘চাইল্ড’ বলে: ‘{এন} প্রত্যয়ের সঙ্গে আমার গাঁটছড়া বাঁধা আছে। সুতরাং (রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের পাগলা মেহের আলীর মতো চিৎকার করে): ‘তুমি তফাৎ যাও!’ যেহেতু আমি ‘এলসহোয়ার কন্ডিশন’-এর আওতাভুক্ত একটি বিশেষ্য, তোমার স্থান (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে!’

সুতরাং *‘চাইল্ডস’ (গ্রহণ-অযোগ্য শব্দক্রমের বাম দিকে * চিহ্ন দেওয়া ভাষাবিজ্ঞানের আরেকটি রেওয়াজ) বললে ভুল হবে, বলতে হবে ‘চিলড্রেন’। {জ} এর পরিবর্তে {চাইল্ড}-এর সঙ্গে যুক্ত হবে (‘অক্স-অক্সেন’ এর মতো) {এন} প্রত্যয়। কিন্তু {স/জ/ইস/ইজ} যেভাবে সরাসরি বিশেষ্যের সঙ্গে উড়ে গিয়ে জুড়ে যেতে পারে, {এন} তা পারে না। প্রাতিপদিক {চাইল্ড} প্রথমে ভেঙেচুরে নাস্তানাবুদ হয়ে {চির্ল্ড} রূপ ধারণ করার পরেই শুধু তার সাথে {এন} প্রত্যয় যুক্ত হতে পারে।

‘চাইল্ড-চিলড্রেন’-এর তুলনায় বিশেষ্যের ডানে শ্রেফ একটি {স/শ/য} ধ্বনি যোগ করা সহজ বটে। সহজ বলেই সম্ভবত বহুবচনের এই নিয়মটি ইংরেজিতে সর্বব্যাপী নিয়মে পরিণত হয়েছে। ‘সম্ভবত’ বললাম এ কারণে যে সহজ হলেই যেকোনো নিয়মের পৌনপুনিক প্রয়োগ হবেই এমন কোনো কথা নেই। ইংরেজিতে এক সময় ‘বুক-বিক’ (এখনকার ‘বুক-বুকস’), ‘টুথ-টিথ’, ‘ফুট-ফিট’-এর মতো স্বরধ্বনি পরিবর্তন করে বহুবচন শব্দ গঠন করার নিয়মটি বহুল ব্যবহৃত হতো। ওই যুগে অল্প কিছু বিশেষ্যের সঙ্গে ‘এস’ বা ‘ইএস’ যোগ হতো। আজ স্বরধ্বনি পরিবর্তন হয়ে গেছে বিরল-ব্যবহৃত একটি নিয়ম আর {স} যুক্তকরণ (বুক-বুকস) হয়ে গেছে সর্বব্যাপী একটি নিয়ম। কেন এককালের বিরলব্যবহৃত একটি নিয়ম বহুব্যবহৃত নিয়মে পরিণত হয় এবং কেনই বা ঘটে এর উল্টোটা, ভাষাবিজ্ঞানীরা এখনও তার হদিশ করে উঠতে পারেননি।

‘চাইল্ড’ থেকে যে নিয়মে ‘চিলড্রেন’ গঠন করা হয়, ওই নিয়মে ইংরেজিতে দ্বিতীয় কোনো বিশেষ্যের বহুবচন রূপ গঠিত হয় না। নিয়মটি স্মরণে রাখা ছাড়া ‘চিলড্রেন’ শব্দ গঠনের দ্বিতীয় উপায় নেই। ইংরেজি ক্রমবাচক শব্দ ‘সেকেন্ড’, ‘থার্ড’ ইত্যাদিও একই নিয়মে গঠিত হয়। দ্বিতীয় কোনো শব্দে {ন্ড} কিংবা [র্ড} প্রত্যয় ব্যবহৃত হবার উদাহরণ নেই ইংরেজিতে। ব্যাকরণে এর নাম ‘লেক্সিকাল কন্ডিশনিং’ বা শব্দকোষগত শর্ত। ব্যাকরণের সাধারণ নিয়মের তুলনায় এই বিশেষ নিয়মগুলো কঠিন বা জটিল এই অর্থে যে এগুলো স্মৃতিনির্ভর। কষ্ট করে এগুলো স্মরণে রাখতে হয়।

