একদিন 'দপ্তরে' বসে তার মনে হ'ল যে, নারী আসলে সুন্দর নয়, বরং সত্যিকারের সুন্দর হ'ল পুরুষ!
Published : 08 Mar 2024, 12:33 PM
নারীকে 'নারী' হিসেবে দেখার মধ্যে কোনও অসঙ্গতি নেই। নারীও মানুষ। 'নারী' হিসেবে দেখেও তাকে 'মানুষ' ভাবা যায়। কিন্তু, অন্যায় তখনই হয়, যখন তার সত্তাকে খণ্ডিত করে দেখা হয়। অর্থাৎ, শুধুই 'নারী', 'মানুষ' নয় ; আর, এই প্রক্রিয়াটা 'পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি' থেকেই উৎসারিত, 'মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি' থেকে নয়। পুরুষ যখন তার 'পুরুষ' সত্তার ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হয় তখনই এমনটা ঘটে। অতএব, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। 'বিশ্বের যা-কিছু মহান চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।' লিখেছিলেন নজরুল। তিনি 'নারী' লিখে কি ভুল করেছেন? না। অতএব, 'কীভাবে' বলছি এবং 'কী' বলছি সেটাই প্রধান। উত্তমকুমারই প্রথম পর্দায় পরিচয়লিপিতে নায়িকার নাম ( সুচিত্রা সেন ) আগে দেওয়ার প্রচলন করেছিলেন। সেটাও 'নারী' বলে। কিন্তু, তাতে 'অসম্মান' তো ছিলই না, বরং 'নারী' বলেই পরে নাম আসবে, দীর্ঘদিনের এই প্রথা ভেঙে তিনি নারীকে 'সম্মান'ই দিয়েছিলেন। ফলে, আবার বলতে হয়, কোদালকে কোদাল বলার মধ্যে যেমন 'অন্যায়' নেই, তেমনই নারীকে 'নারী' ভাবার মধ্যেও কোনও 'অন্যায়' নেই ; শুধু তার মধ্যে যেন 'নারীও মানুষ' এই ভাবনাটা লগ্ন হয়ে থাকে, যা 'পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি'র ঊর্ধ্বে উঠতে না-পারলে সম্ভব নয়।
বাংলা ছোটগল্পে অনেক উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র আছে। তিনটি চরিত্রের কথা বলি। বনফুলের 'নিমগাছ' গল্পের ছোট বউ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর 'বামা' এবং আশাপূর্ণা দেবীর 'অনাচার' গল্পের সুভাষ-কাকিমা। বামা বুদ্ধিমতী, সাহসী। বুদ্ধি আর সাহস দিয়ে সে ফাঁসুড়ে ডাকাতের পরিবারে আগন্তুক ঠাকুরমশাই-এর 'প্রাণরক্ষা' করে। সে উদ্বিগ্ন তার শিশুপুত্রটিকে নিয়ে। কারণ, 'প্রাণহন্তারক' পূর্বসূরীদের হিংস্র চর্যা থেকে পুত্রকে সে রক্ষা করতে চায়। সুভাষ-কাকিমা স্বামীর মৃত্যুসংবাদ জেনেও মুখ বন্ধ করে রাখে কেবল এই নিষ্ঠুর সংবাদের তুমুল অসহনীয়তা থেকে অসুস্থ, বৃদ্ধ শ্বশুরকে রক্ষা করতে। এজন্য তাকে বাধ্য হয়ে 'সধবা' হয়ে থাকতে হয়, যা সমাজের চোখে 'অনাচার'। কিন্তু, স্বামীকে