অনেকেই চিন্তিত ছিলেন যে শ্রম আদালত হয়তো ইউনূসের মতো একজন মহা শক্তিমান লোকের বিরুদ্ধে রায় দিতে সাহস করবে না। কিন্তু সকলের হেন উৎকণ্ঠা জলে ফেলে দিয়ে ওই আদালত প্রমাণ করল বাংলাদেশের উঁচু-নিচু কোনো আদালতই ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব বলয় দেখে বিচার করে না।
Published : 05 Jan 2024, 07:35 AM
২০২৪ সালের প্রথম দিনই আমাদের তৃতীয় শ্রম আদালত বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিলেন কিভাবে একজন প্রবল পরাক্রমশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে রায় প্রদান করে আইনের শাসনের মন্ত্রকে জীবিত রাখতে হয়। আদালত নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের জন্য ৬ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
এটি দেখার মতো যে উল্লেখিত রায়টি অশেষ ক্ষমতাশালী সাংবিধানিক আদালত, অর্থাৎ হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট প্রদান করেনি, করেছে নিম্ন আদালতের শ্রেণিভুক্ত এক বিচারালয়। রায়ের আগে অনেকেই এই নিয়ে চিন্তিত ছিলেন যে শ্রম আদালত হয়তো ইউনূসের মতো একজন মহা শক্তিমান লোকের বিরুদ্ধে রায় দিতে সাহস করবে না। কিন্তু সকলের হেন উৎকণ্ঠা জলে ফেলে দিয়ে ওই আদালত প্রমাণ করল বাংলাদেশের উঁচু-নিচু কোনো আদালতই ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব বলয় দেখে বিচার করে না। বিচার করে ন্যায়দণ্ড সামনে রেখে।
ড. ইউনূস যে শুধু একজন নোবেল বিজয়ী, তা নয়। তিনি এক সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রভাব এতটাই প্রখর যে বলা হয়ে থাকে তিনি পদ্মা সেতুতে প্রতিজ্ঞাকৃত ঋণ প্রদান থেকে বিশ্বব্যাংককে বিরত রাখতে সফল হয়েছিলেন মার্কিন সরকারের সহায়তায়। গোটা বিশ্বের কাছে ড. ইউনূসকে মার্কিন সরকারই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বদান্যতার কারণে তিনি জাতিসংঘেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করতে পেরেছেন। এমন এক দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ব্যক্তিকে সাজা প্রদান করা সহজ ছিল না। কিন্তু সেই কঠিন দায়িত্বটি পালন করে তৃতীয় শ্রম আদালত প্রমাণ করলো যে ভয়হীনভাবে বিচার করাই আইনের শাসনের অমোঘ নির্দেশ, যে নির্দেশ বাংলাদেশের বিচারকগণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
চার শতাধিক বছর আগে প্রখ্যাত বৃটিশ মনীষী ডা. থমাস ফুলার বলেছিলেন “তুমি যত বড়ই হও না কেন, আইন তোমার চেয়েও বড়।” সেই অমূল্য বাণী ষাটের দশকে যুক্তরাজ্যের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বিচারক হিসেবে পরিচিত লর্ড ডেনিং পুনরোল্লেখ করেছিলেন বৃটিশ অ্যাটর্নি জেনারেল (যিনি যুক্তরাজ্যের একজন মন্ত্রী) এর বিরুদ্ধে রায় প্রদানকালে। সেই অখ-নীয় বাণীতেই রয়েছে আইনের শাসনের মূল মন্ত্র, যে নীতি নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধু এটিকে আমাদের সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। একই নির্দেশনা রয়েছে ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায়ও। বিগত ১৫ বছর ধরে আমাদের আদালতসমূহ এই তত্ত্বের প্রতি রয়েছে অবিচল।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। শ্রম আইনের একাধিক নির্দেশনা লঙ্ঘন করে তিনি তারই কোম্পানির শ্রমিকদের বঞ্চিত করেছেন তাদের প্রাপ্য অর্থ থেকে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন ভঙ্গ করে তিনি সে সমস্ত শ্রমিককে স্থায়ী পদ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন যারা কৃতিত্বের সঙ্গে প্রশিক্ষণকাল শেষ করেছেন। ড. ইউনূস এসব ঘটনা অস্বীকার করেননি, বরং তার সিদ্ধান্তগুলোকে যৌক্তিক বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন। মামলা চলাকালে তাকে পরিমিত সময় এবং সুযোগ দেয়া হয়েছিল আত্মপক্ষ সমর্থনের। বাদী পক্ষের সাক্ষীদের তার আইনজীবী দিনের পর দিন জেরা করেছেন বিনা বাধায়। এমনকি তিনি মামলাটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, আপিল বিভাগ পর্যন্তও গিয়েছিলেন কিন্তু আইন এবং ঘটনা যখন তার বিপক্ষে, তখন তাকে সাজা ভোগ করতেই হবে, এটিইতো আইনের শাসনের কথা।