ইংরেজিভাষী সমাজে শব্দগঠনের এই সব নিয়ম সহজ করা কিংবা শব্দগুলোকে বেমালুম বাদ দেবার দাবি কখনও ওঠেনি। ইংরেজিভাষী, ইংরেজি ভাষার বৈয়াকরণ, ইংরেজিভাষী বুদ্ধিজীবীরা কখনও কি দাবি করেছে ‘চিলড্রেন’-এর জায়গায় ‘চাইল্ডস’ লেখা চালু হোক, তাহলে ইংরেজি ভাষাটা সহজ হবে? জর্জ বার্নার্ড শ নাকি ইংরেজি ভাষার জটিলতা নিরসনে খরচ করার জন্য তার যাবতীয় সম্পত্তি উইল করে গিয়েছিলেন। ওই টাকা নিশ্চয়ই ব্যাংকেই পড়ে আছে।

বাঙালিরা কিন্তু ভাষাকে সহজ করার অজুহাতে ভাষার পায়ে কুড়াল মারতেও পিছপা হয় না। যেমন ধরুন, বাংলা তারিখ শব্দেও ইংরেজির মতো সংখ্যাশব্দই প্রাতিপদিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ‘পহেলা’, ‘দোসরা’, ‘তেসরা’, ‘চৌঠা’ মুখস্ত রাখতে হয়, কিন্তু তারপর থেকে ১৮ পর্যন্ত যুক্ত হয় {ই} প্রত্যয়: ‘এগারোই’, ‘চৌদ্দই’, ‘আঠারোই’। ১৯ থেকে ৩১ সংখ্যাশব্দগুলো [শ] ধ্বনি দিয়ে শেষ হয় এবং এদের সঙ্গে যুক্ত হয় {এ} প্রত্যয়: ‘উনিশে’, ‘বিশে’, ‘একুশে’, ‘একত্রিশে’ ইত্যাদি। বাংলা তারিখ শব্দ গঠনের নিয়ম এমন কিছু কঠিন নয়, অন্ততপক্ষে ইংরেজির তুলনায়। তবুও বাংলার দোষ, সবাই ভাবে, বাংলা কঠিন, ইংরেজি সোজা!

বাংলায় ‘এক’ হচ্ছে সংখ্যাবাচক শব্দ, ‘প্রথম’ (সংক্ষেপে ১ম) হচ্ছে ক্রমবাচক শব্দ এবং ‘পহেলা’ (সংক্ষেপে ১লা) হচ্ছে তারিখ শব্দ। বাংলায় ক্রমবাচক শব্দ আর তারিখ শব্দ আলাদা। তিন ধরনের শব্দ থাকা ভাষার শব্দকোষের একটি বৈচিত্র্য, একটি শক্তি, কিন্তু বাঙালিদের অনেকে এই বৈচিত্র্য বা শক্তিকে অহেতুক ঝামেলা মনে করেন। তারিখ শব্দের পরিবর্তে সংখ্যাশব্দ ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তারা, যেমন ‘পহেলা বৈশাখ’-কে তারা বলেন, লেখেন ১ বৈশাখ, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ই মার্চকে ৭ মার্চ।

এমন ভাষাব্যবহারকারী যদি বিখ্যাত কোনো লেখক হন, যেমন বিশ্ব (ভারতীর) কবি রবীন্দ্রনাথ, তবে বাকিরা স্বাভাবিকভাকেই নির্বিচারে তাকে অনুসরণ করেন। পুঁথিসাহিত্যে রগড় করে বলা হয়েছে: ‘কাপড় তুলিয়া প্রভূ সভাতে মুতিলা। শিষ্যগণে ভাবে বুঝি এও এক লীলা!’ আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে: ‘গুরুদেব! ‘পহেলা’, ‘দোসরা’ যখন বেমালুম বাদই দিলেন, তখন ‘প্রথম’, ‘দ্বিতীয়’-ইবা কেন রাখলেন? ক্লাসে ‘প্রথম হয়েছে’ না বলে ‘এক হয়েছে’ বললে কী এমন সমস্যা হয়? ‘প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়!’ কবি আসাদ চৌধুরীর বিখ্যাত পঙক্তি।