হারিয়ে কষ্টের পাথর বুকে চেপেও যে 'মানবিক দায়' সে পালন করে তার কাছে সমাজচক্ষুতে উদ্ভাসিত আপাত-অনাচার তুচ্ছ। বনফুলের 'নিমগাছ' গল্পটির শেষে লেখক যা বলেছেন তার সারকথা একদিকে নারীর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আর অন্যদিকে সংসারের মাটিতে তার শিকড় গভীরে চারিয়ে যাওয়া। এভাবে সন্তর্পণে হয়তো বনফুল সাংসারিকতার মধ্যেই নারীর পূর্ণ শোভা মেলে ধরতে চেয়েছিলেন।
বুদ্ধের কাছে আগত শোকবিপন্ন সেই নারী প্রত্যেকটি বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন, মহামতির নির্দেশ মতো। কিন্তু, এমন একটি বাড়িও তিনি পেলেন না, সামান্য একটি শস্যকণাও তিনি করতলগত করতে পারলেন না। কারণ, 'মৃত্যু' নামক রোদনদীর্ণ, দুঃখতাপদগ্ধ পৃথিবীর চরমতম অথচ শান্ত সত্যটি সমস্ত বাড়িকেই ছুঁয়ে গেছে, দেখা গেল। রিক্ত হৃদয়তটে মৃত্যুর ওই দ্বিত্ববাচকতা, 'চরম ও শান্ত', কোনওটাই আমাদের স্পর্শ করেনি। মৃত্যুর অভিঘাতে যে বাহ্য শোকঘূর্ণির উদ্দামতা তার মধ্যে তথাগতের শরণাগত নারীর বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়ার মর্মরধ্বনি আসলেই থাকে না। থাকলে সেই 'চরম'-এর সঙ্গে বিকেলের মরমী আলোর পুণ্যময়তা মিশে থাকা 'শান্ত সত্যটি'ও হৃদয়গত হ'ত। যথার্থ 'ভেঙে পড়া' গড়নের, নির্মাণের তীরে নিয়ে যায়। 'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু...তবু অনন্ত জাগে' এমন করে যে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, কিংবা প্লাবিত জ্যোৎস্নানিশীথে 'কোথাও কিছু কম পড়েনি' এই অনুভবে জারিত হলেন, তার নেপথ্যে তাঁর তুমুল 'ভেঙে পড়া'টিকে আমরা দেখি না। কন্যা মাধুরীলতা, পুত্র শমী কবিকে শূন্য, নিঃস্ব করে গেছে। কিন্তু, 'কোন ভাঙনের পথে' কবি আবার উঠে দাঁড়ালেন, বুদ্ধের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত সেই নারীর মতো সে খেয়ালও তো রাখতে হবে। নইলে, 'অনন্তের বোধ' যে বিমূর্ত ও অধরাই থেকে যাবে! সেটাই হচ্ছেও। বিলীয়মান মৃত্যুতে হোক, অথবা গাঢ়, বিশাল-হাঁমুখ অন্ধকারে, যা সমাজ ও সংসারের সবকিছু গ্রাস করে নিতে উদ্যত, আমরা যে ভেঙে পড়িনি তা আমাদের সেই 'শান্ত সত্যের' কাছে অথবা 'অনন্তের কিনারে' কীভাবে পৌঁছে দেবে? আমরা তো আসলে 'নিবিড় বন্ধু'র মতো 'মৃত্যু ও অন্ধকার'-এর সঙ্গেই আছি ! তাহলে যার সঙ্গে আছি তার বাঁধন ছিন্ন করব কেমন করে ! মৃত্যু ও অন্ধকার-উত্তীর্ণতাও তাই ক্রমশ যেন দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছে!
