জনবহুল গুলিস্তান, লাগোয়া পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, মেডিকেল কলেজ কত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এখানে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড জানান দেয়, এই অঞ্চলে প্রচুর পানি থাকা জরুরি। উন্মুক্ত লেক ও পুকুরে সারাবছর পানি মজুত রাখা যেতে পারে। অগ্নিনির্বাপনে এই পানি কাজে লাগবে, অন্য সময় নাগরিক জীবনে একটুখানি স্বস্তি বিলাবে।
Published : 04 Apr 2023, 06:18 PM
নিমতলীর রাসায়নিক বোঝাই গুদামঘর, তাজরীন গার্মেন্টস, সেজান জুস কারখানা, সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপো থেকে সীমা অক্সিজেন, হাতিমারা পাথারিয়া থেকে রাজকান্দি বন কিংবা ঢাকার বঙ্গাবাজার, একের পর এক প্রশ্নহীন আগুন। নিমিষেই অঙ্গার টাটকা জীবন, বিধ্বস্ত বাস্তুতন্ত্র, চুরমার সংসার, ভষ্ম জীবিকা, বিশৃঙ্খল পরিবার। তদন্ত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করে, মামলা হয়, ক্ষতিপূরণ কিছু দেয়া হয়। কিছু ধরপাকড় চলে। দৃষ্টান্তমূলক কিছুই হয় না। প্রতিবারই দেখা যায় প্রতিটি ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সর্বস্তরের গাফিলতি থাকে এবং অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে এমন ঝুঁকি মোকাবেলার কোনো প্রস্তুতিও সেসব জায়গায় থাকে না। বঙ্গবাজার থেকে শুরু করে কারখানা কিংবা বসতবাড়ি বা মজুতাগারের নির্মাণশৈলী এবং অগ্নিনির্বাপণসহ সামগ্রিক নিরাপত্তা এতো দায়সারা কেন?
৪ এপ্রিল সকালে আগুন লাগল ঢাকার ঐতিহাসিক বঙ্গবাজারে। ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং সাধারণ জনতার চেষ্টায় ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রনে আসে। আগুনে পুড়ে গেছে বঙ্গবাজার, মহানগর, আদর্শ ও গুলিস্তান মার্কেট। ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্যসহ ৮ জন আহত ও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বঙ্গবাজারে আগুন লাগার কারণ এখনো জানা যায়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোশনের মালিকানাধীন বঙ্গবাজার চারটি ইউনিটে বিভক্ত। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, মহানগর কমপ্লেক্স, গুলিস্তান কমপ্লেক্স এবং আদর্শ ইউনিট। ছোট বড় মিলিয়ে দোকান প্রায় দুই হাজার ৩৭০টি।
তবে এই প্রথম বঙ্গবাজারে আগুন লাগেনি। ১৯৯৫ সনে আগুনে ভস্ম হয়েছিল বঙ্গবাজার। অগ্নিকাণ্ডের পর নতুন করে আবার গড়ে তোলা হয় বাজারটি। কিন্তু সেই স্থাপনা ও নির্মাণশৈলীতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি সামাল দেয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করা হয়নি। কারণ এরপর ২০১৮ সনের ২৪ জুলাই আবারও আগুন লেগে গুলিস্তান ইউনিটের বহু দোকান ভষ্মীভূত হয়। ১৯৯৫ থেকে ২০১৮ দুই বারের বড়ধরণের অগ্নিকাণ্ডের পরও বঙ্গবাজার কর্তৃপক্ষ তৎপর হননি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অতি ব্যস্ততম জনবহুল ঘিঞ্জি এই মার্কেটে মূলত বেচাকেনা হয় কাপড়ের মতো দাহ্য উপকরণ। অথচ বারবার আগুনে এর দোকানপাট অঙ্গার হয়, রুটিরুজি নিয়ে পথে বসতে হয় বহু মানুষের। খানখান হয়ে যায় বহুজনের টেনে চলা সংসার। কিন্তু এরপরও এরকম মার্কেটগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করা হয় না। দমকলবাহিনী জীবন দিয়ে আগুন নেভাতে তৎপর হয়। কিন্তু এসব মার্কেট এতো ঘিঞ্জি থাকে যেখানে অগ্নিনির্বাপণের সকল সরঞ্জাম নিয়ে প্রবেশ করা দুঃসহ হয়ে পড়ে। এমনকি এসব মার্কেটে পর্যাপ্ত কোনো পানির ব্যবস্থাও থাকে না, না থাকে চারধারে কোনো উন্মুক্ত অঞ্চল। বারবার এমনি ঘটছে। মার্কেট থেকে কারখানা, বাসাবাড়ি থেকে গুদামঘর অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে আমাদের প্রশ্নহীন অবহেলা বারবার কেড়ে নেয় বহু জীবন ও সম্পদ। অপ্রতুল উপকরণ, সংকীর্ণ পথ, বিপজ্জনক অভ্যন্তর, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং দাহ্য পদার্থের ভেতর এরপরও আমাদের দমকল বাহিনীসহ সকলের অদম্য চেষ্টায় ক্ষয়ক্ষতির প্রবলতা কমে, নেভে আগুন, এও এক চূড়ান্ত বিস্ময়। এমনকি এবারের অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের অফিস ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ২০১৯ সালে বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে তারা নোটিস টানিয়েছিল, কিন্তু মার্কেট কর্তৃপক্ষ সে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি।
