বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চার মৌলিক নীতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবনের নীতি-আদর্শকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে বলে মনে করছেন লেখক।
Published : 10 Jan 2023, 10:11 PM
বিভিন্ন সভায় আজকাল অহরহ নেতা-কর্মীদের বলতে শোনা যায়, ‘বঙ্গবন্ধু নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে’। আমি খুবই সন্দিহান এসব নেতা কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখেন কিনা। এদের অনেকের সাথে আমি অনেক সময় কথা বলেছি কিন্তু তারা কোন পরিষ্কার ধারণা আমাকে দিতে পারেননি- বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ সম্পর্কে। তবে তাদের কেউ কেউ মনে করেন বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।
না, বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ কোনওভাবেই ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র নয়। এই চারটি বিষয় হলো সংবিধান বা রাষ্ট্রের মূলনীতি, যার দ্বারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পরিচালিত হবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই চার নীতির প্রণেতা ছিলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এগুলোর সব বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নীতি আদর্শ ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ধর্ম পালন করতেন এবং ধর্মীয় অনুশাসনগুলো কঠিনভাবে অনুসরণ করতেন।
এখানে স্মরণ করছি ১৯৭৩ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর থেকে ৯ই সেপ্টেম্বর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় রাষ্ট্র আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনের একটি ঘটনা- অসংখ্য নৈশ ক্লাব আর ক্যাবারের নগরী আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সের একমাত্র ইংরেজি পত্রিকায় তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে প্রায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, The leader without beard; neither visits any night club nor touched drinks In Life. (শ্মশ্রুবিহীন নেতা; যিনি জীবনে কোন নৈশ ক্লাবে যাননি কিংবা মদ স্পর্শ পর্যন্ত করেননি।) আলজিয়ার্সের সমুদ্র সৈকতে ফরাসি জেনারেলদের পরিত্যক্ত কটেজগুলো নবরূপে সজ্জিত করে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্যও নির্দিষ্ট হয়েছিল এই ধরনের একটি সুদৃশ্য কটেজ।
অভ্যাস অনুযায়ী খুব ভোরে একজন মাত্র নিরাপত্তা কর্মী আর দোভাষীকে নিয়ে তিনি প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে ফেরেন তাঁর কটেজে। দেখেন বিরাট আকারের এক মটর ভ্যান সেখানে দাঁড়িয়ে। বুকে নিরাপত্তা কর্মীর ব্যাজ লাগানো দুজন কর্মী তালিকা মিলিয়ে নানা ধরনের খাবার-দাবার, টিন ফুড, মাছ মাংস এমনকি টাটকা শাক-সবজি আর ফল-মূল পর্যন্ত নামিয়ে রাখছে। শেষ আইটেম ছিল কয়েক ক্রেট পানীয়। ক্রেটগুলো নামাবার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু খুবই চঞ্চল হয়ে উঠেন এবং বিকট এক চীৎকার দিয়ে দোভাষীকে তর্জনী তুলে বলেন, “এই কটেজে একমাত্র কোকাকোলা'-সেভেন আপ ছাড়া বিয়ার, হুইস্কি, ভোদকা, জিন, রাম, রেডওয়াইন কিছুই সরবরাহ করা যাবে না।” বিস্মিত দোভাষী জীবনে বহু ভিআইপির সঙ্গে কাজ করেছেন কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কী আশ্চর্য, প্রধানমন্ত্রী মুজিবের গালে শ্মশ্রু আর মাথায় টুপি কোনটাই নেই। অথচ কী ভয়ংকর ইসলামী নীতিবোধ! এরপর স্থানীয় দেহাতী ভাষায় কর্মী দুজনকে বুঝিয়ে বললেন মদের ক্রেটগুলো ফিরিয়ে নেয়ার জন্য।
অতএব এটা স্পষ্ট করেই বলা যায় সংবিধানের মূলনীতি জাতির পিতা বা কারো ব্যক্তিগত নীতি আদর্শ নয়। এগুলো রাষ্ট্রের মূলনীতি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ওই সকল আদর্শ দ্বারা চালিত হবে যাতে একজন সাধারণ নাগরিক তিনি যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন সমান অধিকারের ভিত্তিতে ধর্ম-কর্ম পালন করবেন অথবা করবেন না। ১৯৭৫ সালের ১৪ অগাস্ট রাত পর্যন্ত ‘রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন ছিল না। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে এত আধুনিকভাবে তা প্রয়োগ করেছিলেন যা পশ্চিমা দেশগুলোও পারেনি। আমার প্রায় ২৯ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি জার্মানি যদিও নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো আধুনিকভাবে তারা তা প্রয়োগ করতে পারেনি। এখানকার সরকার ক্যাথলিক ও এভাঞ্জেলিক গির্জাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। প্রত্যেকটি ক্যাথলিক ও এভাঞ্জেলিক অনুসারীকে তার বেতনের ৩ শতাংশ ধর্মীয় কর দিতে হয়। যদি কেউ সেটা না করতে চান, তাকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ধর্মীয় নিরাপত্তা বলয় থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে তার মৃত্যুর পর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কোন রকম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় সাহায্য করবে না। ক্যাথলিক ও এভাঞ্জেলিক গির্জার এই কর সরকারিভাবে বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রদান করা হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক মারাত্মক ধর্ম ব্যবসা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো এখান থেকে হাতিয়ে নিয়ে বিধাতার নামে ধর্ম ব্যবসায়ীদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপনে ব্যয় করছে, যা শুধু অনৈতিক নয় মহাপাপ।
কিন্তু বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সময় তো নয়ই এখনও সরকারিভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এজাতীয় কোন পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না। তবে একথা সত্য জার্মানিতে কাউকে কোন বিশেষ ধর্ম পালনে বাধাদান বা উৎসাহিত করা হয় না এবং কেউ কোন ধর্ম পালন না করলেও তাকে উত্যক্ত করা হয় না। একজন নাগরিক ধর্ম পালন করা বা না করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শগুলো কী? সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব প্রাত্যহিক কার্যক্রমের মধ্যে যে সকল নিয়মনীতি ও ন্যায়পরায়ণতার অনুসরণ করেছেন সেগুলোকে আমরা তার নীতি আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল নীতিমালা অনুসরণ করেছেন তা এক কথায় বলে দেওয়া অসম্ভব। তার সকল নীতি আদর্শকে চিহ্নিত করাও এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা শুধু দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে।
আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষণায় তার অনেক নীতি-আদর্শকে চিহ্নিত করেছি। আজ তার কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করবো। স্বাধীনতার ৫১ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৪৮ বছর পরও আমাদের নেতারা মঞ্চে উঠে শুধু বুলি আওড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ বাস্তবায়নের। অথচ সামান্যতম ধারণা ছাড়া ওই সব নেতারা বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন! এ জাতীয় মুখস্থ বুলি আওড়ানোর কোন অর্থ হয় না। আমি নিশ্চিত জানি এবারও ১০ জানুয়ারিতেও বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবসে এর ব্যত্যয় হয়নি। সবাই মঞ্চে বসে ‘জাতির পিতার নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন’ করেছেন!
বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের কিছু নমুনা
১. ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ একজন বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার জন্মদিনে কী করবেন? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “আমি কেক কেটে জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনই কী আর মৃত্যুদিনই কী, যেখানে প্রতিদিন আমার নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।” অথচ আজকাল প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহ বিভিন্ন জায়গায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা আর উপহারের ছড়াছড়ি। এসব জন্মদিনের অধিকাংশই আবার ভুয়া।
২. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষিত সমাজের চরিত্রের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চের শেষ জনসভায় তিনি শিক্ষিত সমাজের নৈতিক চরিত্রে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু শিক্ষিত সমাজকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, তাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই। তিনি বলেন, একজন কৃষক যখন আসে খালি গায়ে, লুঙ্গী পরে, আমরা বলি, ‘এই বেটা, কোত্থেকে আইছিস, বাইরে বয়।’ একজন শ্রমিক যদি আসে বলি ‘ঐখানে দাড়া।’ ‘এই রিক্সাওয়ালা, ঐভাবে চলিস না।’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষিত সমাজ। তাঁদের তুচ্ছ করেন। এর পরিবর্তন চেয়েছিলেন বাঙালির নেতা, তিনি গরীব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের সম্মান নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এখনও আমাদের দেশে গরীব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের সম্মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, যে পরিবর্তন তিনি চেয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়নি।
৩. বঙ্গবন্ধু নিজের অধিকারের কথা সে যতই পরাক্রমশালী হোন না কেন সরাসরি মুখের উপর বলে দিতে পারতেন। তিনি তার মতপ্রকাশে কখনও মনের মধ্যে কোন জড়তা রাখেননি। একটি দরিদ্র দেশের সরকার প্রধান হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের যেকোনও অযৌক্তিক কথাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যুত্তর দেওয়ার সৎ সাহস ছিল। এ ব্যাপারে তার জুড়িও ছিল না। ১৯৭৩ সালের আলজিয়ার্সে চতুর্থ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন চলার সময়ে বঙ্গবন্ধু একান্তভাবে সৌদি বাদশাহ ফয়সলের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। কথোপকথন শুরু হলে বাদশাহ বলেন, "আমি শুনেছি যে আসলে বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু সাহায্যের প্রত্যাশী। কিন্তু কথা হচ্ছে আপনারা কোন ধরনের সাহায্য চান? দয়া করে বলুন আপনারা কী চান? অবশ্য এসব সাহায্য দেয়ার জন্য আমাদের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে।"
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, "এক্সলেন্সি, বেয়াদবি নেবেন না। আমি হচ্ছি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমার তো মনে হয় না, মিসকিনের মত বাংলাদেশ আপনাদের কাছে কোনও সাহায্য চেয়েছে?" সেদিন কথাবার্তার এক পর্যায়ে সৌদি বাদশাহ প্রস্তাব করেছিলেন বাংলাদেশের নাম ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ করার। বঙ্গবন্ধু তা নাকচ করে দিয়ে বলেন, “পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তো শুধুমাত্র রাব্বুল মুসলেমিন নন- তিনি হচ্ছেন রাব্বুল আলামীনও। তিনি তো শুধুমাত্র মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সবকিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনি হচ্ছেন সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা। এক্সলেন্সি, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনাদের দেশটার নামও তো ইসলামিক রিপাবলিক অব সৌদী অ্যারাবিয়া নয়।"
শেখ মুজিবের মতো নেতা বর্তমান সময়ে বিরল এখন এমন বুদ্ধিমতা ও সাহসিকতার সাথে কথা বলার মত বিশ্বে নেই।
৪. গরীব-দুঃখী-মেহনতী মানুষের সম্মান নিশ্চিতের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শিশুদের প্রাধান্য দিয়েছেন জাতীয় জীবনে। এমনকি তিনিই প্রথম ভেবেছিলেন শিশুদের সুরক্ষায় পূর্ণাঙ্গ একটি আইন থাকা জরুরী। আর এই পথ ধরেই ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতীয় শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আগামী দিনে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দেবে তারাই। ফলে আগে তাদেরই গড়ে তুলতে হবে। যখন তিনি একজন নেতা হয়ে উঠছেন তখনই তিনি তার পরিকল্পনায় শিশু-বান্ধব সিদ্ধান্ত রেখেছেন বলে জানিয়েছেন তার সহযোদ্ধারা।
তখন ১৯৭১- এর মার্চ, বঙ্গবন্ধু একদিন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন আহমেদ সাহেবের বাসার সামনে দিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটা বাচ্চা মেয়ে ‘মুজিব চাচু বলে ছাদ থেকে চিৎকার করে ওঠে।’ গাড়িটা তখন অনেক দূর চলে গিয়েছিল। হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। তারপর আবার পিছে ফিরে আসে। তারপর বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে নেমে, মেয়েটার সাথে কথা বলেছেন। যতদূর জানি এই মেয়েটার নাম ছিল তানিয়া। সে ছিল অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন আহমেদ সাহেবের নাতনি। অধ্যক্ষের সাথে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগতভাবে কোনও পরিচয় ছিল না।
কিন্তু শিশুদের বিকাশে বর্তমান নেতৃত্ব কী বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটাতে পেরেছেন? এখন অনেক ভূমি-দস্যু শিশুদের উদ্যানের জন্য যে জমি বরাদ্দ হওয়া উচিৎ ছিল তা অবৈধ দখল করে বাণিজ্য চালাচ্ছে।
৫. শেখ মুজিবের ধ্যান-জ্ঞান ছিল দেশ ও দেশের জনগণ। তিনি কখনও স্বার্থপরতাকে প্রশ্রয় দেননি। ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে দেশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সে দায়িত্ব না নিতে অনেকেই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- আপনি জাতির পিতা, আপনি কেন যাবেন এরমধ্যে। তাদের মনে সন্দেহ ছিল যে এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ তিনি একা সামাল দিতে পারবেন না। বঙ্গবন্ধু এর উত্তরে আব্দুর রাজ্জাককে বলেছিলেন, “দেখ আমি যদি স্বার্থপর হই তাহলে আমার এই দায়িত্ব নেয়া উচিৎ নয়। কারণ প্রধানমন্ত্রী হলেই আরেকজন আমার বিরোধিতা করবে। আমি যা পেয়েছি পৃথিবীর খুব কম রাষ্ট্রনায়ক এবং ব্যক্তিই তা পায়। কিন্তু তারপরও যদি আমি দেশের দায়িত্ব না নেই তাহলে তোরা ম্যানেজ করতে পারবি না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে স্বীকৃতিগুলি আসবে না। আমি সেই ব্যবস্থাই এখন করছি। যে মানুষ আমার কথায় দেশের জন্য জীবন দিল, সংগ্রাম করলো, আত্মাহুতি দিল তাদের থেকে দূরে সরে যাওয়া আমার জন্যে ভালো হবে না । আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে সেই জাতির ভবিষ্যৎ সংগ্রাম থেকে আমি নিজেকে দূরে রাখতে পারি না।”
৬. বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের বিয়েতে একটা বড় মাছ এসেছিল কন্যা পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনি তা খাননি। মরিচ পোড়া দিয়ে পাঙ্গাস মাছ খেতে খুব পছন্দ করতেন জাতির পিতা। বেগম মুজিব যখন বঙ্গবন্ধুকে বার বার অন্তত একবেলা মাছ খেতে অনুরোধ করছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, “রেনু, তুমি আমাকে ভাত খেতে বলো না।” নারী নেত্রীরা তখন বলেন যে মুজিব ভাই, “তাহলে কিন্তু আমরাও খাবো না”। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “না, তোরা এরকম কথা বলিস না। তোরাই তো বলেছিস আমাকে যে ২০ টাকা মন চাল দিবি, আর এখন দেখ মানুষ না খেয়ে থাকছে।” তিনি ভাত খান নি।
তখন বাংলাদেশে চাল এসেও ফিরে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক একটা চক্রান্ত চলছিল তার বিরুদ্ধে। যারা স্বাধীনতা মেনে নেয়নি তারাই এরকম করেছিল। বঙ্গবন্ধু সবকিছুই জানতেন। তারপরও এর দায় তিনি তার নিজের উপরেই টেনে নিয়েছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু যে ভাত খান নি, তার সত্যতা পাওয়া যাবে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। সেখানে তিনি লিখেছেন, “পুরো দুর্ভিক্ষের সময়টা তিনি রুটি খেয়ে কাটিয়েছেন, ভাত খাননি।” অথচ একাধারে রুটি তিনি সহ্য করতে পারতেন না। পেটের পীড়া দেখা দিত। একথা তিনি ‘কারাগারের রোজনামচা’-গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
৭. ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিব অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রিত থেকে পড়াশোনা করতো। চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসতো। আর সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দুরে হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। বঙ্গবন্ধুর মা তার নাতনিকে বলেছেন, তার খোকার (বঙ্গবন্ধুর) জন্য মাসে কয়েকটা ছাতা কিনতে হতো। কারণ আর কিছুই নয়, অনেক গরীব ছেলে, ছাতা কিনতে পারে না। দূরের পথ রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে তাদের ছাতা দিয়ে দিতেন তিনি। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন। যখন ছুটির সময় হতো, তখন বঙ্গবন্ধুর মা আম গাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন, খোকা আসবে, দূর থেকে রাস্তার উপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ে চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে। পরনের পাজামা-পাঞ্জাবি নেই, কী ব্যাপার? এক গরীব ছেলেকে তার শতচ্ছিন্ন কাপড় দেখে সব দিয়ে এসেছেন খোকা।
