কপ২৮ সম্মেলন থেকে ক্ষয়ক্ষতির তহবিল যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু এটা কীভাবে বাংলাদেশের মত দেশে ক্ষতির সবচেয়ে সামনের সারিতে থাকা মানুষদের ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির প্রতিকার করবে?
Published : 14 Dec 2023, 04:34 PM
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত উপজেলা মোংলার একটি গ্রামে কয়েক মাস আগে আমার সঙ্গে লিপি বেগমের দেখা হয়। ১৩ বছর ধরে তার জরায়ু যথাস্থান থেকে সরে যাচ্ছে।
তিনি যখন তার স্বাস্থ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে এ কথাটি বললেন, তখন প্রথমে আমি বিষয়টা বুঝতেই পারিনি। কিছুটা আঁচ করতে পারার পর আমার ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। বিষয়টা তখনও যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। নিজেকেই যেন বলছিলাম, এটা কি সত্যিই তার জীবনে ঘটেছে? এ রকম ঘটা আদৌ কি সম্ভব?
ওই এলাকার আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলে, নানা তথ্য উপাত্ত ঘেটে আমি বুঝতে পারি, এটা উপকূলীয় এই এলাকার অনেক নারীর জীবনে খুবই পরিচিত এক সমস্যা। গত ১৩ বছর ধরে বহু অর্থ খরচ করে নানা চিকিৎসার মাধ্যমে লিপির পরিবার তার জরায়ুকে যথাস্থানে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত স্বল্প আয়ের এই পরিবারের জন্য এটা বেশ কঠিন সিদ্ধান্ত। কোন স্বাস্থ্য বীমা না থাকার কারণে চিকিৎসার খরচ জোগাতে পরিবারের নানা খরচ, যেমন: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক চাহিদা পূরণে ছাড় দিতে হচ্ছে। এক সময় লিপি পাশের নদীতে মাছের রেণু পোনা ধরতে যেতেন। এখন সেটাও তিনি আর পারেন না। লিপি বেগমের পরিবার তার স্বামীর একক আয়ের উপর নির্ভর করছে।
লিপির দুই সন্তান তার গর্ভে মারা গেছে। এমনকি এখন তার জীবনও ঝুঁকির মুখে। ডাক্তার তাকে সতর্ক করে বলেছে, যত দ্রুত সম্ভব সার্জারির মাধ্যমে তার জরায়ু অপসারণ করতে হবে। এখন তিনি অপারেশনের জন্য টাকা জোগাড়ের অপেক্ষায় আছেন। দরিদ্র এই পরিবারের টাকা জোগাড় যেহেতু একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তাই তিনি অপারেশনের আগে আরেকটি বাচ্চা নিতে চান। যদিও তিনি জানেন, তার সামনে এখন দুইটা বিকল্প খোলা আছে। হয় তাকে সার্জারি করতে হবে, নয় ধীরে ধীরে তাকে এক যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে।
আমার জন্মও উপকূলের একই রেখা বরাবর। তবে এটি দেশের আরেক প্রান্তে। আমাদের এলাকায় একটা প্রবাদ আছে, “এটাতো মাতৃগর্ভ নয় যে, তুমি এত নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।” মাতৃগর্ভ যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা, এই প্রবাদ দিয়ে তা-ই বোঝানো হয়। মাতৃগর্ভই যদি সবচেয়ে নিরাপদ হয়, তাহলে লিপি বেগমের দুই সন্তানকে কেন গর্ভেই মরতে হলো। কে তার জন্য দায়ী?
লিপি জানেন, তার এই সব দুর্ভোগের কারণ লবণ-পানির আগ্রাসন। কিন্তু এর পেছনে কারা আছেন, সেটা তিনি জানেন না।
এই দুর্ভোগে লিপি একা নন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের এক হিসাব বলছে, লবণপানিতে আক্রান্ত এলাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করে। যাদের অর্ধেক নারী। সাম্প্রতিক সময়ে এই এলাকার ৩০জনের বেশি নারীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা সকলেই লবণ-পানির কারণে কোন না কোন রোগে আক্রান্ত।
২০১০ সালে একজন রেডিও সাংবাদিক হিসাবে আমি একটি প্রতীকী জলবায়ু আদালত কাভার করি। আদালতটি বসেছিল বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। সেই আদালতের বিচারকরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত বিশ্বকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের রায় দেন। অবশ্য এই বিচার প্রক্রিয়া প্রতীকী হওয়ার কারণে এই রায় বাস্তবায়নের এখতিয়ার সেই আদালতের ছিল না। যদিও বিচারপ্রার্থীদের ক্ষয়ক্ষতি ও আক্রান্তদের কান্না প্রতীকী ছিল না। বরং তা ছিল তাদের জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এ রকম একজন নারী বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে সেই আদালতেই আমার দেখা হয়েছিল। যিনি তার স্বামীকে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারিয়েছিলেন। যে দুর্যোগের কারণ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। পরপারে পাড়ি দেয়া তার স্বামী আর কোনদিন ফিরে এসে তাদের যত্ন নিবে না, তাদের জন্য উপার্জন করবে না বা অন্নসংস্থান করবে না।
কিন্তু আমার রওশন আক্তারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যিনি এখন একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি তার সাংবাদিক স্বামী মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ আদায়ে একটি সত্যিকারের কোর্টে গিয়েছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তি/গোষ্ঠীর কাছ থেকে এভাবে ক্ষতিপূরণ আদায়ে এটিকে প্রথম ঘটনা হিসেবে মনে করেন বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনের অনেকে। নিম্ন আদালত, হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগ তিন পর্যায়েই তার পক্ষে রায় হয়।
তার স্বামী মারা যান ১৯৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। চালককে জেলে পাঠানোর চেষ্টার পরিবর্তে তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন ক্ষতিপূরণ আদায়ে। আদালতের কাছে আবেদনে তিনি ছয়টি খাতে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন, যেগুলো হচ্ছে: তার স্বামীর সম্ভাব্য আয় হারানোর ক্ষতি, বাবার ভালোবাসা, যত্ন থেকে তার দুই সন্তানের বঞ্চিত হওয়ার ক্ষতি, স্বামীর ভালোবাসা থেকে স্ত্রীর বঞ্চিত হওয়ার ক্ষতি, অবসরকালীন আয় বঞ্চনার ক্ষতি, বাবার গুডউইল ব্যবহার করতে না পারার ক্ষতি, মৃতের পরিবারের অন্য সদস্যদের মানসিক ধাক্কার ক্ষতি। হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগ প্রথম চারটি খাতে ক্ষতিপূরণ মঞ্জুর করে। আপিল বিভাগের রায়ে মোট ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি অর্থ মৃতের পরিবারকে দেয়ার নির্দেশ দেয়।
এই মামলা বাংলাদেশে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ আদায়ে নতুন পথ দেখিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের পরিবারকে সাড়ে চার কোটি টাকা বেশি পরিশোধে তিন বিবাদীকে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। সড়ক দুর্ঘটনায় বিচারপ্রার্থীদের সামনে দুইটা পথ খোলা থাকে। এর মধ্যে সড়ক পরিবহন আইনে কেবল সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়া যায়। আর টর্ট আইনে যে কোন ধরনের ক্ষতি পূরণে বিচার চাওয়া যায়।
অবশ্যই সকল ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি, সেটা সড়কে দুর্ঘটনায় হোক আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হোক, এর স্বীকৃতি এবং ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত। সুতরাং লিপি বা যে কোন জলবায়ু যোদ্ধাদের জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী ব্যক্তি থেকে সত্যিকারের ক্ষয়ের ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত। ক্ষতিপূরণের এই অর্থ কোন দয়া নয়। এটা একটা আইনী বাধ্যবাধকতা।
সরকার যেহেতু জনগণের জীবন ও সম্পদের জিম্মাদার। তাই তাদের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেয়া। রওশনের মামলায় হাই কোর্টের রায়েও এই কথার প্রতিধ্বনি আছে। এই রায়ে বলা হয়, জীবনযাপনের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর সংবিধান স্বীকৃত অধিকার এবং জীবনের প্রত্যাশা নিয়েই সব শিশু জন্মগ্রহণ করে। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু অকাল মৃত্যু, তা যে কারণেই হোক না কেন, সেটা প্রত্যাশিত নয়, তাতে প্রবোধও দেয়া যায় না। দুর্ঘটনায় মৃত্যুও অকাল মৃত্যু। যেহেতু নাগরিক ও নাগরিকের জীবনের সুরক্ষা প্রদান করা সরকারের দায়িত্ব, তাই এ রকম যে কোন অকাল মৃত্যুর জবাব সরকারকে দিতে হবে। তাই যে কোন শ্রেণি, সমাজ বা স্থানের কোন ব্যক্তি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে সরকারের দায়িত্ব ওই পরিবারের বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের দুর্দশাকে উপশম করা।
বাংলাদেশের সংবিধানও এদেশের নাগরিক ও বাংলাদেশের সীমানায় যে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তি সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছে। তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের জীবন, দেহ ও সম্পদের সুরক্ষায় কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? গৃহীত পদক্ষেপ কি যথেষ্ট?
কপ২৮ সম্মেলন থেকে ক্ষয়ক্ষতির তহবিল যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু এটা কীভাবে বাংলাদেশের মত দেশে ক্ষতির সবচেয়ে সামনের সারিতে থাকা মানুষদের ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির প্রতিকার করবে? দায়ী ব্যক্তি ও রাষ্ট্র কি লিপি বেগমের ক্ষতিপূরণ দেবে? এই তহবিল থেকে আদৌ কি তিনি কোন সুবিধা পাবেন? জবাব যদি ইতিবাচক হয়ে থাকে, তাহলে সেটা কীভাবে? এই ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য কি কোন সুনির্দিষ্ট কাঠামো গড়ে তোলা হবে? নাকি ক্ষতিপূরণ পেতে তাকে আদালতে গিয়ে তাকে রওশনের মত ৩৪ বছর ধরে লড়তে হবে। আইনী লড়াইয়ে জয় দেখার জন্য কি তিনি ততদিন বেঁচে থাকবেন?
টর্ট আইন বাংলাদেশে জন্ম নেয়া কোন আইন নয়। এটি একটি রোমান আইন। যা পশ্চিমা দুনিয়ায় বেশ পরিচিত এবং চর্চিত। লিপির ক্ষতিপূরণের অর্থ অনেক বেশি হয়ে যেতে পারতো, যদি কেবল তিনি ইংল্যান্ডের উপকূলে বা পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর কোন একটিতে জন্মগ্রহণ করতেন।