বাংলা ভাষা থেকে তারিখ শব্দ বাদ দেওয়ার কারণ কী? বাদ দেওয়ার সপক্ষে কোনো যুক্তি কোনোদিন কেউ দেখায়নি, গুরুদেব নিজেও কখনও গরজ করেননি। আমি গুরুদেবের উপরোক্ত অপকর্মের সপক্ষে কমপক্ষে দুটি যুক্তি দেখাচ্ছি। প্রথমত, ‘পহেলা’, ‘দোসরা’, ‘তেসরা’, ‘চৌঠা’ ইত্যাদি শব্দে যেহেতু লেক্সিক্যাল কন্ডিশনিং বা শব্দকোষগত শর্ত প্রয়োগ হয় কিংবা শব্দগুলোর গঠন চিহ্নিত, সেহেতু এগুলো মনে রাখা একটা ঝামেলা তো বটেই, অনেকটা ইংরেজি ‘চিলড্রেন’ বা ‘থার্ড’-এর মতো। মাথায় যেহেতু ব্যথা হয়, মাথাটাই কেটে দিয়ে গুরুদেব তার প্রিয় বাংলা ভাষাকে ঝামেলামুক্ত করতে চেয়েছেন। আমি নিশ্চিত, গুরুদেবের হাতে যদি ইংরেজি ভাষা দেখভালের ক্ষমতা থাকত, তবে তিনি ইংরেজিতেও ‘ফার্স্ট’ বা ‘চিলড্রেন’-এর মতো শব্দের অস্তিত্ব রাখতেন না।

দ্বিতীয়ত, ইংরেজিতে এক সময় ‘ফার্স্ট (অব) জানুয়ারি’, ‘সেভেনথ (অফ) মার্চ’ বলা হলেও পরবর্তী সময়ে ‘জানুয়ারি ওয়ান’, ‘মার্চ সেভেন’ লেখার রীতি চালু হয়েছে। দাদারা যখন করেছে, আমরা ছোটভাইয়েরাই বা কেন তাদের অনুসরণ করব না? এর বিপক্ষে এবার আমি দুটি পাল্টা যুক্তি দিচ্ছি। প্রথমত, ইংরেজিতে কিন্তু তারিখ শব্দ গঠনের আগের বুনিয়াদি নিয়মটাও বাতিল হয়নি। দ্বিতীয়ত, ইংরেজিতে যেহেতু ক্রমবাচক শব্দই তারিখ শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেহেতু তারিখ শব্দ ব্যবহার না করলেও শব্দগঠনের এই নিয়মটা হারিয়ে যাবে না। বাংলায় তারিখ শব্দ গঠনের যেহেতু পৃথক, নিজস্ব নিয়ম আছে, তারিখ শব্দ বাদ দিলে নিয়মটাও চিরতরে হারিয়ে যাবে।

তৃতীয়ত, তারিখ শব্দ বাদ দিলে বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনর্থক বিভ্রান্তি বা দ্বিধার সৃষ্টি হবে, হয়েছে ইতোমধ্যে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশ (নাকি একুশে) ফেব্রুয়ারি’ হবে? ৭ই মার্চের ভাষণ, নাকি ৭ মার্চের ভাষণ? কিংবা হোসনে আরা রচিত স্কুলপাঠ্য সেই বিখ্যাত ছড়া ‘সফদার ডাক্তার’-এর শেষ পঙক্তিগুলো: ‘একদিন সক্কাল, ঘটল কী জঞ্জাল, ডাক্তারে ধরে এসে পুলিশে, হাতকড়া দিয়ে হাতে নিয়ে গেল থানাতে, তারিখটা আষাঢ়ের উনিশে।’ যে শিক্ষার্থী সারা বছর ‘উনিশ আষাঢ়’ শিখবে, সে কি এই ছড়ায় ‘আষাঢ়ের উনিশে’ দেখলে বিভ্রান্ত হবে না?

ভাষা সহজ করার এই সব হটকারী সিদ্ধান্ত অনেকটা শিশুদের যুক্তাক্ষর না শেখানোর সিদ্ধান্তের মতো। যুক্তাক্ষর না থাকলে লেখা শিখতে সময় কম লাগে, এটা সত্য। কিন্তু পড়তে শেখার অন্যতম উদ্দেশ্য, আগেই বলেছি, পূর্বজদের রচনা পাঠ করা। পূর্বজরা যেহেতু যুক্তাক্ষর ব্যবহার করেছেন, শিশুকে তাদের লেখা পড়তে হলে যুক্তাক্ষর তো চিনতেই হবে। আলালের ঘরের এক দুলাল নাকি কঠিন মনে হওয়ায় বাংলা বর্ণমালার কার-ফলা-রেফ ইত্যাদি না শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। একবার নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়ে এই দুলাল বাপ আলালকে চিঠি লিখেছিল: ‘বব টক পঠও নয়ত ভত মরব!’ চিঠি পড়ে তার বাবারও ‘অর্থকষ্ট’ হয়েছিল, অর্থাৎ বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল।

