শিশু শিল্পীর মৃত্যু

আমার আবিষ্কৃত গণিত যেকোনো গোলকধাঁধা থেকে শিল্পীকে উদ্ধার করতে পারে। আমি স্বপ্নের ঘাতক গোলকধাঁধা থেকে তাদের জাগিয়ে তুলি।”

সুধাংশু পূর্বস্বরসুধাংশু পূর্বস্বর
Published : 15 March 2024, 07:49 AM
Updated : 15 March 2024, 07:49 AM

সারা রাত ভ'রে ওরা জন্ম, মৃত্যু, স্বপ্ন ও স্মৃতির উপরে সুদীর্ঘ ছায়া ফেলে রাখা বহু হিংস্র এবং ক্লেদাক্ত ঘটনার সাক্ষী সুনীল সমুদ্রের শব্দ শোনে। ঢেউয়ের ফেনপুঞ্জের দিকে তাকিয়ে থেকেই ওদের দিন কেটে যায়। ওদের এই সমুদ্র নৈঃশব্দকে ভেঙে দিয়েছে, কিন্তু গ'ড়ে তুলেছে এক মায়াবী নির্জনতা। গভীর রাতে যখন পাশুটে চাঁদ কুঁড়েঘরের জানালায় উঁকি দেয় তখন শিশু শিল্পী ভয়ে শিউরে ওঠে। দোলনার ওপর সে ঘুমিয়ে ছিলো, স্বপ্নময়ী হাওয়ার ধাক্কায় দোলনা দুলে উঠতেই তার ঘুম পালিয়ে গেছে আর সে জানালার বাইরে রাত্রির সমুদ্রকে দেখছে এখন।

রাত্রির এই সমুদ্র যেনো এক সুদূরের আভাস আনে। জোৎস্নার আলো যখন সমুদ্রের নীল জলে প্রতিফলিত হয় তখন এক রহস্যময় ও সংবেদনময় দৃশ্যের জন্ম হয়। জনশ্রুতি আছে গভীর রাতে মৎসকন্যারা জলের ওপর উঠে আসে আর যারা তাদের নিস্তব্ধতার সঙ্গীত এবং নৈঃসঙ্গকে নষ্ট করতে চায় তাদের গলায় বসায় ধারালো এক মারণকামড়।

তার মা ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে দিনরাত। এই প্রতিবন্ধী শিশুটিকে হত্যা করার কথা ভাবে সে, যেহেতু এই শিশু তার জন্যে এক লজ্জা, এক ব্যঙ্গচিত্র, এক ভয়াবহ উপহাস। তাই শিশুটির গলায় সে নখ বিঁধিয়ে দিতে চায়। গালাতে চায় ওর দু'টি কদাকার চোখ। আর তারপর ভস্ম ক'রে দিতে চায় আগুনে।

কিন্তু তার মনে অদ্ভুত এক ভয় কাজ করে, কেননা এই শিশু ফিনিক্স পাখির সুরে গুনগুন ক'রে গান গেয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। মায়ের মনে ভয়: যদি এই শিশু ছাই থেকে পুনর্জীবিত হয়?

তাই সে এক মারণ-ফাঁদ পাতার চেষ্টা করে। শিশুটিকে গল্প শোনায় সুদূর সমুদ্রের। সেখানে হাঙর আছে, আছে আরো অদ্ভুত প্রাণী। উড়ুক্কু মাছ, ডলফিন, তিমি, সার্ডিন। দৃষ্টিসীমার বাইরে আছে এক দ্বীপ, ওই দ্বীপে আছে কিছু অদ্ভুত বৃক্ষ আর লতা, যারা শিল্পীদের সংগীত ও ঝংকার বুঝতে পারে আর তাদের ডাকে সাড়া দেয়। মান্য করে প্রতিবন্ধী বা শিল্পীদের নির্দেশ।

