এইডস নিয়ে একুশ শতকেও মধ্যযুগীয় কুসংস্কার

প্রথম আক্রান্তের চার দশক পরেও আমরা অনেকেই জানি না, জানলেও মানি না যে, শুধু যৌন সঙ্গমই এইচআইভি সংক্রমণের একমাত্র কারণ নয়। অন্যান্য কারণেও মানুষ এইডসের নির্দোষ শিকার হতে পারে।

এমামুল হকএমামুল হক
Published : 30 Nov 2023, 07:23 PM
Updated : 30 Nov 2023, 07:23 PM

রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টটা দেখে ডাক্তারকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। কয়েক সেকেন্ড তাকালেন তার দিকে। ধরা যাক, তার নাম আমজাদ হোসেন। চিন্তিত ডাক্তার ডেকে নিলেন আমজাদের সঙ্গে আসা গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী কিশোরকে। জানা গেল, আমজাদ এইচআইভি পজিটিভ। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো তার। হিম হয়ে আসছে শরীর।

‘জীবনে তো কোনো অনৈতিক কাজ করিনি। তাহলে কেন?’ বুকের ভেতর কান্নার রোল! বিচলিত হয়ে পড়লেন আমজাদ। ডাক্তার এইচআইভি সম্পর্কে সব বোঝালেন। মনে পড়লো, মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসার মাস ছয়েক আগের কথা। একবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হয়েছিলেন। তখন ভারতীয় এক সহকর্মী তাকে রক্ত দিয়েছিল। নিশ্চয়ই সেই রক্ত থেকেই শরীরে মরণ রোগের জীবাণু বাসা বেঁধেছে।

 এ ছুটিতেই বিয়ে করার কথা। কিন্তু শুরুর আগেই সব শেষ! মৃত্যুভয়ে বুকটা ক্ষয়ে যাচ্ছে আমজাদের। কীভাবে বাঁচবেন? ক’দিন বাঁচবেন? কী করবেন? কোথায় যাবেন? লোকে জানলে কী হবে? মালয়েশিয়াও তো আর যাওয়া হবে না! মনে দুশ্চিন্তার পাহাড়। ‘‘এইচআইভি পজিটিভ হলেই মৃত্যু অবধারিত, এ ধারণা ভুল। নিয়মিত ওষুধ খেলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মানসিক চাপমুক্ত থাকলে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায়। সংসার, কাজ, সবই করা যায়।’’ ডাক্তারের কথায় আমজাদের মনে কিছুটা আশা জাগলো।

এই দুঃসময়ে পরিবারের সদস্যরা পাশে থাকবে। কথাটা গোপন রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া যাবে। এক বুক আশা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন আমজাদ। কিন্তু কথাটা জানাজানি হয়ে গেল। সেইসঙ্গে যেন অচেনা হয়ে গেলো চেনা পৃথিবীটাও। আপনজনরাও এমন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, যেন অপরিচিত কেউ। আমজাদ ঘরবন্দি হযে পড়লেন।

 পঞ্চায়েতে সালিশ বসলো। পাড়ার লোকজন বলছে, ‘‘মালয়েশিয়া গিয়া খারাপ কাজ করছে। সেই কারণেই তার এইডস হইছে। তারে গ্রাম ছাড়া করণ লাগবো। নাহলে তার থেইকা পুরা গ্রামে এইডস ছড়ায়া পড়বো।’’ রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন আমজাদ।

এরপর গড়িয়েছে অনেক জল। নিঃসঙ্গতার রাহু গ্রাস করেছে প্রতিটি মুহূর্ত। সেই সময় যেন ফেরেশতা হয়ে দেখা দিলেন এক ডাক্তার। তার পরামর্শে একটি এনজিওতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।  এইচআইভি পজেটিভ জেনেও তাকে বিয়ে করেছেন আরেক এইচআইভি পজেটিভ নারী। আমজাদ জানান, তারা সুখে আছেন। নিয়মিত ওষুধ খেয়ে সুস্থ মানুষের মতোই জীবন যাপন করছেন।

আমাদের সমাজে এইচআইভি আক্রান্ত অনেক রোগীর পরিণতি আমজাদের চেয়েও খারাপ হয়। এর কারণ এইচআইভি-এইডস সম্পর্কে সমাজের ভুল ধারণা। লোকজন মনে করেন, এইচআইভি খারাপ মানুষের রোগ। এ রোগ তাদেরই হয়, যারা অনিরাপদ যৌনতায় অভ্যস্ত। তাদের বিশ্বাস, এই রোগ হলে মৃত্যু অবধারিত। সুতরাং কারো শরীরে এইচআইভি ধরা পড়লে সর্ব প্রথমেই তাকে ঘিরে ধরে মৃত্যুচিন্তা। এরপর সমাজ তাকে কীভাবে গ্রহণ করবে সেই দুশ্চিন্তা। এসব দুশ্চিন্তা এইচআইভি আক্রান্তদের জীবনে যে যন্ত্রণা বয়ে আনে, তা তার মৃত্যুকে তরান্বিত করে। ম্লান করে দেয় বেঁচে থাকার আশা। তাই সমাজ ও স্বজন থেকে তারা আড়ালে বা নিভৃতে থাকার চেষ্টা করে। কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। আসলে একঘরে করে রোগীদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়া হয়।