তারিখ শব্দে তারিখ প্রত্যয় {লা/রা/ঠা/ই} ছেঁটে দিয়ে বিভ্রান্তি বা দ্বিধা সৃষ্টির আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কি? যারা ১ বৈশাখ, ৭ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর নিজেরা বলতে-লিখতে চায় কিংবা অন্যদের বলাতে-লেখাতে চায়, তারা আর যাই হোক, ভাষা ও ব্যাকরণের নাড়িটা ঠিক ধরতে পারেনি। কিন্তু সংখ্যা ও ক্ষমতার বলে ইতোমধ্যে এই বিভ্রান্তিটাকে তারা এতটাই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে যে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের রোকেয়া হলে ‘৭ মার্চ’ নামে একটি ভবন পর্যন্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘৭ই মার্চ’ লিখে এই ভবন উদ্বোধন করেছিলেন, কিন্তু ঢাবি কর্তৃপক্ষ বলিউডের সালমান খানের মতো একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে প্রধানমন্ত্রী তো দূর কী বাত, ‘খুদকো ভি নেহি শুনতা!’

ভাষাকে সহজ করার পক্ষে সওয়াল করে থাকেন যারা, তাদের সপক্ষে আমার কমপক্ষে দুটি যুক্তি দেবার আছে। ‘আমি খাই’, ‘তুমি খাও’, ‘সে খায়’ না বলে ‘আমি খাওয়া’, ‘তুমি খাওয়া’, ‘সে খাওয়া’ বললে ভাষা বেশ সহজ হয়ে যায় বটে। দুই কারণে এমনটা করা যায় বৈকি, প্রথমত, জাপানি বা চীনা ভাষায় এরকম বলা হয়, কনজুগেশন বলতে কিছু নেই এই দুই ভাষায়; দ্বিতীয়ত, আমি, তুমি, সে যেহেতু সশরীরে হাজির, কর্তা অনুসারে ক্রিয়ার রূপপরিবর্তনের প্রয়োজনটা কি? সমস্যা হচ্ছে, যাবতীয় যুক্তি সত্তেও ক্রিয়ারূপের এই সহজীকরণ বাংলাভাষা আপাতত অনুমোদন করবে বলে মনে হয় না। বাংলাভাষার দুঃসাহসিকতম লেখকটিও ‘আমি খাওয়া’ লিখলে তার পসার ও খ্যাতি রাতারাতি হাওয়া হয়ে যাবে।

উভয় বাংলায় ভাষাচর্চার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসও এখানে প্রাসঙ্গিক। এই অঞ্চলে ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে জাতীয় ও সার্বজনীন সিদ্ধান্ত যারা নিয়ে থাকে, ভাষা ও ব্যাকরণে তাদের অধিকাংশের না আছে প্রকৃত শিক্ষা, না আছে কার্যকর গবেষণার অভিজ্ঞতা। রোগীকে এবং রোগকে না বুঝে, মেডিকেল সায়েন্সে কোনোপ্রকার শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, নিদেনপক্ষে কাণ্ডজ্ঞানটুকুও ছাড়া চটজলদি নিদান বা প্রেসক্রিপশন যারা দিয়ে ফেলে, আর যাই হোক, রোগীর কোনো উপকার তারা করে না, রোগের মাত্রা বৃদ্ধি করে মাত্র। নিজের (ভাষার) পায়ে কুড়াল মারার অনেক সিদ্ধান্ত গত শ খানেক বছরে তেনারা নিয়েছেন, যার মধ্যে একটি হচ্ছে ভাষাকে সহজ করা। এই সহজিয়া খায়েশ থেকেই আমার মতে যাবতীয় সমস্যার উদ্ভব।

