আইনের ভাষা এবং আদালতে বাংলা চালুর অভাবিত দিকসমূহ

আইন হলো ক্ষমতার কাছের, মানুষ থেকে দূরের বিষয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, আইনের আলাপ সাধারণ মানুষের কাছে কোনো প্রিয় বা অপরিহার্য আলাপ না। আমাদের দেশের লোকে বিপদে না পড়লে বা বাধ্য না করলে আইন-আদালতের বারান্দা মাড়াতে চায় না।

সাঈদ মাসুদ রেজাসাঈদ মাসুদ রেজা
Published : 20 Feb 2024, 07:25 PM
Updated : 20 Feb 2024, 07:25 PM

এটা বেশ জনপ্রিয় মত যে, বাংলা ভাষা এবং আইনের মাঝে একটি বিয়োগাত্মক সম্পর্ক আছে। অনেকেই এই সম্পর্কের সুলুকসন্ধান করেন বাংলা ভাষা এবং আইনের ঔপনিবেশিক পর্বের ভেতরে। বাংলা ভাষা এবং এই অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রচলিত আইন যখন আমাদের পরিচিত আকার লাভ করছে, তখনই কিছু বিয়োগের ব্যাপার ঘটেছে; কিছু বিষয়কে উপেক্ষা করে আইন রচিত হয়েছে বা আইনের প্রয়োগ হয়েছে— যা ঔপনিবেশিক শাসনের জন্যে হয়তো অপরিহার্য ছিল। যেমন, একটা দৃষ্টান্ত বোধহয় দেয়া যায়, উনিশ শতকে যখন ভারতবর্ষের জন্যে একটি দণ্ডবিধি প্রণয়নের কাজ চলছিল, সেই কাজের সূত্রধর ছিলেন লর্ড মেকলে। মেকলে বিস্তর জানাশোনা লোক হলেও, ভারতীয়দের বিদ্যাবুদ্ধি সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ছিল খুবই অবমাননাকর। ১৮৩৫ সালের এক রচনায় তিনি বলছেন, “...a single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia.” মেকলে ভারত বা এর জ্ঞানের ঐতিহ্য সম্পর্কে কতটুকু জানতেন, সেই তর্কে না গিয়েও বলা যায়, মেকলে ভারত বা তৎকালীন বাংলাকে বোঝেননি।

তিনি ভুল বুঝেছেন বা উল্টো বুঝেছেন— যদিও এটা প্রমাণ করা আমার আলাপের উদ্দেশ্য না। তবে, যেটা বলা আবশ্যক মনে করি তা হলো, প্রাচ্যবাদী এইসব ভুল ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার জন্যে জরুরি ছিল। ভারত তথা বিশ্বের অ-ইউরোপীয় মানুষদের ওপর সাদা মানুষের শাসন এবং তার বৈধতার যে বয়ান শত বছর ধরে চলেছে, মেকলের ভুলভাল ভারত বোধন তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এই মেকলে ভারতের জন্যে আইন সংহিতা লিখছেন, তিনি জানেন যে এটি রচনা করছেন সাবজেক্ট রেস বা পরাধীন জনগোষ্ঠীর জন্যে। একটি অধিপতি গোষ্ঠী যদি পরাধীন মানুষের জন্য আইন তৈরি করে, ওই আইন তার অস্থি-মজ্জায়, বয়ানে, ঢঙে, শক্তিতে, বোধনে, ব্যাখ্যায় হেজেমনির চিন্তার প্রতিফলন ঘটাবে। ভারত নিয়ে আইন তৈরি করতে গিয়ে, মেকলে সংখ্যাগুরু ভারতীয়দের চিন্তা, মত বা পর্যবেক্ষণ খুব আমলে নিয়েছেন এমন দলিল আমি দেখিনি। অবশ্য তার দরকার ছিল না। কারণ, ১৮৩০-এর দশকে প্রায় পুরো ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীন, যার অনেক গাঁও-গেরামে অর্ধশত বছর ধরে কোম্পানির আদালত বিচার দিয়ে আসছে। ব্রিটিশ বিচারকেরা ভারতীয় বিচারপ্রার্থী এবং সহকারীদের শক্তি এবং দুর্বলতা যেমন দেখেছেন, তেমনি তারা প্রাক-ঔপনিবেশিক বিচার সম্পর্কেও ধারণা রাখতেন। সন্দেহ নেই, যে মেকলের প্রণীত যে আইন তার ভাব এবং ভাষা দুটোই ইউরোপিয়ান হবে। ওপর থেকে নাজেল হওয়া এই আইন তাই নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষের ভাব এবং ভাষা বুঝতে অপারগ। এই অপারগতা এখনো নানাভাবে জারি আছে। তার আলাপ একটু পরে করছি।