নারী ও পুরুষের 'প্রেম' নিয়ে জগৎ-সংসারে এত বেশি শব্দ, বাক্য, সুর প্রবাহিত হয়েছে এবং আজও হয় যে, এই বৃত্তের বাইরে আমরা তাকাতেই ভুলে যাই! কথিত 'প্রেম' আমাদের দৃষ্টি, মনন, চেতনাকে এত গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, আমরা 'বৃহৎ সত্যের' প্রতি অভিনিবিষ্ট তেমনভাবে হতে পারিনি। নরনারীর প্রেম উৎসারিত রোমান্টিক মাধুর্য দুজন মানুষের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ। সমস্ত 'লাভ-ক্ষতি'ও নিছক দুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। উপরন্তু, একদা প্রেমের সবুজ আভা কালক্রমে ধূসর, ফিকে হওয়ার আখ্যান আছে। কিন্তু, যে 'বৃহৎ সত্যের প্রতি প্রেম'-এর কথা বলছিলাম তার দীপ্তি কোনও দিনই ম্লান হয় না। জীবনকে দীপ্ত গরিমা দেয়, অর্থপূর্ণ করে তোলে মহার্ঘ কিছু বোধ, আদর্শ ইত্যাদি ; যার একদিকে যদি ব্যক্তি থাকে তাহলে অপরদিকে বৃহৎ বিশ্বমানবের অস্তিত্ব। ক্ষুদ্র বৃহতের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার মাধ্যমে সীমা ও অসীম যেন একসূত্রে গ্রথিত হয়। সার্থক হয় এই রাবীন্দ্রিকতা : ''জীবনে জীবন যোগ করা নইলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হবে গানের পসরা!'' মানবজীবন খড়কুটোর মতো 'তুচ্ছ' নয়। অতএব, 'তুচ্ছ প্রেমেই' কি তার জীবনাবসান হতে পারে? নরনারীর প্রেমে কোনও 'মহিমা' নেই । অতএব, তা তো 'তুচ্ছই'। প্রশ্ন এই যে, নরনারীর প্রেম কি বৃহত্তর মানবচেতনায় প্রাণিত করে তোলে? যদি উত্তর হ্যাঁবাচক হয় তাহলে ঠিক আছে। অন্ধকার থেকে আলোয়, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানে, মৃত্যু থেকে মৃত্যু-উত্তর অমিয় চেতনায় পৌঁছনোই এই জীবনের সারকথা। সংকীর্ণ গণ্ডীবদ্ধ হওয়াতে নয়। 'প্রেরণা'র অনেক গল্পগাছা ঘটা করে শোনানো হয় ঠিকই, কিন্তু...! বুদ্ধ, যীশু, চৈতন্য, মহম্মদ (স)। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে--''..এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে...!" আহা !
আট-ই মার্চ নারী দিবস। এই গৌরবময় দিনটিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ও অন্যত্র নারী সম্পর্কে বা নারীর প্রতি শুরু হয় দেদার বচনামৃত পরিবেশন। কৃত্রিমতা ও আড়ম্বরপ্রিয় মানুষের এর চেয়ে আর কি-ই-বা বেশি করার আছে! দিনের শেষে সূর্য অস্ত গেলে, সারাদিন নারীর প্রতি যত গালভরা সম্মানসূচক বাণী উচ্চারিত হয়, তাও সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই দিগন্তে বিলীন হয়ে যায়! তারপর আবার যথারীতি চলতে থাকে নারীর প্রতি বিবিধ অসম্মান প্রদর্শন, বিভিন্নভাবে নারী-লাঞ্ছনা বা নিগ্রহ---শারীরিক ও মানসিক উভয়ত, পণের দাবিতে বধূহত্যা, 'কালো হরিণ চোখ' নিয়ে যতই উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হোক, বাস্তবে 'কালো মেয়ে'-কে উপেক্ষা-অনাদর ইত্যাদি! খবরের কাগজকেও যথারীতি 'আলোকিত' করবে সেইসব খবর, আর আমরাও সেগুলো পড়ব বড় আগ্রহ নিয়ে, হয়তো রসাস্বাদনের আশায়! কিন্তু, একবারের জন্যেও এই চরম অবক্ষয়িত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে আর ভাবব না! এই হ'ল অবস্থা, যা করুণ ও হৃদয় বিদারক ! আসলে শুষ্ক অনুষ্ঠানপ্রিয়তা যখন তীব্রতর হয়, তখন এটাই দস্তুর হবে ধরে নেওয়া যায়! মনের ভেতরে অফুরন্ত আবিলতা লালন করে, শরীরে রঙচঙে পোশাক ও দামি পারফিউম যতই ব্যবহৃত হোক না কেন, সেই আবিলতা প্রস্ফুটনে তা কি বাধা দিতে পারে?