ভাষার পরিবর্তন হয় অনেকটা সিনেমার সেকেন্ডে চব্বিশ ফ্রেমের মতো, প্রতি ফ্রেমে সামান্য পার্থক্য থাকে, মানুষ ওই পার্থক্যটুকু খেয়াল তো করতে পারেই না বরং চিত্রটাকেই চলমান মনে করে। ভাষা কালক্রমে নিজে থেকে সহজ বা জটিল হয় বটে, কিন্তু কোনো একক মানুষ বা মানবগোষ্ঠী ভাষাকে সহজ বা জটিল করতে পারে না। মানুষ ভাষার দাস, ভাষা মানুষের দাস নয়। ভাষার ততটুকুই পরিবর্তনই মানুষ করতে পারে, ভাষা নিজেকে যতটুকু পরিবর্তন হতে দেয়, তার বেশি নয়।

ভাষা মানুষের সৃষ্টি, কিন্তু কোনো একক মানুষ বা গোষ্ঠীর এককালিক সচেতন সৃষ্টি নয়, বহু মানুষের অবচেতন কালানুক্রমিক সৃষ্টি। ভাষার নিয়মগুলো নাগরিক মানুষের সচেতন নির্মাণ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের মতো সরলরৈখিক নয়, গ্রামীণ মানুষের সম্মিলিত অবচেতন-অসচেতন সৃষ্টি মেঠোপথের মতো আঁকাবাঁকা। ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির’ মেঠো পথকে সরল-সোজা করতে চায় যারা, বুঝতে হবে, প্রকৃতি মহাশয়াকে তারা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি।

ভাষা এমন গোঁয়ারগোবিন্দ একটি প্রপঞ্চ বা ফেনোমেনন যে জোর করে সহজ করতে চাইলে কিংবা তার প্রতি মনোযোগী না হলে ত্যাঁদর কোনো শিশুর মতো সে ‘ঘাড়তেরামি’ করতে শুরু করে, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো গেরিলা কায়দায় এমন জায়গায় চোরাগোপ্তা হামলা চালায় যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে অত্যাচারী খানসেনারা। অতি সম্প্রতি যেমন স্যুভেনির টাইয়ে ‘ফিফটি-থ্রিত’ লিখিয়ে দিয়ে ইংরেজি ভাষা বহু দেশি-বিদেশি অতিথির সামনে ঢাবি কর্তৃপক্ষের ‘ইজ্জতের ফালুদা’ বানিয়ে দিয়েছে।

ইংরেজি তারিখ শব্দ আমার নিজের ইজ্জতেরও ফালুদা বানিয়েছিল ১৯৮০ সালে। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইংরেজিতে প্রশংসাপত্র টাইপ করাতে গিয়েছি চট্টগ্রাম শহরে, স্কুলের হেডস্যারকে দিয়ে সত্যায়িত করাব বলে। আলকরনের মোড়ে বসা টাইপিস্ট আমার মুসাবিদা করা দরখাস্ত দেখে বলল ‘টুয়েনটি টুথ জানুয়ারি’ নয়, ‘টুয়েনটি সেকেন্ড জানুয়ারি’ হবে।

‘সামান্য’ এক টাইপিস্ট আমার ‘অসামান্য’ ভুল ধরিয়ে দেয়াতে মহাবিরক্ত হলাম। এদিকে টাইপিস্ট ‘টুয়েনটি টুথ’ টাইপ করতে রাজি হচ্ছে না। লাইনে দাঁড়ানো অন্য খদ্দেররা বিরক্ত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় পাশের টাইপিস্ট মুচকি হেসে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সহকর্মীকে বললো, কাস্টমার যা ‘রাইট’ করে এনেছে, তাকে ‘রং’ বলছ দাদা কোন আক্কেলে? জানো না, কাস্টমার ইজ অলওয়েজ রাইট, তোমার রাইট সাইডেই তো ‘স্যার’ দাঁড়িয়ে আছেন!

ইয়ার্কি হজম করে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গেলাম সে যুগের দামি রেডিওবন্ড কাগজে টাইপ করা প্রশংসাপত্র। একবার চোখ বুলিয়েই নজির আহমদ চৌধুরী লাল কালি দিয়ে টুয়েনটি সেকেন্ড লিখে দিয়েছিলেন। কানটা আচ্ছাসে মলে দেননি, নেহায়েৎ তখন আর স্কুলের ছাত্র ছিলাম না বলে। আজ ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে স্যারের সেই কানমলাটাকে খুব মিস করছি।