    শিশুটি পাঠ করে মেলভিলের মবি ডিক। একটি তিমি শিকারের কাহিনীকে রহস্যীকরণের মাধ্যমে সেখানে এক অপার্থিব রূপ দেওয়া হয়েছে। সে পাঠ করে কালো রোম্যান্টিক সব কবিতা, যা অশুভর ডাকে সাড়া দেয়। কোলরিজ-রচিত একটা অদ্ভুত সুন্দর কবিতা পড়ে সে। কবিতাটাতে সম্ভবত টোটেম বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে। কোলরিজ তাঁর ওই কবিতাটিতে এক বৃদ্ধ নাবিকের বয়ানে একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যেখানে সেই নাবিক একটা আলবাট্রস পাখিকে হত্যা করে এবং কোনো এক অজ্ঞাত ঐশী উৎস থেকে তার জাহাজ আর সহযাত্রীদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ অভিশাপ। সে পড়ে এক ভঙ্গুর বৃদ্ধের সংগ্রামের কাহিনী: বৃদ্ধ সান্তিয়াগো শিকার করেছিলো প্রকাণ্ড এক মাছ। সে মনস্থির করে সে সমুদ্রযাত্রা করবে।

প্রতিবন্ধী শিশুটি সমুদ্র থেকে আগত বাতাসের লবণাক্ত স্বাদ, মিষ্টি গন্ধ আর শীতলতা অনুভব করছিলো। তার মা তার মাথায় সজোরে আঘাত করে ও তাকে ঘুমের জগতে পাঠিয়ে দেয়।

শিশুটি অনুভব করে গভীর সমুদ্র থেকে আগত হাওয়ার আরো সতেজ এক শীতলতা।

 একটি ছোটো নৌকায় সে যাত্রা শুরু করে। উড়িয়ে দেয় পাল। গভীর ও প্রশান্ত হাওয়ার ধাক্কায় দ্রুত বেগে সে এগোতে থাকে। সমুদ্রের জলে সে দেখতে পায় তারাভরা আকাশকে আর ঊর্ধ্বে তাকাতেই সে দেখে রাত্রির অনন্ত সমুদ্রের প্রতিফলন।

সমুদ্রের কোনো এক জায়গায় সে দেখে তিমির নিঃশ্বাসের মায়াবী ফোয়ারা। মেলভিলের মবি ডিকে সে এমনটিই পড়েছিলো। সে আতঙ্কে শিউরে ওঠে আর বুঝতে পারে পরম সৌন্দর্য আবিষ্কারের সময় আসছে।

গভীর জলের সঙ্গীত সে শুনতে পায়। হয়ত কেউ তাকে ভুলাচ্ছে। হয়তো সে শুনতে পাচ্ছে সাইরেনের মায়াবী কণ্ঠস্বর। এইসব স্বর আর সুরের সুষমা তার নৌকাকে ভিড়িয়ে দেয় তার মায়ের মুখে শোনা সেই মায়াদ্বীপে।

প্রবালে গড়া আর দারুচিনির সুবাসে ভরা সেই দ্বীপে সে হাল্কা হাওয়ায় পাতার ন'ড়ে ওঠা আর আলোছায়ার খেলা দেখতে পায়। জোৎস্নার আলোতে প্রজাপতিরা উড়ছিলো। কখনো কখনো সেখানে শুরু হচ্ছিলো পাতা ঝরার খেলা। পাতা ঝরে, যেমন ঝ'রে পড়ে অনাদিকালের নক্ষত্রেরা।

 আলো-ছায়ার সেই প্রাগৈতিহাসিক খেলা তার বুক থেকে গান নিঃসৃত করে। আকস্মিকভাবে সেই গানে সাড়া দেয় বৃক্ষ আর পরজীবী লতারা। তারা বেঁকে-চুড়ে সৃষ্টি করে এক গোলকধাঁধার, যা ছিলো শিশু শিল্পীর আপন সত্তাকে দেখার এক নারকীয় দর্পণ। নিজের সৃষ্টির সৌষম্যে সে নার্সিসাসের মতো আত্মপ্রেমে ডুবে যায়। তাঁর সৃষ্ট গোলকধাঁধা থেকে সে বেরুতে পারে না। তখন তাকে উদ্ধার করে গণিতবিদ ম্যাগদালেন। বৃদ্ধ গণিতবিদ গোলকধাঁধার কেন্দ্রে এসে শিশু শিল্পীকে খুঁজে পায়।

 শিশু শিল্পী আতঙ্কে চিৎকার দেয় ম্যাগদালেনকে দেখে। কিন্তু বৃদ্ধ তাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি কোনো আততায়ী নন, বলেন, “মানবসভ্যতার শুরু থেকেই আমি আছি এই ভয়ংকর দ্বীপে। আমার আবিষ্কৃত গণিত যেকোনো গোলকধাঁধা থেকে শিল্পীকে উদ্ধার করতে পারে। আমি স্বপ্নের ঘাতক গোলকধাঁধা থেকে তাদের জাগিয়ে তুলি।”

দোলনার পাশে দাঁড়িয়ে মা শিশুটির গলা টিপে ধ'রে রেখেছিলো, কিন্তু সে হয়রান হ'য়ে পড়ে, তার মধ্যে জেগে ওঠে মাতৃস্নেহ।

শিশু শিল্পীর ঘুম ভেঙে যায়। সে তার মাকে বলে, “আমি আবিষ্কার করেছি অদ্ভুত এক সৌন্দর্য। আমার গোলকধাঁধাতুল্য শিল্পের নান্দনিকতায় মানবাত্মা খুঁজে পাবে মহা ঐশ্বর্য ও পরম গোলাপকে।”

শিল্পের কথা শুনে তার মা ঘৃণায় আঁতকে ওঠে আর আবারো গলা টিপে ধরে শিশুটির। আবারো শিশুটি সৃষ্টি করে রহস্য বা অতীন্দ্রিয় গোলকধাঁধা, কিন্তু ম্যাগদালেনের কারণে সে এবারও রক্ষা পায়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘ'টে চলে শেষরাত্রি পর্যন্ত এবং শেষরাত্রে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে।

মায়াদ্বীপে পৌঁছানোর পর শিশুটির মধ্যে অতি বিচিত্র এক সৌন্দর্যবোধের জাগরণ ঘটে। স্বর্গের-নরকের সহিংস ও দয়াময় সকল অনুভূতির বিস্তার ঘটে তার মধ্যে। তাঁর ছোট্টো জীবনের নিরর্থকতা ও তাৎপর্যকে সে বুঝে নিতে পারে। তার মনে পড়ে পারস্যের সেই খোজা শিল্পীর কথা, যে শিল্পের জন্যে বিরাট আত্মত্যাগ স্বীকার করেছিলো। মনে পড়ে সেই সুফীর কথা, যার রক্ত বলতে শুরু করেছিলো, “আমিই ব্রহ্ম, আমিই ব্রহ্ম।” শিশু শিল্পীর বুক থেকে মহাজাগতিক এক গান নিঃসৃত হয় আর গ'ড়ে ওঠে সবচেয়ে নিখুঁত এক শিল্পকর্ম, এক অনিন্দ্য গোলকধাঁধা।

শিশুটি সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরুনোর চেষ্টা করে, সে ডাক দেয় ম্যাগদালেনকে। কিন্তু গণিতবিদ ম্যাগদালেন জানায়, যেহেতু এই গোলকধাঁধা মহাজগতেরই সমতুল্য, তাই এই অনিন্দ্য প্রহেলিকা থেকে কেউই কোনোদিন বেরুতে পারবে না।

মায়াদ্বীপ থেকে বহুদূরে দোলনায় দুলন্ত শিশু শিল্পীর গলা থেকে হাত উঠিয়ে নেয় তার মা।

তার প্রতিহিংসা, জিঘাংসা এখন পরিতৃপ্ত।