উল্লেখ্য যে অতীতে আয়কর সংক্রান্ত এক মামলায় ড. ইউনূস তার বিরুদ্ধে আনা প্রতারণার অভিযোগ স্বীকার করে অবশেষে আদালতের রায়ে আয়কর কর্তৃপক্ষকে তাদের আইনসঙ্গত দাবি অনুযায়ী কর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ড. ইউনূসের দাবি ছিল যে যেহেতু সংস্থাটি একটি ট্রাস্ট, তাই সেটি আয়কর আইনের বাইরে। অথচ সেই ট্রাস্টের সুবিধাভোগী ড. ইউনূস নিজেই। সেটি কুমুদিনী ট্রাস্টের মতো কোনো দাতব্য ট্রাস্ট নয়। তার দাবি যে প্রতারণামূলক ছিল তা প্রমাণে অসুবিধা হয়নি। ইউনূসের কর্মচারীরা তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা করলে তিনি কর্মচারীদের নেতৃবৃন্দকে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে হাত করার চেষ্টা করেছিলেন, যে অভিযোগও লুকিয়ে রাখা যায়নি, কেননা তিনি যে তার সে সময়ের আইনজীবীর মাধ্যমে বিশাল অংকের টাকা প্রদান করেছিলেন। ইউনূস শ্রম আদালতে তার সে সময়ের আইনজীবীকে কয়েক কোটি টাকা শুধু ফিস হিসাবে প্রদান করেছিলেন, যা কিনা মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিকে অবাক করেছিল। মাননীয় বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছিলেন পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ আছে কিনা যেখানে একজন আইনজীবীকে এতো বিশাল অংকের ফিস দেয়া হয়। সে আইনজীবী হলফনামার মাধ্যমে মহামান্য হাইকোর্টকে উপরোক্ত ঘটনাগুলো জানিয়েছিলেন।
আমাদের শ্রম আদালতগুলো এক অর্থে আন্তর্জাতিক আইনেরই অংশ, কেননা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নির্দেশনা এবং বিধান মোতাবেকই এই আদালতগুলোর সৃষ্টি এবং এখতিয়ার। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ বিচারিক আদালতে হয়েছে, সে সকল অভিযোগ আইএলও’র বিধান পুষ্ট। সুতরাং এখানে বিতর্কের সুযোগ নেই। তাছাড়া ইউনূস শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ী আপিল করতে পারবেন এবং আপিল করার শর্তে তাকে বিচারিক আদালত জামিন দিয়েছে। শ্রম আদালতগুলোর শীর্ষে থাকেন একজন চেয়ারম্যান, যিনি সিনিয়র জেলা জজের মর্যাদা সম্পন্ন। সাধারণত এমন ব্যক্তিকেই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় যিনি অতীতে জেলা জজ হিসেবে কর্তব্য পালন করেছেন। নিম্ন আদালতের অন্যান্য বিচারকের মতো শ্রম আদালতের চেয়ারম্যানদেরও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হাইকোর্ট, তারা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। আদালতে শ্রমিক এবং মালিক উভয় পক্ষের প্রতিনিধিও থাকেন।
কিছু লোক, যারা নিজেদের সুশীল সমাজের রক্ষক বলে দাবি করেন, উল্লেখিত রায়ের সমালোচনায় মেতে উঠেছেন। অথচ মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তারা খুব কমই জানেন। যারা আইনের শাসন মেনে চলা রায়ের বিরোধিতা করেন, কোনো মানদণ্ডেই তাদের সুশীল বলা চলে না। বিদেশ থেকে যে সকল ব্যক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ড. ইউনূসের পক্ষ হয়ে, হিলারি ক্লিনটনের প্ররোচনায় চিঠি লিখেছিলেন তাদের অনেকেই স্বীকার করেছেন যে মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। তিনি নোবেল বিজয়ী বলে তাকে ধোয়া তুলসী পাতা ভাবা নিশ্চিতভাবে অযৌক্তিক।
পাশের দেশ মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় আদালত অং সাং সুচিকে বিভিন্ন অপরাধের জন্য কারাদণ্ড দিয়ে প্রমাণ করেছেন নোবেল বিজয়ী হওয়া মানে বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া নয় এবং নোবেল বিজয়ী হলেই ধরে নেয়া যাবে না যে তিনি অপরাধ করতে অক্ষম। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতও সুচির বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের তদন্তে নেমেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতসমূহে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে। অতীতে সে দেশেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ডমিনিক স্ট্রস কানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে বিচার হয়েছে। প্রাক্তন ফরাসী প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজির বিচার প্রমাণ করছে যে বড় মাপের মানুষ হলেই তিনি অপরাধ মুক্ত হবেন বা বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবেন, এমনটি হতে পারে না।
এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ড. ইউনূস অর্থনীতিতে নোবেল পাননি, পেয়েছেন শান্তিতে। অথচ তিনি কখন কোথায় কিভাবে শান্তিতে অবদান রাখলেন এটা কারোরই জানা নেই। শান্তির জন্য নোবেল পাওয়া অনেকের হাত রঞ্জিত ছিল বহু মানুষের রক্তে। হেনরি কিসিঞ্জার চিলি, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং এমনকি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার জন্য দায়ী হওয়ার পরেও তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, যা তার সঙ্গে ভিয়েতনামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লি ডাক থু শেয়ার করতে অস্বীকার করেছিলেন। ইসরাইলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন হাজার হাজার প্যালেস্টাইনবাসীকে হত্যা করেও নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এসব ঘটনা শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারকে প্রায়ই বিতর্কিত করেছে। ইউনূসও সে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। সবচেয়ে বড় কথা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রায় দেয়ায় নিরঙ্কুুশভাবে প্রমাণিত হলো যে বাংলাদেশে আইনের শাসনের চর্চা প্রশংসনীয় এবং অনুকরণযোগ্য।