‘ফিফটি থ্রিত’ ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের ঘাটতিজনিত একটি ভুল, সে আমার ক্ষেত্রেই হোক বা অন্য যার ক্ষেত্রেই হোক। এই ভুল বাংলা বা মাতৃভাষার প্রভাব বা ইন্টারফেরেন্সের কারণে হতে পারে কি? ‘ফিফটি থার্ড’ ক্রমবাচক শব্দ এবং বাংলায় ক্রমবাচক শব্দে ৭ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যার সঙ্গে {অম] প্রত্যয় এবং ১১ থেকে বাকি সব সংখ্যার সঙ্গে {তম} প্রত্যয় যুক্ত হয়। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলায় {তম] এবং ইংরেজিতে {থ} প্রত্যয় যুক্ত করাটা ক্রমবাচক শব্দগঠনের অচিহ্নিত বা সাধারণ নিয়ম। উপরোক্ত {তম} এবং {থ} প্রত্যয়ের উচ্চারণগত মিলও এই ভুলের কারণ হওয়া অসম্ভব নয়।

কারণ যাই হোক, এ ধরনের ভুল সাধারণত ইংরেজি-শিক্ষার্থীদের হয়ে থাকে, কোনো প্রকৃত ইংরেজিভাষী এমন ভুল করার কথা নয়। ভাষাশিক্ষাকে একটি স্কেল বা মাপকাঠিতে ফেললে তার সর্বনিম্ন প্রান্তে থাকে সেকালের আমার মতো নবিশ ইংরেজি-শিক্ষার্থী, উচ্চতর প্রান্তে থাকে অনেকটা আজকের আমার মতো কমবেশি চৌকশ ভাষাব্যবহারকারী এবং উচ্চতম প্রান্তে থাকেন স্বনামধন্য কোনো কবি বা লেখক। তবে ইংরেজি কম জানুক আর বেশি জানুক, {স} যোগ করার মতো সর্বব্যাপী নিয়ম প্রয়োগে প্রায় কেউই ভুল করে না।

ইংরেজি ভাষা যাদের ভালো করে শেখা হয়নি, নিয়মিত পড়ে-শুনে-লিখে-বলে শব্দগঠনের চিহ্নিত নিয়মগুলো রপ্ত করে উঠতে পারেননি যারা, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাকরণের চিহ্নিত নিয়মগুলোতে ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। গ্রহণযোগ্য/শুদ্ধ ইংরেজি বলা-লেখার স্বার্থে চাইল্ড-চিলড্রেন-এর মতো রূপতত্ত্বের নিয়মগুলো ইংরেজি-শিক্ষার্থীকে কষ্ট ও যত্ন করে শিখতে হয় এবং স্মরণে রাখতে হয়। যে সকল শব্দগঠনে ‘তফাৎ যাও!’ শর্ত কার্যকর হয়, কিংবা যে সকল শব্দ গঠনের নিয়ম চিহ্নিত, ওই সব শব্দ গঠনে ভুল হওয়া স্বাভাবিক বলেই বেশি সতর্ক থাকার প্রয়োজন। অন্যভাবে বলা যায়, ব্যাকরণের চিহ্নিত নিয়মগুলো মানার কথা মনে রাখতে পারে যারা, তারাই আসলে সংশ্লিষ্ট ভাষাটি ভালো করে শিখেছে।

‘ফিফটি থ্রিত’ যিনি লিখেছেন এবং এই বানান যারা অনুমোদন করেছেন তারা প্রত্যেকে অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্যুভেনির টাইয়ে ‘ফিফটি থ্রিত’ ছাপা হওয়া জনিত ভুলের উদোর পিণ্ডি প্রিন্টিং প্রেসের বেচারা বুধোদের ঘাড়ে ফেলার চেষ্টা করে লাভ নেই। অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ওই লোকগুলো এমন মহান ভুল করতেই পারবে না। এই ভুল শিক্ষিত লোকেরও অনবধানজনিত না হবার সম্ভাবনাই বেশি। ভানুর এক কৌতুকে আছে: ‘দ্রিমু যখন সবট্রাতেই দ্রিমু’! ‘চাইল্ডস’ যে লিখবে, সে ভুল করে লিখবে না, ব্যাকরণ জানে না বলে, অচিহ্নিত নিয়ম নির্বিচারে প্রয়োগ করছে বলেই লিখবে। এ সত্য বা দায় বেমালুম অস্বীকার করে যতই আবোল-তাবোল অজুহাত দেখাবেন, ততই আপনি হাস্যকর হবেন। আগুন লাগলে যেমন পানি ঢালতে হয়, ভুল হলেও প্রথম সুযোগেই ভুল স্বীকার করতে হয়।