একটি দৃশ্যপট। আমার বাড়ির সামনের রাস্তাটির সংস্কার হচ্ছিল। উত্তপ্ত ও গলিত পিচ রাস্তায় ঢেলে দেওয়া, দৈত্যসম চলমান রোলার-এর চাকাদুটোকে জল দিয়ে পরিষ্কার করা ইত্যাদি কাজ পুরুষের সাথে সাথে মহিলারাও করছিল। ওই শ্রমজীবী মহিলারা সম্ভবত--সম্ভবত কেন, নিশ্চিতরূপে জানে না যে, আট-ই মার্চ 'নারী দিবস'। ঠিকে মাসি, গৃহনির্মাণ শ্রমিক, সবজি বিক্রেতা, খনি-শ্রমিক, টোটো-চালিকা কেউই জানে না। তারা 'পিতৃতন্ত্র' বা 'পুরুষতন্ত্র' কী তা জানে না, 'লিঙ্গবৈষম্য'ও কী তা তারা শোনেনি, নারীর 'অর্থনৈতিক স্বাধীনতা' কী ও কীভাবে তা তাদের 'মুক্তির উপায়' হতে পারে সে খবরও তারা রাখে না। জানলে কী হ'ত, সে গবেষণাকে দূরে সরিয়ে রেখে এই বেলা অন্তত দ্বিধাহীনভাবে এটা বলা যায় যে, 'সংসার' নামক কঠিন রণক্ষেত্রে তারা সবাই জীবনকে বাজি রেখে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাওয়া একেকজন সৈনিক মাত্র। দিনের শেষে সংসারে দুটো পয়সা নিয়ে আসাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফিরে আবার উনুনে হাঁড়ি চড়িয়ে রান্না করতে হবে, সবাইকে খেতে দিতে হবে, তারপর একচিলতে বিশ্রাম। বাইরে ও ঘরে ঘাম ঝরানো এইসব কঠিন জীবনের মালকিন মহিলাদের অতশত ভাবার সময় কোথায়? তাদের জীবনে 'সুখ' শব্দটি রূপকথার মতো শোনালেও 'শান্তি' সুনিশ্চিত। সলিল চৌধুরী 'কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা'য় সেই অপার্থিব শান্তির বর্ণনা দিয়ে গেছেন। বস্তুত, 'নারী দিবস'-এর সঙ্গে যে 'নারী মুক্তি'র আখ্যান জড়িয়ে আছে তার মধ্যে মিশে আছে একান্তই নাগরিক জীবনের কলরব; যার থেকে বহু যোজন দূরে অবস্থান ওই সমস্ত কঠিন জীবন-সংগ্রামী নারীদের।
কথায় আছে, 'যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে'। অর্থাৎ, কেউ রাঁধছে মানে যে সে চুল বাঁধে না বা বাঁধবে না, কিংবা চুল বাঁধছে বলে রাঁধবে না তা হয় না। আগে জেনে নেওয়া উচিত, দুটি ভূমিকাতেই তিনি সাবলীল এবং সক্রিয় কি না, তারপর আসতে পারে সমালোচনার পালা। দ্বিতীয় কথা, অপরের দায়বদ্ধতার কথা তুলতে গেলে আগে নিজের দায়বদ্ধতার কাটাছেঁড়া করে নেওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ, আরেকটি প্রবাদ স্মরণীয় : 'আপনি আচরি ধর্ম...।' শিল্পীরা 'জনপ্রতিনিধি' হিসেবে কতটা যোগ্য বা সফল, তার মূল্যায়ন শিল্পীর শিল্পচর্চার মাপকাঠিতে হওয়া অযৌক্তিক। যিনি চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজ্ঞ, ব্যবসায়ী, মোটকথা আর পাঁচটা পেশা থেকে যিনি 'জনপ্রতিনিধি' হচ্ছেন, তাহলে তার মূল্যায়নও সেই পেশার মাপকাঠিতে হওয়া উচিত। অথচ, সেটা হয় না। শিল্পীকে 