কবে আমাদের মার্কেট, ভবনমালিক, কারখানা কিংবা কর্তৃপক্ষের হুঁশ হবে? বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সামগ্রিকভাবে আগুন নেভানো ও জানমালের উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি আশা করি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি আহতের চিকিৎসা এবং ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণে কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্র মানবিক ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে এই রমজানের মাসে, ঈদ উৎসবের আগে যাদের জীবনজীবিকা পুড়ে অঙ্গার হয়েছে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। তাজরীন গার্মেন্টস থেকে সীতাকুণ্ড কিংবা সাম্প্রতিক বঙ্গবাজার প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত গাফিলতি ও অবহেলা প্রমাণিত হলেও রাষ্ট্র মালিকপক্ষকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও দণ্ডের আওতায় আনতে পারছে না। যে কারণে চূড়িহাট্টা থেকে সেজান কিংবা সীমা অক্সিজেন কারখানা কিংবা বঙ্গবাজারে পুড়ছে জীবন ও সম্ভাবনা।
বাসাবাড়ি থেকে কারখানা কিংবা মার্কেট সর্বত্র অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে নিরাপত্তা ও নির্বাপণ বিষয়ে সামগ্রিক জনসক্রিয়তা জরুরি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতি ও অঙ্গীকার সুস্পষ্ট ও জোরালো হতে হবে। বঙ্গবাজারের অঙ্গারের স্তুপে পূর্ববর্তী কিছু অগ্নিকাণ্ডের নির্দয় আহাজারির ছায়াও দেখতে পায় চলতি আলাপ। প্রতিটি বিপদ ও সংকট আমাদের নতুন কিছু বার্তা দেয়। সেই বার্তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন ও জীবিকা বিকাশের নতুন প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু বারবার প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড থেকে আদতেই আমরা কোনো শিক্ষা নিচ্ছি কী? দুর্যোগবিদ্যার বিশ্লেষণে অগ্নিকাণ্ড এক আপদ, যা বিপদ ও ঝুঁকি তৈরি করে এবং পরিস্থিতি সামাল না দিতে না পারলে দুর্যোগ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তো অগ্নিকাণ্ডের মতো আপদ-বিপদ সামালে আমাদের দক্ষতা ও প্রস্তুতিকে সামগ্রিকভাবে সক্রিয় করা জরুরি।
পুড়ে অঙ্গার অরণ্য বাস্তুতন্ত্র, ২০২৩
একে একে পুড়লো দেশের চারধারের বন। হাতিমারা, পাথারিয়া, লাউয়াছড়া, সুন্দরবন থেকে রাজকান্দি। পুড়ে পুড়ে অঙ্গার শত সহস্র বছরের জটিলসব অরণ্য বাস্তুতন্ত্র। নিশ্চিহ্ন বহু লতাগুল্ম, নিরুদ্দেশ বহু বন্যপ্রাণ। ১৯৯৭ সালে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের আগুনে অঙ্গার হয় লাউয়াছড়া। ২০২৩ সাল যেন প্রাকৃতিক বনের জন্য নিদারুণ অশনিসংকেত। এ বছর একের পর এক আগুন লাগছে বনে। চা বাগানের আগুনে পুড়েছে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের হাতিমারা। লোভের আগুনে পুড়েছে গাজীপুরের সখীপুর শালবন। চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের গ্যাস জরিপের নামে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের সাঙ্গাইসাফি, কাঁঠালকান্দি ও বাঘাছড়া টিলাবন পুড়ে গেছে। আর পুড়ছে পাথারিয়া পাহাড়ের সমনবাগ বন। মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় বিস্তৃত পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে লাগানো আগুনে অঙ্গার হয়েছে ধলছড়ি ও মাকালজোরার প্রায় ৪০ হেক্টর বন।