যে কারণেই হোক, বাংলাদেশের (পাশ্চাত্যের অবস্থাও আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতামতে এমন কিছু সুবিধার নয়) শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের গ্রহণযোগ্য বানানে ও ভাষায় লিখতে ও বলতে শেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই ব্যর্থতা ঢাকতে শিক্ষার্থীরা, বুদ্ধিজীবীদের একাংশ দোষ দেয় ভাষার। ‘বাংলাটা কেন শেখায় না ইংলিশে!’ জিগ্যেস করাই যায়, কিন্তু ইংরেজির ক্ষেত্রে এ অজুহাত দেবার উপায় নেই। ইংরেজি ব্যাকরণ যে বাংলার চেয়ে মোটেও সহজ নয়, উজানে একাধিকবার আমরা দেখাতে চেষ্টা করেছি।

আকলমন্দ কি লিয়ে ইশারাহি কাফি হ্যায়। লক্ষণ দেখে রোগ বিচার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের করা ইংরেজির উপরোক্ত ভুল নির্দেশ করে যে গড় বাঙালিকে ইংরেজি শেখানো যাবে না, ঠিক যেভাবে গড় ইউরোপিয়কে ল্যাটিন শেখানো যায়নি মধ্যযুগের হাজার বছরে। এই ব্যর্থতার কারণেই মধ্যযুগের শিক্ষাজগতে নিষিদ্ধ একেকটি ছোটলোকের ভাষা: ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্পেনিশ এক সময় শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠেছিল।

শতবর্ষের গবেষণা প্রকল্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা ভাষায় নয়, ইংরেজিতে গবেষণাপত্র লিখতে অনেকটা বাধ্য করেছে তার শিক্ষকদের। ইংরেজি কিংবা বাংলা ভাষা ব্যবহারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে চৌকশ নন, ‘গবেষনা’ ও ‘ফিফটি থ্রিত’ বানান তারই শানে নজুল। ভাষা যদি দুর্বল হয় তবে বিজ্ঞানচর্চা কি ঠিকমতো হবে? মানুষের কঙ্কালের মধ্যে ঢাবির রসায়নের শিক্ষক আরবি শব্দ দেখতেই পারেন, কিন্তু টেলিস্কোপ যদি ভাঙা হয়, সাত আসমানের চাঁদ-সিতারা ঠিকঠাকমতো দেখা যাবে কি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই যখন এই অবস্থা, দাদাও যখন যখন ফেল, ছোটভাইয়েরা অর্থাৎ সরকারি বা বেসরকারি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। মাতৃভাষায় যে দুর্বল, ধাত্রীভাষায় সে মহাবল হবে– এমন আশা আর যাই হোক, ভাষাবিজ্ঞানসম্মত নয়। এমনও হতে পারে, মাতৃভাষা বাংলার দুর্বলতাই ধাত্রীভাষা ইংরেজিতে তাদের দুর্বল থেকে যাবার অন্যতম কারণ।

উনবিংশ শতকের কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন: ‘কতরূপ স্নেহ করি বিদেশি কুকুর ধরি, স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’ কঠিন, অপ্রয়োজনীয়, গেঁয়ো ইত্যাদি বিচিত্র অজুহাত ও অপবাদ দিয়ে মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করার একটা আক্কেল সেলামী ব্যক্তি ও জাতিকে আগে-পরে দিতেই হয়। ঘরের বধু বাংলাকে অবহেলা করে বারোয়ারি ইংরেজির প্রতি অতি মনোযোগের ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে বাঙালির ইহকাল ও পরকাল দুই-ই নষ্ট হতে বসেছে। স্বেচ্ছায় বাংলা ভুলে গিয়ে (যা অস্বাভাবিক) এবং ইংরেজিও না শিখতে পেরে (যা খুবই স্বাভাবিক) বাঙালি যে একটি ‘অর্ধভাষী’ জাতিতে পরিণত হতে বসেছে, ‘গবেষনা’ এবং ‘ফিফটি থ্রিত’ শীর্ষক দুই বানান ভুল প্রকৃতপক্ষে তারই ইঙ্গিতবহ।