'জনপ্রতিনিধি' হিসেবে নির্বাচন সব দলই করে থাকে। সব দলই তাদের 'জনপ্রিয়তা'কেই প্রাথমিক যোগ্যতা হিসেবে ধরে নেয়। সত্যিকারের 'যোগ্যতা' তো বাস্তবের মাটিতে অবতীর্ণ হওয়ার আগে বোঝার উপায় নেই। সেক্ষেত্রে শুধু শিল্পী কেন, সকলের ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। শিল্পী 'জনপ্রতিনিধি' যদি 'নারী' হয়, তাহলে নিরন্তর তার সমালোচনা তীব্র হয়ে ওঠার মূলে আসলে সমাজের সেই বদ্ধমূল 'মানসিক গঠন' দায়ী, যা প্রতিনিয়ত নারীর প্রতি কেবল 'প্রশ্নবাণ' নিক্ষেপ করতে প্রস্তুত থাকে; স্বভাবতই শিল্পীও তার ব্যতিক্রম নয়। শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক সত্তার মধ্যে 'ভেদরেখাটা'ও সমাজ যেন মানতে চায় না। অথচ, মজার বিষয় হ'ল, সমাজই কি পরোক্ষে শিল্পীকে এমন নানা 'রূপে' প্রকাশ্যে অবতীর্ণ হতে প্রাণিত করে না? শিল্পীর জন্মদিন, বিয়ে, ভ্রমণ ইত্যাদি হরেক বিষয়, যা তুমূলভাবে একান্ত ব্যক্তিগত এবং বৃহৎ সামাজিক উপযোগিতার বিচারে তুচ্ছ ও গৌণ, তা-ও কি সমাজের কাছে 'বিনোদনের' বিষয় নয়? দেখা যায়, 'সেসব' একটি গরিষ্ঠ অংশের মানুষের গভীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বজোড়া হাটে শিল্পীর সবই যেন পণ্য! এখন সমাজ না কি শিল্পী--কে এই 'পণ্য-বিকিকিনির হাট' গড়ে তুলেছে, সে এক মস্ত গবেষণার বিষয়। কিন্তু গোদা বাস্তব হ'ল এই, যাকে অস্বীকার করা যায় না। অতএব, শিল্পী যদি নিজের তাগিদে তার কোনও ব্যক্তিগত বিষয়--তা নাচ, গান, রান্না, খাওয়াদাওয়া যা-ই হোক, সোশ্যাল মিডিয়ায় 'public' করে, তাহলে তাকে 'প্রশ্নবিদ্ধ' করার আর কোনও অবকাশ থাকে কী?
নারী ও পুরুষের সম্পর্কের স্বরূপ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে সমাজে ভাবনা বা চর্চার যে আবর্ত লক্ষ্য করা যায় তা যেন নিদারুণ কোলাহলের মোড়কে বহমান অনন্ত তর্কস্রোত, যা শেষপর্যন্ত একটি অমীমাংসিত উপসংহার উপহার দেয় কেন সেটা একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। আধুনিক যুগে একটি শব্দের বড় প্রবল ও প্রকট অভিব্যক্তি বা অভিঘাত দৃশ্যমান। অসার শব্দটি হল--'প্রতিপক্ষ'। গলি থেকে রাজপথ, ঘর থেকে বাজার সর্বত্রই কেবল 'প্রতিপক্ষ' শব্দটির ঝংকার। রাজনীতিতে 'প্রতিপক্ষ' থাকার যৌক্তিক পরিসর আছে। কারণ, সেখানে 'ক্ষমতা' নামক একটা অকাট্য বিষয় আছে। কিন্তু, পরিবার, সমাজ, শিক্ষালয় ইত্যাদি চলে নিবিড় পারস্পরিকতায়, পরিপূরক সম্পর্কের আধারে। সেখানে 'প্রতিপক্ষ' শব্দটার অস্তিত্ব কতটা বাস্তবসম্মত? প্রাচীনকালে যখন জ্ঞানবিজ্ঞান এত উন্নত ছিল না তখন মানুষ ভেবেছিল যে, পরিবার বা সমাজ সুষ্ঠুভাবে চালনা করার উপায়ই