বেসরকারি সংস্থা ‘শিক্ষা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম’- শিসউকের তথ্য বলছে, আমাদের দেশে সর্বপ্রথম যার রক্তে এইচআইভি শনাক্ত হয়, মানুষ তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছে পরিবার থেকে। উচ্ছেদ করেছে বাস্তুভিটা থেকে। এমনও দৃষ্টান্ত আছে যে, রোগীকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল গরাদে। তাকে দেখতে জমেছে হাজারো মানুষের ভিড়। অনেকেই গালাগালি করে বলছে, ‘‘ওকে গুলি করে মারা উচিত।’’ কেউ বলছে, ‘‘না গুলি করে নয়, পাহাড়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।’’ আরেক দলের শঙ্কা, ছাই থেকেও ক্ষতি হতে পারে। একুশ শতকেও আমদের সমাজ থেকে মধ্যযুগীয় সেই কুসংস্কার দূর হয়নি!

বিশ্বে এইচআইভি সর্বপ্রথম শনাক্ত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮১ সালে। আর বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। কিন্তু প্রথম আক্রান্তের চার দশক পরেও আমরা অনেকেই জানি না, জানলেও মানি না যে, শুধু যৌন সঙ্গমই এইচআইভি সংক্রমণের একমাত্র কারণ নয়। অন্যান্য কারণেও মানুষ এইডসের নির্দোষ শিকার হতে পারে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, রোগ সম্পর্কে ভুল ধারণাই আজ এইচআইভি প্রতিরোধের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

মেডিকেল সায়েন্স বলছে, এইচআইভি ছোঁয়াচে নয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে, একই বাতাসে নিশ্বাস নিলে, হাত মেলালে, জড়িয়ে ধরলে, একই পাত্রে খাবার ও পানি খেলে, আক্রান্ত ব্যক্তির সামগ্রী ব্যবহার করলে বা তার ব্যবহৃত টয়লেট ব্যবহার করলে এইচআইভি ছড়ায় না। কিন্তু সমাজে এ নিয়ে রয়েছে ভ্রান্ত ধারণা। একঘরে হওয়ার ভয়ে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীরা তথ্য গোপন করতে বাধ্য হন। যা আমাদের জন্য আত্মঘাতী। জাতিসংঘের এইডস বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইডসের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। এর মধ্যে চিকিৎসা না নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ।

প্রচলিত ধারণা হলো, এইচআইভি পজিটিভ মানেই এইডস। কিন্তু একথা ঠিক নয়। এইচআইভি সংক্রমণ থেকে এইডস হয় ঠিকই। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এইচআইভি পজিটিভ হলেই এইডস হবে। ইউএনএইডস বলছে, আক্রান্ত ৪৭ শতাংশ রোগীতে এইচআইভি জীবাণুর মাত্রা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে। কাজেই এই ৪৭ শতাংশ রোগী এইচআইভি পজিটিভ হলেও এইডস রোগী নয়। এইডস হলো সেই পর্যায়, যখন রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

জরুরি এই তথ্যটি এখনও অনেকেই জানে না যে, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ হলেও যেমন দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায়, তেমনি এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে রেখেও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায়। প্রয়োজন শুধু নিয়মিত ওষুধ খাওয়া। যা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ২৫টি সরকারি হাসপাতাল এবং আটটি বেসরকারি সংস্থায় বিনামূল্যে এইচআইভির চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে এই সেবা যে যথেষ্ট নয়, তা বলাই বাহুল্য। পর্যাপ্ত নয় এইচআইভি বিষয়ক প্রচারণাও। তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদশে জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি যতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, ততখানি ফলপ্রসূ হয়নি আইচআইভি প্রতিরোধ ক্যাম্পেইন। 

এইচআইভি প্রতিরোধে সফল হতে হলে সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। তার আগে জরুরি হলো, এই রোগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করা। এইচআইভি প্রতিরোধে নিতে হবে ব্যাপক প্রচারণার উদ্যোগ। গড়ে তুলতে হবে কার্যকর সামাজিক আন্দোলন। তা না হলে অধরাই থেকে যাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অর্জন। বাধাগ্রস্ত হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্ন।