জনগণের ভাব, ভাষা, মেজাজ-মর্জি, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ইত্যাদির সঙ্গে যদি আইনের বয়ান খাপ না খায়, তারপরও তার কাজ চলে। চলে যে, সেই প্রমাণ আমরা পাচ্ছি, গত দুইশ বছর ধরে। এই চলার বহু কারণ আছে। কয়েকটা বলি। ব্রিটিশরা আসার আগেও ভারতে আইন ছিল, বিচার ব্যবস্থা ছিল। সেই আইন পঠন-পাঠন, ব্যাখ্যা ও বোধনে এখনকার মতো কোনো আইনজ্ঞ বা আইনজীবী শ্রেণি তখন ছিল না। লোকে সরাসরি কাজীর কাছে বিচার নিয়ে যেত বা কখনো সম্রাটের দরবারেও যেত। ব্রিটিশদের আমলে দেশে আইনজীবী শ্রেণি তৈরি হলো। আইন নিয়ে যাবতীয় কায়ক্লেশ নিজেরা সামাল দিয়ে মক্কেলদের আইন পড়ার ঝামেলা থেকে রেহাই দিয়ে ফেলেন আইনজীবীরা। এই প্রক্রিয়ার নানা ফল এবং অফল ছিল, আছে। ফল হলো, লোকের অত আইন না বুঝলেও চলত এবং এখনও চলে। অফল হলো, আইনের মতো একটি অতি জীবন-ঘনিষ্ঠ বিষয় গণমানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। আইন হলো ক্ষমতার কাছের, মানুষ থেকে দূরের বিষয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, আইনের আলাপ সাধারণ মানুষের কাছে কোনো প্রিয় বা অপরিহার্য আলাপ না। আমাদের দেশের লোকে বিপদে না পড়লে বা বাধ্য না করলে আইন-আদালতের বারান্দা মাড়াতে চায় না। আইনের এই একচেটিয়াকরণ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জন্যে দরকারি ছিল। যা হতে পারত অক্ষমতার নিদান এবং প্রতিষেধক তা হয়ে উঠল ক্ষমতার ভাষা। আইন ক্ষমতার ভাষা। আইনের এই বৈশিষ্ট্যই অর্থাৎ ক্ষমতার ভাষা হয়ে ওঠাই তাকে বাংলা থেকে দূরে এবং ইংরেজির কাছে নিয়ে আসে। ইংরেজি কেবল একটি ভাষা নেই, বরং তা ক্ষমতার এমন একটি প্রশস্ত বয়ান যার কাছে বহু ভাষা ইতোমধ্যেই নিজের ছাল-বাকল খুইয়ে বসে আছে।

ইতিহাসের এই আলাপ আপনারা সবাই জানেন। এইবার একটু ভাষার দিকে তাকাই। বলে রাখি, আইনের সঙ্গে বাংলা ভাষার যদি কোনো দ্বৈরথ থেকে থাকে, তবে সেই লড়াইকে আপনি ইংরেজির সঙ্গে বাংলার দ্বৈরথ হিসেবেও দেখতে পারেন। কারণ, ইংরেজি এবং আইন দুটোই ক্ষমতার ভাষা। এদের বিপরীতে বাংলা ভাষার অবস্থান ক্ষয়িষ্ণু। এই লড়াইয়ের ফল আমরা জানি। কারণ, এইসব ফলের মাঝেই আমরা বাস করি। যিনি ইংরেজি পড়েন বা যিনি আইন করেন দুই শ্রেণিই দেশে ক্ষমতাধর। আইনের সঙ্গে ইংরেজির এই খাতিরের কারণ শুধুই ক্ষমতা নয়। এর পরিসর আরও বড়। আমাদের দেশের আইন যেই ভাষা থেকে যে ভাব ধারণ করে বেড়ে উঠেছে, তা ইংরেজি এবং ইংরেজের। আরেকটু খোলাসা করে বলি, যারা সমস্যাটিকে কেবলই ভাষার সমস্যা মনে করছেন অর্থাৎ, ইংরেজিকে হটিয়ে বাংলা বসিয়ে দিলেই বাংলার ইজ্জত রক্ষা হবে, তারা কেবল সমস্যার মুখ নিয়ে বসে আছেন। মনের খবর, গহীনের কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না। আমি মনে করি সমস্যাটি কেবল ভাষার নয়, বরং আরও গভীরের।

ঔপনিবেশিক ইংরেজের চিন্তাপদ্ধতি এবং বিচার-বিশ্লেষণ পুরোপুরি রেখে দিয়ে কেবল বাংলা ভাষার সংক্রান্তিতে আসলেই সমস্যা মিটবে কি? যদি ইংরেজির অপসারণ এবং বাংলার বিস্তারণই সমস্যার একমাত্র প্রতিষেধক হয়, তবে আমরা মেকলে সাহেবকে খুব বেশি নিন্দা করতে পারি না। অবশ্য, নিন্দার প্রয়োজন বলেই আমি মেকলেকে নিয়ে আলাপ করছি এমন ভাববেন না। বরং আমি মনে করি ভাষার গভীরে যে প্রচ্ছন্ন যুক্তি আছে, যা বেঁচে থাকে বিকশিত হয় সংলাপে, সাহিত্যে কিংবা সংস্কৃতিতে— তার ভেতর থেকেই একটি দেশের লোকজ আইনের দর্শন তৈরি হওয়া সম্ভব। তাই এক্ষেত্রে, আমার কথা হলো, বাংলাদেশে যদি আদালতে বাংলা ভাষা ইংরেজিকে প্রতিস্থাপন করে বা করতে চায়, তবে সেই একই যুক্তিতে বাঙালির আইন দর্শনও ইউরোপীয় আইন দর্শনকে অপসারণ করতে পারে। যারা কেবল বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠাকেই সমাধান ভাবছেন, তাদের শুরুর সঙ্গে আমি একমত। তবে এটি সমধান নয় কারণ, এই জাতীয় বিবেচনার মূল কথা হলো, আইনের সার্থক অনুবাদ করা, যাতে এতদিন যা কিছু ইংরেজিতে চলেছে এখন তা বাংলাতেও চলতে পারে।

এই ভাবনাটি সুন্দর, জনপ্রিয় তবে একদিক থেকে অন্তঃসারশূন্য। কারণ, ইউরোপীয় চিন্তা-পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশজ আইন দর্শনের জাগরণ ঘটাতে না পারলে, আমাদের প্রস্তাবটি হবে শিকড়ছিন্ন— অনেকটা বাংলা জবানে ইংরেজি আওড়ানোর মতো। ইংরেজের মগজ-মেজাজ জাত আইনের ভাষা বাঙালিকে বোঝে তবে পুরোপুরি বোঝে না। কারণ, বাঙালি এবং ইংরেজের চিন্তাধারা অনেক ক্ষেত্রে মিললেও, অনেক ক্ষেত্রেই মেলে না। আমাদের পরিপ্রেক্ষিত, ইতিহাস, সংস্কৃতি আগেও ভিন্ন ছিল, এখনও ভিন্নই আছে। তাই, বদলানোর চেষ্টাটি যদি ভাষা থেকেই শুরু হয়, হোক। আমি এর পক্ষে। কিন্তু, ভাষাতেই যেন এর শেষ না হয়।