হচ্ছে, কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের সরল সুতোটাকেই একমাত্র শক্ত করে বেঁধে রাখা। তাদের কাছে সামাজিক শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখার এটাই একমাত্র প্রক্রিয়া বলে মনে হয়েছিল। তখনকার প্রেক্ষিতে তারা এর বেশি আর ভাবতে পারেনি। কিন্তু, মহাকাল তো আর একজায়গায় থেমে থাকে না। মানুষের চিন্তাস্রোতও স্তব্ধ, অবরুদ্ধ হয়ে থাকে না । এখন আর কর্তৃত্ববাদী পরিবার বা সমাজের ধারণা প্রাণবন্ত নয়। তার কারণ হ'ল, জ্ঞান, চিন্তা, মূল্যবোধ ইত্যাদি সবকিছুই বিপুলভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এখন সব সম্পর্কেই আমরা 'বন্ধুত্বের উষ্ণতা' খুঁজি। অর্থাৎ, পারিবারিক ও সামাজিক বহুবিধ সম্পর্ক 'বন্ধুসুলভ' হওয়ার প্রতিধ্বনি আমাদের কণ্ঠে ব্যক্ত হয়। এই মানসিক উত্তরণকে অনেকেই যুগসঞ্চিত 'অভিজ্ঞতা'র অভিব্যক্তি হিসেবে দেখেন। কিন্তু, 'অভিজ্ঞতার' চেয়ে 'জ্ঞানের' ভূমিকা এখানে সর্বাধিক। জ্ঞানের বিকাশ না হলে চিন্তার গতি সম্মুখবর্তী হয় না। কিন্তু, 'অভিজ্ঞতাকে' প্রাধান্য দেওয়ার ফলে যুগমানস বা যুগচিন্তাকে বুঝতে ভুল করা হয়। যার ফলে 'প্রতিপক্ষের' আখ্যানও সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। শুধু নারী ও পুরুষের সম্পর্কই কেন, সামাজিক কোনও সম্পর্কই 'প্রতিপক্ষের' বা 'শাসক ও শাসিতের' সম্পর্ক নয়, বরং তা বন্ধুত্বের, সহযোগিতার, সহমর্মিতার। মোটকথা, গাঢ় পারস্পরিকতার। এই আধুনিক চেতনা বা উপলব্ধির বিস্তারই সব বিভ্রান্তি ও অসুন্দর যাপনশৈলীর অবসান ঘটাতে পারে।
আধুনিক নারীবাদীদের নিয়ে একটি সমস্যা হ'ল, তারা নারী ও পুরুষের সম্পর্কটিকে দ্বান্দ্বিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে থাকেন। অথচ, এই সম্পর্কে দ্বান্দ্বিকতা নেই। নেই কোনও বৈরিতা। এই সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরতার, ভরসার, শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপনের। অষ্টপ্রহর 'পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র' এই শব্দগুলির ব্যবহার যে দ্রোহের মানসিকতা থেকে উৎসারিত হচ্ছে তা দিনের শেষে 'তন্ত্রের' বিরুদ্ধে যতটা, তার চেয়ে যেন বেশি 'পুরুষ' বা 'পিতার' প্রতি। তাদের 'পুরুষতন্ত্রের' প্রতি প্রবল দ্রোহভাবে কি 'নারীতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় প্রচ্ছন্ন রয়েছে? এতে লাভটা কী? তাহলে তো আবার একসময় তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ হবে। এবং, এই পরম্পরা কি তাহলে চলতেই থাকবে? সঠিক প্রক্রিয়া এটাই ছিল যে, 'তন্ত্র' জিনিসটার শুদ্ধিকরণ প্রচেষ্টা। তাকে