জহির রায়হান– ‘লার্জার দ্যান লাইফ’

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 30 Jan 2022, 10:15 AM
Updated : 30 Jan 2022, 10:15 AM

দজ্জাল রওশন জামিল যেন পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের ফলিত প্রকাশ। আপাত সরল খান আতা আসলে স্বাধীনতাকামী, রাজনৈতিক নেতা আনোয়ার হোসেন সংগঠিত করছেন জনতা, তরুণ রাজ্জাক প্রতিবাদী-বিদ্রোহী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি। এদের সবার চোখে অদূর স্বাধীনতার মায়াঞ্জন ছবির শেষে নবজাতকের আবির্ভাব ঘটে, মুক্তি তার নাম। 'জীবন থেকে নেয়া' সিনেমার সেলুলয়েডে ধরা পড়ে একটি জাতির মুক্তিযাত্রা। যার অধিনায়ক জহির রায়হান। জহির রায়হান নেই পঞ্চাশ বছর হলো। কিন্তু তার 'লার্জার দ্যান লাইফ' ধরনের শিল্পের মধ্য দিয়ে তিনি এখনো রয়ে গিয়েছেন।

৩০ জানুয়ারি, জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস, নাকি মৃত্যু দিবস? বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর লোকেরা। জহির ছিলেন তখন কলকাতায়। এর মধ্যে কয়েকটি তথ্যচিত্রও তৈরি করে ফেলেছেন। দেশে ফিরে তিনি খুঁজতে থাকলেন ভাইকে। তার বিশ্বাস, ভাই এখনো বেঁচে আছেন। একটা ফোন পেলেন তিনি। বলা হলো, মিরপুরে শহীদুল্লা কায়সারকে আটকে রাখা হয়েছে। বিজয়ের আনন্দে বাঙালি উল্লসিত হলেও তখনো মিরপুরে ছিল লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনা, বিহারি আর রাজাকাররা। মিরপুর তখনো মুক্ত হয়নি। বিপৎসংকুল সেই জনপদে তিনি যেভাবে গেলেন, তাতে তার ফিরে আসা হয়ে গেল অনিশ্চিত।

এর আগে জহির রায়হানের ফিরে আসার গল্প। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে একাত্তর সালে বিজয় দিবসের দিন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কলকাতায় অবস্থানকালেই তিনি জানতে পারেন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডা. আলীম চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে তালিকা করে করে ধরে নিয়ে গিয়েছে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর এদেশীয় রাজাকার-আলবদররা। দেশে আসার পর থেকে প্রায় প্রতিটি দিনই কেটেছে হারানো বড়দা প্রখ্যাত সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে খোঁজার প্রয়াসে। সে সময় গণহত্যার তথ্যানুসন্ধানে জহির রায়হানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। সেখানে যুদ্ধের শিকার স্বজনহারা শত শত মানুষ প্রতিদিনই তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতেন। এক সূত্রের মাধ্যমে জহির রায়হান জানতে পারেন, মিরপুরে শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও কিছু বুদ্ধিজীবীকে আটক করে রাখা হয়েছে। ঠিক ওই সময়েই মিরপুর এলাকায় হানাদার মুক্তকরণ ও অস্ত্র উদ্ধারে তৎপর হয় সরকার। ভাইয়ের খোঁজে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও অনুমতি নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে ওই উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন জহির রায়হান।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আবারও যুদ্ধ করতে হবে, এটা ছিল আশাতীত। অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিহারিদের কবল থেকে মিরপুর মুক্ত করতে গিয়ে সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী স্থানীয় অবাঙালি বিহারিদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী। ওই প্রতিরোধযুদ্ধে প্রায় ১০০ বাঙালি সেনা শহীদ হন। আর নিখোঁজ হন জহির রায়হান। সেই থেকে দিনটি পালিত হয়ে আসছিল 'জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস' হিসেবে। কিন্তু ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর দৈনিক ভোরের কাগজ-এ একটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল 'নিখোঁজ নন, গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান'। এর মাধ্যমে জহির রায়হান অন্তর্ধান-রহস্য তাৎপর্যপূর্ণভাবে বাঁক নেয় ভিন্ন দিকে। অনুসন্ধিৎসু রিপোর্টার জুলফিকার আলী মাণিক উন্মোচন করেন রহস্যাবৃত এক ইতিহাসের।

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাসদস্য ও পুলিশ অফিসারদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে জুলফিকার আলী মাণিক সেদিনের ঘটনা তুলে ধরেছিলেন পত্রিকার পাতায়। ওই দিনের যুদ্ধে অংশ নেওয়া আমির হোসেন, যিনি ১৯৮২ সালে নায়েক হিসেবে অবসর নেন, তার জবানি শুনুন, "…আমি সকাল ৯টার দিকে সাংবাদিক সাহেবকে দেখি। পানির ট্যাংকির পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশ সদস্যদের সাথে কথা বলছিলেন। শ খানেক পুলিশ ছিল সেদিন। বেলা ১১টার দিকে ঢং ঢং পাগলা ঘণ্টা শুনতে পাই। গুলি ছুটে আসতে থাকে দক্ষিণ দিক থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই অনেক পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে এবং সেখানেই একটি ইটের স্তুপের পিছনে আমি অবস্থান নিই। তখন তাকিয়ে দেখি, পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিক সাহেবও যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, তার পাশেই পানির ট্যাংকির দেয়ালের পাশে তার দেহ পড়ে আছে।" এই বর্ণনার ধারাবাহিকতায় সৈনিক আকরাম বলেন, "…একদফা গোলাগুলি শেষে তারা একটু দেয়ালের আড়াল নেন এবং দেখতে পান চিৎকার করতে করতে দা-ছুরি হাতে পার্শ্ববর্তী ঘরগুলো থেকে অবাঙালি লোকজন মাটিতে পড়ে থাকা দেহগুলোতে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে এবং কিছু লোক লাশগুলো টেনে-হিঁচড়ে পানির ট্যাংকির পশ্চিম পাড়ে নিয়ে যায়…।" ওই লাশগুলোর মধ্যে সাংবাদিক জহির রায়হানের লাশও ছিল বলে নিশ্চিত করেন সৈনিক আকরাম।

অহিংস আন্দোলনের প্রবর্তক মহাত্মা গান্ধীর জীবনাবসান হয়েছিল হিংসা-মত্ততার কারণে। ইতিহাসের নির্মম পরিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে গণহত্যার রূপ চিত্রায়ণ করা প্রামাণ্য চলচ্চিত্র 'স্টপ জেনোসাইড'-এর পরিচালককেও হতে হলো ১৯৭১-এর মার্চে শুরু হওয়া প্রলম্বিত গণহত্যার শিকার।

পিতাকে পেয়ে 'পিতার অস্থির সন্ধানে' শিরোনামে আমাদের সবার হয়ে পিতাদের জন্য জহির রায়হানের পুত্র লিখেছেন, "মিরপুরের এই নতুন বধ্যভূমির অস্থিগুলো সামনে রেখে নতুন করে আমিও অতীত খুঁড়ে পিতার অস্তিত্ব সন্ধান করলাম। একসময় মনে হতো পিতা এসে দাঁড়াবেন, আমার মাথায় হাত রাখবেন। আমি মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া একটি মাথার খুলির ওপর হাত রেখে চিহ্নিত করতে চাইলাম পিতাকে। হয়তো একই করোটিতে হাত রাখবে আরও কয়েক শ জন, কয়েক সহস্রজন। বলবে, এ আমার পিতা। এই তো আমার ভাই, এই তো আমার বোন…।"