ইউরোপীয় চিন্তায় রেনেসাঁর পরে যে যুক্তিবাদিতার বিকাশ ঘটেছিল, তার প্রভাব আপনার ঔপনিবেশিক আইনেও দেখতে পাবেন। আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত প্রতিটি আইনই ধরে নিয়েছে, মামলা হবে দুজন Reasoned Man বা যুক্তিবাদী মানুষের মাঝে। এই মানুষগুলো, ঠিক ইউরোপিয়ানদের মতো চিন্তা করবে। ভারতে বা বাংলাদেশের মানুষের যুক্তিবাদিতা আছে, তবে তা সবসময় ইউরোপীয় পথ বেয়ে এগোয় না। একটা উদাহরণ দিই। বাংলাদেশে কেউ যদি না জেনে কোনো ভুল বা অন্যায় করেন, আমরা অনেক সময় তা ক্ষমা করে দিই। কারণ, আমরা ধরে নিই, না জানার কারণেই এটি হয়েছে। পক্ষান্তরে, ব্রিটিশ আইন দর্শন রোমান চিন্তা থেকে ধার করে আমাদের বলছে যে, Ignorance of Law is no excuse। অবশ্য এর পেছনেও যুক্তি আছে, কিন্তু সেই আলাপ এখানে করছি না। একইভাবে, ইংরেজিতে লেখা কোনো আইন শাস্ত্রের বইতে দেখবেন, প্রথা বা কাস্টম হতে গেলে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। বলা হচ্ছে, প্রথাকে আইনের উৎস হতে গেলে, তাকে ১১৮৯ সালের আগে থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু থাকতে হবে। এই রকম একটি শর্ত, ঐতিহাসিকভাবে ইংল্যান্ডের জন্য যতটা প্রাসঙ্গিক, আমাদের জন্য ততটাই অপ্রাসঙ্গিক। ১১৮৯ আমাদের জন্যে কোনো বিশেষ সাল নয়। তখনকার বাংলা, বাঙালি ইত্যাদি বিষয় নিয়েও নানারকম ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, আরেকটি বিষয় বলে রাখি। খুব মনোযোগ দিয়ে যেকোন আইন পড়লে আপনারা এর ভাষার জটিলতায় আহত হতে পারেন। ইংরেজি অথবা বাংলায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি না থাকলে আপনি বাংলাদেশের অনেক আইন পড়ে কিছুই বুঝবেন না। ভাষার এই জটিলতা কিন্তু অযৌক্তিক না। এর কারণ আছে। আইন পুরোপুরি ভাষানির্ভর বিষয়। শব্দ নিয়ে কিংবা তার অর্থ নিয়ে বা মোদ্দা কথায় ভাষা নিয়ে যত কাজ, যত সৃজনশীলতার চর্চা আইনের মানুষদের প্রতিদিন করতে হয়, ততটা আর কোন পেশার মানুষের লাগে কিনা সন্দেহ। যে কোনো আইনের টেক্সটে লিখিত প্রতিটি শব্দের, দাড়ি, কমা, সেমিকোলন এবং হাইফেনের অর্থ আছে। দেখবেন, আইনের প্রকাশভঙ্গিতে এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা আছে। অনেক শব্দের একাধিক অর্থও আছে। এই বিষয়গুলো আইনের ব্যাখ্যাকে সৃজনশীল করে তোলে। ফলে, যেকোনো আইনের একটি ধারার অনেকগুলো ব্যাখ্যা সম্ভব, যার সবগুলোই একসঙ্গে সঠিক আবার ভুলও। এই ব্যাপারটিই আইনের ভাষার নিজস্বতা, একই সঙ্গে এর শক্তি এবং দুর্বলতাও। ফলে, কোনো আইনের ধারা পড়ে আপনি যা বুঝলেন, ওই বাক্যে তা-ই বলা হয়েছে— এটা নাও হতে পারে। এর ব্যাখ্যা যদি আপনি কাউকে জিজ্ঞেস করেন, দেখবেন নানা মুনি নানা মত দিচ্ছেন।