নমনীয় করা, সংবেদনশীল করা, মানবিক করা। বেগম রোকেয়া নারীর শিক্ষা, উন্নতি, প্রগতি ইত্যাদির জন্য সরব হয়েছেন, কিন্তু তিনিও এই দ্রোহবাদী আঙ্গিক গ্রহণ করেননি। আশাপূর্ণা দেবীর কথাসাহিত্যে নারীর অন্তরের কথা, অন্দরের কথা, অধিকারের কথা উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু, তিনিও আধুনিক নারীবাদীদের মতো দ্রোহের শৈলী গ্রহণ করেননি। পুরুষের বিরুদ্ধে 'দ্রোহ' কীভাবে নারীর উন্নতির উপায় হতে পারে তা তাঁদের মতো চিন্তাশীল মস্তিষ্ক ভাবতে পারেনি। আধুনিক নারীবাদীরা দ্বন্দ্ব ও দ্রোহমূলক অবস্থানের চরম শিখর এমনভাবে স্পর্শ করছেন যে, পরিবার ও পারিবারিকতার কাঠামোকেও তারা যেন ক্রমশ ভেঙে ফেলতে চাইছেন। এটা কিন্তু রোকেয়া, আশাপূর্ণা এঁদের কাছে স্বপ্নাতীত ছিল।
বঙ্কিমচন্দ্র যখন 'কমলাকান্ত' তখন কী সব কাণ্ডই না করা হয়েছে! এই যেমন, একদিন 'দপ্তরে' বসে তার মনে হ'ল যে, নারী আসলে সুন্দর নয়, বরং সত্যিকারের সুন্দর হ'ল পুরুষ! যুক্তিগুলোও চমৎকার! যার চোখ নেই, চুল নেই, পা নেই ইত্যাদি তারই কৃত্রিম চোখ, চুল, পায়ের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, যার যা নেই তার সেটাই লাগে। এই যুক্তিক্রম অনুসারে অবশেষে কমলাকান্তের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নারীরা যদি 'সুন্দর'-ই হবে তাহলে তাদের 'এত এত সব' জিনিসপত্র লাগে কেন! কই, পুরুষের তো লাগে না! ভাগ্যিস, কমলাকান্ত ছিল আফিমখোর। অর্থাৎ, নিজেকে বাঁচানোর এ এক জবরদস্ত উপায়! আফিম খেয়ে বলে ফেলেছে! অতএব, কমলাকান্তের কথা না-ধরলেও চলবে! কিন্তু, যদি ধরাই যায়, যেমন রবীন্দ্রনাথের হাসির নাটক 'সূক্ষ্মবিচার'-এ চণ্ডীচরণবাবু কেবলরামকে শেষে 'ধরা', 'মনে করা'র কথা বলছিলেন, তাহলে বলতে হয়, 'সুন্দর' হোক বা না হোক, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হ'ল, 'সুন্দর দেখতে লাগবে কীভাবে' এই মনস্তত্ত্ব থেকেই রূপসজ্জা ও সাজসজ্জার প্রতি অশেষ ও অনিয়ন্ত্রিত ঝোঁক! সেই ঝোঁক নিশ্চয় সমলিঙ্গের প্রতি নিবদ্ধ নয়! নিজের জন্যে কেউ সাজে না। আর, অন্যের চোখে নিজেকে 'সুন্দর' ও 'আকর্ষণীয়' করে তোলার মনোবাসনাটিকেই মূলধন করে বহুবিধ পণ্যের বাজার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। বলাই বাহুল্য, এই রূপসজ্জা বা সাজসজ্জা ক্রমশ নিজের ইচ্ছের নিয়ন্ত্রণে আর থাকেনি। থাকতে পারেও না। সেখানে হয়ে উঠতে হয়েছে 'অন্যের ইচ্ছের' অধীন ; যার একদিকে আছে 'মুগ্ধ' অথবা 'লুব্ধ' হওয়া দুটি চোখ, আর সেই 'চোখের ভাষা' বুঝে লাভের ঝোলা ভরতে থাকা 'পুঁজির বাজার'। এখানে কে 'জয়ী' আর কে আসলে 'পরাজিত' সেটা খুব সহজেই বোঝা যায় !