৮. ১৯৪৩- এর দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিব তার পিতার অনুপস্থিতিতে নিজেদের ধানের গোলা খুলে দিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য। ইংরাজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘চ্যারিটি বিগিনস ফ্রম হোম’। বঙ্গবন্ধু অন্যের বিপদে সাড়া দিতে কখনো ভোলেননি। তিনি নিজের বিপদ ও সম্পদকে উপেক্ষা করেছেন অন্যের সাহায্যে। তবে এসব কাজে তার মহানুভব মাতা-পিতা কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াননি বরং উৎসাহ দিয়েছেন। পরিবার থেকেই বঙ্গবন্ধুর দাতব্য কর্মকাণ্ডের হাতেখড়ি হয়েছিল।
৯. আদিবাসীদের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২১শে জানুয়ারি দুপুরে আদিবাসী গ্রাম চুনিয়ায় সফর করেন। সেই সময়ে ডাকবাংলোতে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ইয়াকুব আলী। তিনি সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “তখন আমি শোলাকুড়ি হাই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরের ঘটনা। হঠাৎ শোলাকুড়ি বাজারে শুনতে পান, বঙ্গবন্ধু ডাকবাংলোতে বিশ্রাম নিতে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন বেগম ফজিলাতুন নেছা ও শেখ রাসেল। স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে তিনি বাংলোতে যান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তিনি কারো মাথায় হাত রেখেছেন, কারো পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। উপস্থিত ছাত্রদের মধ্য থেকে তিনি (বঙ্গবন্ধু) ইয়াকুব আলীকে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করেন।’ মহান নেতা মুজিবকে ইয়াকুব আলী ‘স্যার' বলে সম্বোধন করলে তিনি ধমক দিয়ে বলেন, ‘স্যার না বলে, ভাই বলে ডাকবি।’ অথচ আজকাল দেখি নেতারা ভাইয়ের পরিবর্তে স্যার শুনতেই বেশী পছন্দ করেন।’
১০. আমরা জানি দেশ স্বাধীন হবার সাথে সাথে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে যারা পাকিস্তানি পক্ষ নিয়েছিল তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রেখেছিল সে সময়কার সরকার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ওই সমস্ত ব্যক্তির মধ্যে যারা হত্যা ও ধর্ষণ কিংবা কোন ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না, সেসব প্রবীণ রাজনীতিবিদদের আর্থিক অসুবিধাগ্রস্ত পরিবারের জন্য মাসিক ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। রফিকুল্লাহ চৌধুরী (বর্তমান স্পিকারের বাবা) জানিয়েছিলেন এই অর্থ প্রদান তদারকির দায়িত্ব ছিল তার হাতে। কিন্তু কাউকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকার পাত্র বঙ্গবন্ধু কখনো ছিলেন না। শত ব্যস্ততার মাঝে একদিন হঠাৎ করে প্রশ্ন করলেন তরুণ একান্ত সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে পরিবারগুলোর সবাইকে কি টাকা পৌঁছানো হয়েছে?
রফিকুল্লাহ চৌধুরী উত্তর দেন- জি না স্যার, কিছু সমস্যার কারণে এখনও কয়েকটি পরিবারকে দেয়া সম্ভব হয়নি। অপ্রস্তুত কণ্ঠে তিনি জবাব দিয়েছিলেন। শুনে গম্ভীর ও ব্যথাহত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, “আজ মাসের সাত তারিখ অথচ এখনও তাদের কারও কারও কাছে টাকা পৌঁছানো বাকি রয়ে গেছে? তুমি কি করে বুঝবে পরিবারের প্রধান জেলে থাকলে সংসারের অন্যদের কত নিদারুণ কষ্ট পোহাতে হয়, আমি তো সেটা জানি!”
তরুণ একান্ত সচিব মাথাটা চুলকে জবাব দিয়েছিলেন, “স্যার, আমিও তো প্রায় একবছর জেল খেটেছিলাম।” বঙ্গবন্ধু উত্তরে, “খেটেছিলে সেটাতো ভাল করেই জানি। কিন্তু সে সময় তোমার কি সংসারের প্রতি কোন দায়িত্ব ছিল? তুমিতো তখন ছাত্র- বিয়েই করনি!”
এরকম শত শত মানবিক নীতি বঙ্গবন্ধু অনুসরণ করেছেন। সেগুলোর প্রয়োগ আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত জরুরী। এসকল নীতির অনুসরণ দারিদ্র বিমোচনে সহায়তা করবে। জনগণকে শিক্ষিত, দয়ালু, পরোপকারী, মিতব্যয়ী ও নিষ্ঠাবান করে তুলবে। বঙ্গবন্ধু তার দেশ ও জাতির নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতেন সূক্ষ্মভাবে যা আর কোন নেতা পারেননি। আর এই কারণেই তার অনুসৃত নীতি-আদর্শসমূহ জাতি গঠনে মহৌষধের মত কাজ করতে পারে। আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে কেন বঙ্গবন্ধু দলকে সুসংগত করতে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন দল শক্তিশালী না হলে সুন্দর দেশ গড়ে তোলা যাবে না। আর দুই দায়িত্ব হাতে নিয়ে কোনটাই ঠিকমত সম্পাদন করা যাবে না। তাই তিনি মন্ত্রীর ক্ষমতা ও সুবিধা অবলীলায় ত্যাগ করেছেন। আমার মনে হয় এখনই সময় আমাদের নেতাদের, জাতির ও জনগণের বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের কঠোরভাবে অনুসরণ করা।