মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, শহীদ রাজু গুমরে কাঁদে!

যে রাজু ভাস্কর্য আজ আর দলীয় গণ্ডিতে নয় বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় সব আন্দোলন ও লড়াই-সংগ্রামের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তাকে কেন ঢেকে দিতে হবে?

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
Published : 17 Dec 2023, 02:33 PM
Updated : 17 Dec 2023, 02:33 PM

নির্বাচনী ডামাডোল চলছে। দিকে দিকে গরম হাওয়া— ভোট, ক্ষমতার ভাগ, আসন ভাগাভাগি, আসন সমঝোতা কিংবা অবরোধ-হরতাল। প্রতিদিনই কোনো না কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। মাঝে এক বিকেলে রিকশায় ফিরছিলাম। রিকশাওয়ালা খুবই আগ্রহ নিয়ে ভোটের আলাপ করলেন। তার ভাষ্য, “এরা তো নির্বাচন করব, এই নির্বাচন তো তারা কারও কথায় বন্ধ করব না। যারা ভোট দিবার চায় দিব, আর যারা দিবার চায় না, তারা দিব না। এতে তাগোর কিচ্ছু যায়-আসে না।” কথা খুবই স্পষ্ট এবং সরল।

গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখছি আরও গরম। ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন নেতাকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের ব্যানারে তারা মিছিল করে রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ করার সময়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের ওপর হামলা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ওই ভিডিও ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা ছিল ঘটনার একটি দিক। অন্যদিকে এই ঘটনার পর সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যকে কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে।

শুধু তাই নয়, ছাত্র ইউনিয়নকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে একটি ব্যানারে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিভিত্তিক ছয়টি সংগঠন ঠিক একই সুরে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। এর মধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক হুমকি দিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়ন অবিলম্বে ক্ষমা না চাইলে বড় কিছু ঘটতে পারে। এই হুমকির পরদিনই ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাদের পুনরায় পেটায় ছাত্রলীগ কর্মীরা।

ছাত্রলীগের বক্তব্যও এক্ষেত্রে শোনা জরুরি। তাদের বক্তব্য হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেছে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা। এ ধরনের ঘটনার জন্য তারা ছাত্র ইউনিয়নকে সুস্পষ্টভাবে দায়ী করেছে। আমি ছাত্র ইউনিয়নের একজন প্রাক্তন হিসেবে অবশ্যই মনে করি না যে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের কারও ছবি, পোস্টার কিংবা মঞ্চ ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে কিংবা ঘটানো উচিত। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি কি ছিল তা আমাদের একবার সহজভাবে দেখার চেষ্টা করাটা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়ক দ্বীপের পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য। কে এই রাজু? পুরো নাম মঈন হোসেন রাজু। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আত্মত্যাগকারী এক বীর সেনানী, যিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল করতে গিয়ে এই টিএসসি সড়ক দ্বীপের পাশে ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন তিনি। তারই স্মৃতি ও চেতনার ওপর সন্ত্রাসবিরোধী স্মারক হিসেবে এই ভাস্কর্য বুক ও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।

যে রাজু ভাস্কর্য আজ আর দলীয় গণ্ডিতে নয় বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় সকল আন্দোলন ও লড়াই-সংগ্রামের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তাকে কেন ঢেকে দিতে হবে?

মেট্রোরেলের স্টেশন উদ্বোধনসহ উন্নয়নের প্রচার কিংবা বিজ্ঞাপনের জন্য এই স্মারক ভাস্কর্যকে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ঢেকে রেখেছিল তা কি কারও নজরে পড়েছে? আমাদের চেতনার একটি জায়গায় থাকা একটি একটি স্মারক ভাস্কর্যকে তারা কোন যুক্তিতে, কোন বিচারে কিংবা কোন স্পর্ধায় বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেবার সাহস পায়?

আজকে যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা যা যা করবেন তার ফলাফল একদিন ঠিকই পাবেন। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। স্বৈরশাসক এইচএম এরশাদের দুর্দান্ত প্রতাপশালী ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজ এদেশের সকল ক্যাম্পাসকে দখলে নিয়েছিল। সারাদেশের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার প্রধান শক্তি ছিল তারাই। আর বর্তমান সময়ে ছাত্রলীগকে আমরা দেখছি একই ভূমিকায়। অথচ মুক্তিযুদ্ধে ও গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে ছাত্রলীগেরও ভূমিকাও কম ছিল না। অথচ আজ তারাই কিনা সন্ত্রাস বিরোধী ভাস্কর্যকে ঢেকে দিল!

ভাষা আন্দোলন থেকে জন্ম নেয়া ছাত্র ইউনিয়ন ইতিহাসের প্রতি পরতে পরতে বুনে গেছে সংগ্রামের গল্প। ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর ১১ দফা এবং গণঅভ্যুত্থানে এ সংগঠনের ভূমিকা জাতি ভুলতে পারবে কি? মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ২২ হাজারের একটি গেরিলা বাহিনী নিয়ে প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবীরাই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিল এই ছাত্র ইউনিয়নই, তখন ছাত্রলীগের কোনো পর্যায় থেকে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজকে যখন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ছাত্র ইউনিয়ন একটি সন্ত্রাসী সংগঠন তখন বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু খুবই আগ্রহ নিয়ে এ বক্তব্যকে খণ্ডন করবে এবং ছাত্রলীগের এই দখলদারি, অসহিষ্ণু, খামখেয়ালী মনোভাবকেই দায়ী করবে। এই ছাত্র ইউনিয়নকে যদি কেউ সন্ত্রাসের তকমা দিতে চায়, তাকে ইতিহাস থেকে নতুন করে পাঠ গ্রহণ করতে হবে।

ক্যাম্পাসগুলোকে কারা দখলদারিত্বের কেন্দ্রে পরিণত করেছে তা আমরা খুব ভালো করেই জানি। কারা এক-একটি হলকে কারাগারের মতো বানিয়েছে, গেস্টরুম কালচার, জোর করে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ কারা করছে তা সকলেরই জানা।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও পোস্টার সারাদেশময়। দলীয় প্রচার-প্রচারণায় ও বর্তমান সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার নানান তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দলীয়ভাবে নানা প্রচারণা দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করা হয়ে থাকে, মানুষ সেটা দেখেছে। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী স্মারক একটা ভাস্কর্যকে কেন ঢেকে ফেলতে হবে? এই তথ্যটি কি প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জানেন? যদি না জেনে থাকেন, তবে আমি প্রত্যাশা করব এই তথ্যটি যেন তার নজরে আনা হয়।

শুরুতে বিজ্ঞাপনে ঢাকা এবং পরে কালো কাপড়ে মুড়ে দেয়ার মতো ঘটনার জন্য ছাত্রলীগকে অবিলম্বে জাতির সামনে ক্ষমা চাইতে বলা হোক। সন্ত্রাসবিরোধী ভাস্কর্যের সামনে আবারও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী চরিত্রকেই জাতির সামনে তুলে ধরছে।

ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। এই ক্ষমতার বিদায় হবে কিন্তু রাজনীতিতে এমন অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এই বোধকে আর ধারণ করতে পারবে বলে মনে করি না। শহীদ রাজু এবং তার স্মৃতির প্রতি নির্মিত সন্ত্রাসবিরোধী ভাস্কর্য সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ডাক দিয়ে যায়। আমরা সেই ডাক শুনতে পাচ্ছি কি?