শ্রমিকের বিক্ষোভকে বিদ্রোহ বা ইন্ধনের ফল হিসাবে না দেখে শ্রমিকের ক্ষুধাটা বিবেচনা করে দেখা দরকার।
Published : 14 Nov 2023, 03:41 PM
পোশাক শ্রমিকদের বেতন কতটা বেড়েছে? বৃদ্ধিটা কি ন্যায্য ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে হয়েছে? হয়নি। অনেক গবেষণা তা নিশ্চিত করছে। দেখা যাচ্ছে, মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির সমান্তরাল তো দূরের কথা কাছাকাছিও হয়নি। মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশের মতো। শ্রমিকরা তাই দাবি করেছেন, তাই দেখা যায়, সরকার বাজার পরিস্থিতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়কে আমলে নেয়নি। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে মালিকদের সামর্থ্যের বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে ২০১৮ সালে নির্ধারিত আট হাজার টাকাকে ভিত্তি ধরে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এই যুক্তি শ্রমিকদের ক্ষুধার সামনে ন্যায্য বিবেচিত হচ্ছে না।
তাই তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বরং নিম্নতম মজুরি বোর্ড গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করলে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে এবং গাজীপুরের কোনাবাড়ি অঞ্চলে তা সহিংস রূপ লাভ করে। এরই মধ্যে শ্রমিক নিহত হওয়ার মতো মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছে এবং তার জেরে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ প্রায় দেড়শত কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে।
নিম্নতম মজুরি বোর্ড এক গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি হবে ১২ হাজার ৫০০ টাকা যার মধ্যে বেসিক ৬ হাজার ৭০০, বাড়িভাড়া ৩ হাজার ৩৫০, মেডিকেল, ৭৫০, যাতায়ত ৪৫০ এবং খাদ্যভাতা এক হাজার ২৫০ টাকা। সরকারের এই ঘোষণার আগে বিজিএমই’র প্রস্তাব ছিল ১০ হাজার ৪০০ টাকা এবং শ্রমিকদের দাবি ছিল ২৩ হাজার টাকা। সরকার শ্রমিকদের দাবি, সিপিডির প্রস্তাব ১৭ হাজার ৪০০ টাকা তা আমলে নেয়নি। বিজিএমইএ’র প্রস্তাবকে আমলে নিয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে। সরকার সমর্থক সংগঠন ছাড়া বাকি শ্রমিক সংগঠনগুলো এই মজুরি নির্ধারণ প্রত্যাখ্যান করে এবং বিজিএমইএ বলেছে তাদের পক্ষে এই নির্ধারণ বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হবে।
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিজিএমইএ’র বক্তব্য বেশ ভালো করেই প্রচার করছে, তুলনায় শ্রমিকদের বক্তব্য তেমন প্রচার পায়নি। অবশ্য দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় শ্রম পরিস্থিতির সার্বিক একটা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। এতে যে চিত্র ফুটে উঠছে তাতে বোঝা যাচ্ছে মালিকরা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও শ্রমিকদের ঐক্যে ফাটল রয়েছে। মালিকদের বক্তব্যের মূল কথা হলো, গুটিকয়েক ছাড়া অধিকাংশ কারখানা মজুরি বাড়াতে সমর্থ নয়। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে তারা প্রতিযোগিতামূলক যে দাম পাচ্ছে তাতে মুনাফার হার কম, তাই নিম্নতম মজুরি আর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তারা মনে করেন, সরকারের উচিত দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা এবং শ্রমিকদের রেশনসহ অন্যান্য সহায়তা দেওয়া। আন্দোলনরত অনেক শ্রমিকও বলছেন, দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় বৃদ্ধি তাদের আয়ের সবটুকু খেয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশে গত শতাব্দীর আশির দশকে বিকশিত তৈরি পোশাক শিল্প গত চল্লিশ বছরে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ বিকশিত হয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রথম দিকে এই শিল্পকে শিশু হিসাবে বিবেচনা করে শ্রমিক ইউনিয়ন করা আইন বাস্তবায়ন করা হয়নি। ইপিজেডগুলোতে এখনো ট্রেড ইউনিয়ন আইনত নিষিদ্ধ। আগুন এবং ভবন ধ্বংসের মতো বিপর্যয়ে শ্রমিকের জীবন গেছে বারবার। শ্রমিকদের এই জীবনদান আইনত মালিকের ও শ্রম আইনের অবহেলার কারণে হলেও এর কোনো সুষ্ঠু বিচার হয়নি। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা শ্রম- পরিবেশ উন্নয়নে এগিয়ে আসলেও বাংলাদেশের শ্রম অধিদপ্তর কোনো কার্যকর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেনি।
আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাপে মালিকরা অনেকেই কর্ম-পরিবেশ উন্নয়নে এগিয়ে আসলেও অধিকাংশই আসেনি। প্রায় চার হাজার কারখানায় চল্লিশ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু এর মধ্যে হাজারের অধিক কারখানা টেকসই। বাকিগুলো লাভ-ক্ষতির মধ্যে ঘুরপাক খায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের বাজার আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমপ্রসারমান। এই আন্তর্জাতিক পণ্যটি একটি বিশেষ ধাপে বাজারে প্রবেশ করে, সেখানে, বাংলাদেশ শুধু সেলাইয়ের কাজটি করে থাকে, যদিও, ইদানিং এই শিল্পের ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বিকশিত হয়েছে। এই শিল্প এখন বেশ শক্তি অর্জন করেছে। তবে, এখানে বড় শিল্প ও ছোট শিল্পের মিশ্রণ আছে। ছোট শিল্পগুলো শুধু মজুরি দিতেই অপারগ নয়, তারা শিল্প হিসেবেও টেকসই নয়। অন্যদিকে, শুধু সস্তা শ্রমের জন্যই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের পছন্দ তা নয়, এখানে কম রেটেও কাজ করা যায়। ফলে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রেতাদের যেমন পছন্দের তেমনি অন্যান্য সরবরাহকারীদেরও প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। এই প্রতিযোগিতা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গার্মেন্ট শিল্পে আন্তর্জাতিক শ্রম আইন বিশেষ করে আইএলওর আইন অনুযায়ী শ্রম পরিবেশ আছে কিনা তা নজর রাখছে এবং এই বছরের মধ্যে তা আন্তর্জাতিক মানসম্মত না হলে ভবিষ্যতে তাদের বাজারে প্রবেশে নানা বাধা তৈরি করবে।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ২০২৩ সালে শ্রম আইনের যে সংশোধনী পাশ হয়েছে সেখানে শ্রমিক ও ক্রেতা দেশগুলোর প্রত্যাশা পূরণ তো হয়নি, পূরণ হয়নি শ্রমিকদের দাবিও। শ্রমিকদের দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল, ইপিজেডে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার এবং শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতির ক্ষমতা মালিকের হাতে না রেখে আইনের হাতে রাখা, যাতে শ্রমিক চাকরির নিরাপত্তা পায়। এছাড়া, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করা। সংশোধিত শ্রম আইনে শ্রমিকরা বেশ কিছু অধিকার হারায়, যেমন, সরকারি পর্যায়ে আউটসোর্সিং বন্ধ না হওয়া এবং ধর্মঘট করার অধিকার হরণ করে প্রায় সব চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করা ইত্যাদি। একটা বিষয় পরিষ্কার, কারখানায় ইউনিয়ন না থাকলে, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সুযোগ না থাকলে, শ্রমিকের আন্দোলন অসংগঠিত বিক্ষোভে পরিণত হয় যা কারো জন্য কল্যাণকর নয়।
এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ঢাকা ভ্রমণ করছে তখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য এলিট ফোর্স শ্রমিকদের বিক্ষোভ সামলাতে গিয়ে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করছে, লাঠি চার্জ, ছররা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করছে। শ্রমিকের বুকে গুলি চলেছে, শ্রমিক নিহত হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিকের নামে গায়েবি মামলা হচ্ছে। কারখানা বন্ধ হচ্ছে। সরকারের এই শক্তি প্রয়োগ শ্রমিক বা মালিকের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়, ভ্রমণরত আন্তর্জাতিক টিমের জন্যও সুখকর নয়।
সরকার বলছে, শ্রমিক বিক্ষোভে চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের ইন্ধন রয়েছে। এই সবের পরেও আজ প্রশ্ন উঠছে, এই বিপুল রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ, শ্রমিক হত্যা, ন্যূনতম মজুরির আন্দোলনকে সাময়িক চাপে রাখলেও তা দমিত হবে না। কারণটা সহজ, যে সরকার খাদ্যশস্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না সে সরকার জনগণের বন্ধু থাকে না। জনগণ বা শ্রমিকরা কেন বিদ্রোহ করে? কথাগুলো শেকসপিয়রের এক নাটকের চরিত্রের মুখেও শুনেছি আমরা। সেই চরিত্রটি বলছে, আমরা হচ্ছি গরিব নাগরিক, লোকে বলে, প্যাট্রিসিয়ান। আমরা কোন দোষ করলে কারা আমাদের বাঁচাবে? আমাদের কাছে যা দুঃখকষ্টের কারণ, ওদের কাছে তাই প্রাচুর্যের উৎস। আমাদের দুঃখকষ্টের বিনিময়ে ওরা লাভ করে প্রচুর অর্থ। আমরা এইভাবে জাহান্নামে বা উচ্ছন্নে যাবার আগে ওদের ওপর প্রতিশোধ নাও। দেবতারা জানেন, আমি একটা রুটি না পেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় বলছি, কোন প্রতিশোধ বাসনার তাড়নায় নয়।
তাই, শ্রমিকের বিক্ষোভকে বিদ্রোহ বা ইন্ধনের ফল হিসাবে না দেখে শ্রমিকের ক্ষুধাটা বিবেচনা করে দেখা দরকার।
সামনে নির্বাচন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আইএলও’র শ্রম পরিস্থিতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক চাপ, দেশীয় রাজনীতির চাপ সরকার কৌশলগতভাবে হয়তো সামলাবে কিন্তু দেশের শ্রমিক যারা, তারা এই দেশের নাগরিক, তাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা দেওয়ার সাংবিধানিক দায়িত্ব সরকারের।
শ্রমিক হত্যার সুষ্ঠু বিচার, বন্দী শ্রমিকদের মুক্তি, গায়েবি মামলা প্রত্যাহার এবং নিম্নতম মজুরি বিষয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করলেই শ্রম পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।