বিস্ফোরিত সীতাকুন্ড, ২০২২-২৩
২০২২ সনের ৪ জুন বিস্ফোরিত হয় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড।বিএম ডিপোর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের নিদারুণ ক্ষত ও দাগ মুছেনি এখনো। নয়টি মাস না যেতেই আবারো বিস্ফোরিত হল সীতাকুণ্ড।ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কদমরসুল (কেশবপুর) এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের’ প্লান্টে ৪ মার্চ ২০২৩ তারিখে ঘটলো আবার বিপজ্জনক বিস্ফোরণ। ঘটনায় নিহত ছয় এবং আহত শতাধিক। ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করে। সীমা অক্সিজেন প্লান্টের দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য নিতে পারেনি গণমাধ্যম, তারা পালিয়ে যান। যদিও পরে মালিককে আটক করা হয়।
‘গ্যাস সিলিন্ডার নীতিমালা ১৯৯১’ অনুযায়ী অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের জন্য বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হয়। সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে কীনা কেউ জানে না। এমনকি এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাটি নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায়ও ছিল না। সীমা অক্সিজেন বা বিএম ডিপো নয়; চট্টগ্রাম বন্দরে এর আগেও বহু রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। ২০১৫ সনের ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে মিথানলভর্তি ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটে, ৪জন শ্রমিক গুরুতর আহত হন ও দগ্ধ হন অনেকেই। ২০২০ সনের ১৫ জুলাই রাতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
সেজান জুস, ২০২১
৭ জুলাই ২০২১ রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপে অবস্থিত ‘হাসেম ফুড বেভারেজ কোম্পানির’ ছয়তালা কারখানাটিতে আগুন লাগে। কর্তৃপক্ষ দরজা তালা দিয়ে দেয়। পুড়ে মারা যায় ৫২ জন শ্রমিক। কারখানাটি কোম্পানির জনপ্রিয় পণ্য ‘সেজান জুস’ কারখানা নামে পরিচিত। নির্দয় ওই অগ্নিকান্ড না ঘটলে হয়তো আমরা ভুলেই যেতাম এই কোম্পানি কেবল অগ্নিকাণ্ড শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করে রাখা নয়, ভেজাল জুসের জন্যও জরিমানা দিয়েছে। ২০১৬ সনের ২১ জুলাই গোদাগাড়ীর সারেংপুরে বিপুল পরিমাণ পঁচা আমের চালান আটক করে পুলিশ। পরে সেজান জুসের কথিত এই পাল্প তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়েও বিপুল পরিমাণ পঁচা আম উদ্ধার করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই তারিখে পঁচা আম দিয়ে জুস তৈরির অভিযোগে সেজান জুসের এই পাল্প তৈরির কারখানাকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
প্রাইম প্লাস্টিক, ২০১৯
ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের’ কারখানায় ২০১৯ সনের ১১ ডিসেম্বর অগ্নিকাণ্ডে ২১ জন নিহত হয়। এর আগেও ২০১৯ সনের ২৫ এপ্রিল এবং ২০১৬ সনের ২৮ নভেম্বর এই কারখানায় আগুন লাগে।
চুড়িহাট্টা, ২০১৯
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে রাসায়নিক বোঝাই এক ভবন বিস্ফোরিত হয় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। দাহ্য রাসায়নিকের কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৭ জন, দগ্ধ আরো ৪ জন হাসপাতালে মারা যান। ২০১৯ সালেই বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জন মারা যান।
টাম্পাকো ফয়েলস, ২০১৬
২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ ও ভবন ধসে ৩৫ জন নিহত হয়। ১২ সেপ্টেম্বর টঙ্গী থানায় হত্যা ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে দুটি মামলা দায়ের করা হয়।
তাজরীন ফ্যাশসন, ২০১২