যেমন ধরা যাক, ইংরেজি People শব্দটি। এই শব্দটি একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের আইনে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু, এই People আসলে কারা এটি নিয়ে আইনজ্ঞরা একমত হতে পারেননি। কেউ মনে করেন, একটি দেশের প্রতিটি নৃগোষ্ঠীই একটি People। আবার কেউ ভাবছেন, কেবল মাত্র সংখ্যাগুরুরাই পিপল, বাকিরা নয়। আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত পিপলের সংজ্ঞা নিয়ে হাজারের ওপর পত্র লেখা হয়েছে, কিন্তু কোনো মতৈক্যে পৌঁছানো যায়নি। তার মানে, স্পষ্টভাবে লিখিত আইনেও রয়েছে নানারকম অস্পষ্টতা। আইনের এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয়, Indeterminacy of Laws; বলাবাহুল্য যে, এই বিশেষত্ব আইনকে খুব সৃজনশীল বিষয়ে পরিণত করেছে। এবং একই কারণে, আইন পড়া এবং না পড়াও প্রায় সমান হয়ে গেছে। আমার কথা হচ্ছে, আইনের ভাষায় এত অস্পষ্টতা রেখে দিয়ে খালি ইংরেজির বদলে বাংলা আনলে কোনো লাভ হবে না। কারণ, যে আইন পড়ে লোকে কিছু বোঝে না বা দুর্বোধ্যতা হেতু পড়তেই চায় না, সেই আইন বাংলা, কি ইংরেজি, নাকি ফারসি— যে ভাষাতেই লেখা হোক, তা দিয়ে সমাজ বদলাবে না। ব্যাখ্যার পর্যাপ্ত সুযোগ রেখে দিয়েই, আইনের ভাষার সহজীকরণ করতে হবে, যাতে লোকে তা পড়ে বুঝতে পারে। এবং এটা সম্ভব।

পৃথিবীর বহু দেশের আইন সংহিতার জননী নেপোলিয়নের কোড যখন লেখা হচ্ছিল, তখন সম্রাট নেপোলিয়ন নিজে উপস্থিত থাকতেন। এর রচয়িতারা আইনের কোনো একটি বিধান নিয়ে আলাপের সময় এবং তা লিখিত রূপ দেবার পর সম্রাট তা নিজে শুনতেন এবং তা সহজ ও বোধগম্য হয়েছে এমন মনে হলেই সেটির অনুমোদন দিতেন। আপনারা নেপোলিয়নের কোড পড়লে দেখবেন এর প্রতিটি ধারা খুবই সহজ ভাষায় লিখিত। আইনের এই সহজীকরণটি জরুরি, কারণ আমি মনে করি আইন তখনই সমাজের জন্যে একটি কার্যকর বিধান এবং নৈতিক প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে পারবে যদি এর ভাষাটি জনগণের বোধগম্যতার মধ্যে থাকে। প্রসঙ্গত এটাও বলে রাখি, আমাদের দেশে লোকে আইনের বিধান সম্পর্কে জানে বা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে মূলত, একটি অপরাধ সংঘটন বা আইনের বিধান লঙঘনের পরে। এটা হয়তো আগেও জানা সম্ভব কিন্তু, বিদ্যমান আইনের জটিল ভাষা, এর অর্থের অনিশ্চয়তা এবং আইনজীবীদের একচেটিয়া রাজত্ব এই ধরনের পাঠাভ্যাসকে অনেকটা দুরুহ এবং কিছুটা অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। লোকে অপরাধ করার আগেই আইন জানলে, আইন কখনো-সখনো একটি নৈতিক ব্যবস্থাপত্র হিসেবে যে ভূমিকা রাখতে পারত, আমাদের সমাজে বিদ্যমান কাঠামোতে সেটা প্রায় অসম্ভব। এই বিষয়টি মাথায় না রেখে শুধু একতরফাভাবে ইংরেজিকে বাংলায় ভাষান্তর করলে সেটা পর্যাপ্ত সুফল আনবে না।

অনেকে মনে করেন, উচ্চ আদালতে বাংলা চালু করার জন্য আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা চালু করাটা জরুরি। এটা আমিও মনে করি। কিন্তু, এই বিষয়ের আগের এবং পরের অবধারিত প্রক্রিয়াগুলোর দিকে কি আমরা নজর দিয়েছি? ধরা যাক, আপনি মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণি এবং পরীক্ষাকক্ষে বলার এবং লেখার ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করা জরুরি। এটা অল্পস্বল্প চালু আছে। সমস্যা হচ্ছে, আইনের মূল এবং আনুষাঙ্গিক টেক্সট বই এবং তত্ত্বগুলোর যেগুলো না পড়ে আইন পড়ে ফেললে আপনার পড়া হয়েছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই (যেমন,প্লেটোর The Laws, রাউলসের Theory of Justice, বা কেলসেনের Pure Theory of Law, বা রুশোর Social Contract অথবা সমসায়িক লেখক কস্কিনিয়েমির From Apology to Utopia ইত্যাদি) এমন প্রায় শতাধিক ক্লাসিক বইয়ের নাম বলতে পারব যাদের একটিরও কোনো সহজ অনুবাদ বাংলায় পাওয়া যায় না। ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো ইংরেজিতে পড়ে সেগুলো নিয়ে বাংলায় আলাপ করবে, লিখবে, পড়বে এই প্রত্যাশা দুরাশা মাত্র। আফসোসের বিষয় হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রচুর পণ্ডিত বের হয়েছেন কিন্তু কেউই গত শতবছরে এমন কোনো বইয়ের মানসম্মত বাংলা অনুবাদ করেননি। দেশের কারও এই নিয়ে চিন্তা আছে বলেও মনে হয় না। বলা প্রয়োজন যে, এই কাজটি বিরাট, বহুমুখী। এই বিষয়কেন্দ্রিক শক্তিশালী অনুবাদ সাহিত্য না থাকলে আপনার কল্পনা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

আরেকটি বড় বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়া জরুরি মনে করি। আইনের জগতে অনুবাদের যে ধারা চালু আছে, তা রীতিমতো ভীতিকর। বাংলায় অনুবাদ করা আইন পড়লে আপনি বিহ্বল বোধ করতে পারেন, হারিয়ে যেতে পারেন। শুনলে আপনাদের অবাক লাগবে, কিন্তু আইন নিয়ে নাড়াচাড়ার অভ্যাস থাকলে এটা আপনি জানেন, এই দেশে আইন নিয়ে যেটুকু অনুবাদ আছে, তা এতই দুর্বোধ্য যে, এর চাইতে ইংরেজি বোঝা অনেক সহজ। একটা বহুল প্রচলিত শব্দের অনুবাদ নিয়ে বলি; ধরেন, এজমালি সম্পত্তি। কী বুঝলেন? এই বস্তু কি আমরা অনেকেই চট করে বুঝব না। এখন এর ইংরেজিটা দেখেন। এর ইংরেজি হচ্ছে Joint Property। এই রকম আরও অনেক বহুল প্রচলিত পরিভাষা আইনে আছে যার সহজ বাংলা করা কঠিন, তবে অসম্ভব না।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি সাধারণ দিকের আলাপ করতে চাই। এটা অনেকেই জানেন। যত লোকে জানে, তত লোকে এটা বলে না। কারণ, বোধকরি এটা আত্মসমালোচনা। অনেক বাঙালির মনে সবসময় এক ধরনের শ্রেণিকরণ বা হায়ারার্কি কাজ করে। লোকে বুঝতে চায়, ক্ষমতা কাঠামোয় আপনি ওপরের না নিচের দিকের কেউ। ওপরের দিকের হলে আপনি প্রত্যাশিত, সম্মানিত এবং সহজে ও সাদরে গৃহীত হবেন। অবস্থান নিচের দিকে হলে সবটাই উল্টো ঘটবে। অনেকে বলবেন জনমনস্তত্ত্বের এই সংকট ঔপনিবেশিক। আমি কিছুটা মানি, তবে পুরোটা মানি না। কারণ নিজের কাজের অংশ হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে দেখবার সুযোগ হয়েছিল। একটা ঘটনা বলি। আজ যেটা উত্তর প্রদেশ, ব্রিটিশ আমলে সেটাকে আওউধ বা উধ নামে ডাকা হতো। আপনারা জানেন, এই দেশীয় রাজ্যটি ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশরা অপশাসনের অভিযোগ তুলে দখল করে নেয়। ওই সময় সেখানকার ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এই ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে যেসব ঘটনা নিয়ে আলাপ করেছেন তার একটি হলো— একবার আওউধের কিছু স্থানীয় জমিদার ভূমির খাজনা সংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্যে সেখানকার নবাবের দরবারে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, নবাবের প্রাসাদ রক্ষীরা প্রাসাদের দরজা থেকেই বেত্রাঘাত করে তাদের সরিয়ে দিয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ জমিদাররা এরপর স্থানীয় ব্রিটিশ রেসিডেন্টে কাছে এর প্রতিকারের জন্যে যান।

খেয়াল করেন, যারা নবাবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তারা ছিলেন জমিদার, সাধারণ কেউ নন। এদের যারা বেত্রাঘাত করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তারা ছিলেন নবাবের রক্ষীবাহিনী। এখানে কি আপনারা ভারতের জনমনস্তত্ত্বে আশরাফ-আতরাফ শ্রেণিকরণের কোনো প্রতিফলন দেখতে পান? আতরাফের মুখের ভাষা হিসেবে এই প্যাঁকে পড়েছে বাংলাও। ইংরেজি ভাষার যে মান ইজ্জত, তা সম্প্রসারিত হয়ে ইংরেজ শিক্ষিত ব্যারিস্টারদের ক্ষমতা কাঠামোর ওপরে তুলে দিয়েছে। একই কারণে বাংলা এবং বাংলায় শিক্ষিত উকিল শ্রেণি পিছিয়ে পড়েছে।

ইংল্যান্ডে আমি দেখেছি, দুজন ইংরেজ যখন পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করেন,তারা পরস্পরের সমতাকে জানেন এবং সম্মান করেন। কে কতটা ক্ষমতাবান সেই অবস্থান থেকে তারা কখনো আলাপ করেন না। এই সাম্যমনস্কতা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। পক্ষান্তরে, আমরা যখন নিজেরা আলাপ করি, মনে মনে সামনের মানুষটির ক্ষমতা সম্পর্কে হিসেব করা এবং সেই অনুমানের ভিত্তিতে আলাপ চালানোর এই অভ্যাসটি আমি মনে করি, প্রায় নৈমিত্তিক। বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্বের এই সংকট না কাটালে, কেবল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। লড়াইয়ের এই ময়দানটি নিয়ে ভাবা জরুরি, কারণ আমার আশঙ্কা, জনগণের মাঝে ক্ষমতার ভিত্তিতে সব কিছুর শ্রেণিকরণের এই অভ্যাসটি আছে বলেই, ভাষা আন্দোলনের সাতদশক পরও, ভাষার ক্ষমতায়নের নানান আলাপ, হাহাকার এবং আহাজারি এখনও প্রাসঙ্গিক। কেবল রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে এই বিষয়ের প্রতিকার চাওয়া যথেষ্ট নয়, সমাজের গভীরেও নজর দেওয়া দরকার।