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় আগুন লেগে ১১৭ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দুইশর বেশি আহত হয়। ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ শোকদিবস পালন করে। পোশাক কারখানায় এত বড় অগ্নিকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এসব কারখানার মূল ক্রেতা করপোরেট কোম্পানিরা কারখানার নিরাপত্তার জন্য অগ্নিনির্বাপণে অর্থ লগ্নি করতে চান না। বিশেষ করে বিশ্বের বৃহৎ করপোরেট ওয়ালমার্ট দেশীয় পোশাক কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিকে আমল দেয়নি।
নিমতলী ট্রাজেডি, ২০১০
পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে অগ্নিবিস্ফোরণ ঘটে ২০১০ সনের ৩ জুন। আগুনে নিহত হয় ১২৪ জন মানুষ। এলাকার দালান ও দোকান বোঝাই ছিল বিপজ্জনক দাহ্য রাসায়নিক। ৫ জুন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষিত হয় এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সেসময় ইংল্যান্ড সফরে ছিল তারা নিহতদের স্মরণে কালো আর্মব্যান্ড পরে খেলায় অংশ নেয়। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, রাসায়নিকের ধোঁয়ার কারণেই বেশিরভাগ মৃত্যু ঘটেছে। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিল, যার অন্যতম ছিল আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেয়া। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ঢাকার আবাসিক এলাকায় প্রায় অনেক দালানের নিচেই নানা রাসায়সিক, দাহ্য পদার্থ, যন্ত্রপাতি মজুত করে গুদাম ঘর বানিয়েছেন বাড়ির মালিক। হরহামেশাই গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু তারপরও একেরপর এক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন গুলো অঙ্গার হতে থাকে।
দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল হতে হবে
দেশে এত যে দাহ্য উপকরণের কারখানা, মার্কেট বা গুদামে আগুন লাগে তার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দরকার। রাসায়নিক বা কাপড়ের মতো দাহ্য পদার্থ আমাদের লাগবে, কারখানা বা মার্কেট ও গুদামও লাগবে। কিন্তু এসব স্থাপনায় কেন অগ্নিনির্বাপণের সুরক্ষাকবচ থাকবে না? কেন মার্কেট বঙ্গবাজারের মতো ঘিঞ্জি হবে? একটুখানি দম ফেলারও জায়গা থাকবে না? প্রতিটি অগ্নিনির্বাপণের ঘটনায় বড় অভাব হয় পানির। আগুন লাগা ভবন, কারখানা বা গুদামে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা থাকে না। এমনকি এসব জনবহুল স্থাপনার আশেপাশে কোনো উন্মুক্ত অঞ্চল বা জলাধারও থাকে না। কেবল পানির ব্যবস্থা করতে করতেই বহু কিছু ভস্ম হয়ে যায়।
বঙ্গবাজারের অবস্থান রাজধানীর খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে। জনবহুল গুলিস্তান, লাগোয়া পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, মেডিকেল কলেজ কত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এখানে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড জানান দেয়, এই অঞ্চলে প্রচুর পানি থাকা জরুরি। উন্মুক্ত লেক ও পুকুরে সারাবছর পানি মজুত রাখা যেতে পারে। অগ্নিনির্বাপনে এই পানি কাজে লাগবে, অন্য সময় নাগরিক জীবনে একটুখানি স্বস্তি বিলাবে। তাছাড়া প্রতিদিন উত্তপ্ত হয়ে ওঠা নগরে আমাদের উন্মুক্ত জলাভূমি ও সবুজ বলয়তো জরুরি। মার্কেট, কারখানা, গুদাম কিংবা স্থাপনা সমূহের নিয়মিত তদারকি করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গাফিলতি কিংবা অবহেলা প্রমাণিত হলে তা বিচারের আওতায় আনতে রাষ্ট্র তৎপর হবে আশা করি। সীতাকুণ্ড থেকে বঙ্গবাজার প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড আমাদের সামনে বহু সতর্কবার্তা হাজির করেছে। এসব বার্তাকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না, প্রতিটি বার্তা নানাভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এসব বার্তা আমাদের আরো বেশি সতর্ক, দায়িত্বশীল, দায়বদ্ধ এবং তৎপর হওয়ার কথা জানায়। আমরা কী তা টের পাই? নাকি আরেকটি নির্দয় অগ্নিকাণ্ডে অঙ্গার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি।