অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে শ্রীলঙ্কা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 14 July 2022, 10:43 AM
Updated : 14 July 2022, 10:43 AM

শ্রীলঙ্কায় এখন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। রাষ্ট্রযন্ত্র অচলপ্রায়। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কারও ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই। কারণ তারা কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারছেন না। খাদ্যের অভাব। ওষুধ নেই। সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেলের। এর ফলে সরকার স্কুল বন্ধ করেছে। সরকারি অফিস বন্ধ রয়েছে। জ্বালানি দেওয়া হচ্ছে শুধু চিকিৎসা ও খাদ্য পরিবহনের কাজে যারা জড়িত তাদেরকে। এসবের মানে হচ্ছে একটি রাষ্ট্র অচল হয়ে পড়া। কোনো মেকানিজম সেখানে কাজ করছে না। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেন-দরবার করেও সহায়তা আনতে পারছে না সরকার। আর্থিক সংকটে জনগণের এখন জীবন বাঁচানো কঠিন। তা যখন পারছেন না তখন জীবনের মায়া ত্যাগ করে তারা চড়াও হয়েছেন প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। বিক্ষোভকারীদের কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে গত মঙ্গলবার রাতে একটি সামরিক উড়োজাহাজে করে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। গোটাবায়ার দেশ ছেড়ে পালানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ওপর নাটকীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। উচ্ছৃঙ্খল আচরণে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার বা দেখা মাত্র গুলি করার জন্য দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে।

প্রধানমন্ত্রী রনিলকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার। বিক্ষোভকারীরা অবশ্য রনিলের ব্যাপারেও নাখোশ। তারা রনিলেরও পদত্যাগ দাবি করছেন। যদিও রনিল আগেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠিত হলে তিনি পদত্যাগ করবেন।

উল্লেখ্য, রাজনৈতিক-ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান রনিলের প্রধান চ্যালেঞ্জ জনগণের 'ম্যান্ডেট' না থাকা। এর আগে পাঁচবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তবে তিনি কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। শেষপর্যন্ত তিনি টিকতে পারেন কিনা, এ ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

আশার কথা হলো, একটি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছে দেশটির বিরোধী দলগুলো। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা কারও কথা শুনছে না। এমন পরিস্থিতে ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও সহিংস পরিস্থিতি এড়াতে সেনাশাসন জারির জল্পনাও শোনা যাচ্ছে।

যে শ্রীলঙ্কায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ, প্রধামন্ত্রীর কার্যালয় বিক্ষুব্ধ জনতা দখল করে নিচ্ছে, চাল-ডাল-তেল-পাঁউরুটি বা জ্বালানি না-পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে, সেই শ্রীলঙ্কার নজিরবিহীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট সহসা কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। নেতৃত্ব বদল হলেও দেশে রাতারাতি খাদ্য উৎপাদন বাড়বে না, বাড়বে না বৈদেশিক মুদ্রা, কমবে না আমদানি ব্যয়, ঋণ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট। তাহলে সংকটের সমাধান কোথায়? আপাতত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দরকার অনতিবিলম্বে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সরকার প্রতিষ্ঠা। যারা শ্রীলঙ্কার মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমাধান করবেন। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, একনায়কত্বের শিকড় উপড়ে ফেলবেন। তবে শুধু শ্রীলঙ্কানদের চেষ্টায় বর্তমান সংকটের সমাধান হবে বলে মনে হয় না। এ মুহূর্তে সঙ্কট যাতে আরও খারাপ জায়গায় না পৌঁছায় তার জন্য দরকার বৈশ্বিক সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ। যাদের কাছে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়াতে হবে। কিস্তি আরও সহজ করে দিতে হবে। একইসঙ্গে অনাহারক্লিষ্ট মানুষকে বাঁচাতে মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

যে প্রশ্নটি উঠছে তা হলো, ২ কোটি ২০ লক্ষ জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কা কেন এমন অবস্থায় নিপতিত হলো? এর জন্য অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত সামরিক-রাজনৈতিক প্রশাসন, ক্ষমতাসীনদের একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব ও অপরিণামদর্শী নীতিকে দায়ী করছেন। আবার অনেক অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারক সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে করোনা মহামারীর দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যা পর্যটন ক্ষেত্র থেকে (শ্রীলঙ্কার জিডিপিতে যে সব ক্ষেত্রের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অবদান আছে এটি তার অন্যতম) ২০১৮ সালের ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়কে সঙ্কুচিত করে ২০২১ সালে ১৫০ মিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছিল এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু এই সংকট দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি হচ্ছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য ঘাটতি ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১২ বিলিয়ন হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, কিছু নীতিগত পদক্ষেপের কারণে অর্থনীতিকে একাধিক আঘাত সহ্য করতে হয়েছে, যেমন রাজাপাকসে আমলে বিশাল কর হ্রাস, সুদের হারে নিম্নমুখী সংশোধন এবং সমস্ত সার ও কীটনাশক আমদানির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে জৈব চাষে 'বিপর্যয়কর'‌ প্রবেশ। অতি সম্প্রতি ইউক্রেইন সংকটের দরুন মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি বিলের অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধির সঙ্গেও লড়াই করতে হয়েছে। এই সমস্ত কিছুর মধ্যে যে ঘটনা দেশটির সমস্যা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে তা হলো মহামারীর অব্যবহিত পরে দেশটির ক্রেডিট রেটিং নাটকীয় ভাবে হ্রাসের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট মার্কেট থেকে শ্রীলঙ্কাকে কার্যত বর্জন করা। এর ফলে কলম্বোর পক্ষে বছরের পর বছর ধরে জমে ওঠা ঋণ পরিশোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করার উপায় খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে এবং তার ফলে দেশটি আজ যে সংকটের মধ্যে রয়েছে তা আরও ঘনীভূত হয়েছে।

কিছু নীতিগত পদক্ষেপের কারণে অর্থনীতিকে একাধিক আঘাত সহ্য করতে হয়েছে, যেমন রাজাপাকসে আমলের বিশাল কর হ্রাস, সুদের হারে নিম্নমুখী সংশোধন এবং সমস্ত সার ও কীটনাশক আমদানির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে জৈব চাষে 'বিপর্যয়কর'‌ প্রবেশ। কয়েক বছর ধরে উল্টোপাল্টা নানা প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক এবং রাতারাতি কৃষি খাতে 'অর্গানিক ফার্মিং' চালুর জন্য প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের হঠকারী সিদ্ধান্ত শ্রীলঙ্কাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে। গোটাবায়া দেশের কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সলাপরামর্শ না করেই সম্পূর্ণ নিজের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু মতাদর্শগত অবস্থান থেকে 'অর্গানিক ফার্মিং' পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করা অনেক কঠিন আরেকটা প্রক্রিয়া– এটা হয়তো তার কিংবা বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি! এ কারণে এক অভূতপূর্ব ফলন বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে নেমে আসে এক-চতুর্থাংশে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশ ও কূটচালও বর্তমান সংকটকে ঘনীভূত করেছে। শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু সিংহলিরা গৃহযুদ্ধের কারণে ভারতের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল, যার সুযোগ নেওয়ার জন্য তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাোকসে গণচীনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে পড়েছিলেন। চীনও শ্রীলঙ্কার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশটিকে নিজেদের প্রভাববলয়ে টেনে নেওয়ার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় হামবানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চায়নিজ সিটি নির্মাণসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পে সহজ শর্তে প্রকল্প ঋণ প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে যখন হামবানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হয়, তখন দেখা গেল যে বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

বন্দরের আয় বাড়াতে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটিকে চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়। একই রকম বিপদে পড়তে হচ্ছে কলম্বোর চায়নিজ সিটি ও কয়েকটি বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়ে। যথাযথ 'প্রকল্প মূল্যায়ন' পদ্ধতি অবলম্বনে এসব প্রকল্প গৃহীত না হওয়ায় এগুলোর কোনোটাই যথেষ্ট আয়বর্ধনকারী প্রকল্প হয়ে উঠবে না। এ জন্যই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মহলে বলা হচ্ছে, লোভে পড়ে শ্রীলঙ্কা 'চীনা ঋণের ফাঁদে' আটকে গেছে। আরও মারাত্মক হলো, 'সভরেন বন্ড' ছেড়ে শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক অর্থবাজার থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার পুঁজি সংগ্রহ করেছিল ওই সময়ে, যেগুলোর ম্যাচিউরিটি ২০২২ সাল থেকেই শুরু হতে চলেছে। কিন্তু এখন তো সুদাসলে ওই বন্ডের অর্থ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য শ্রীলঙ্কার নেই। এসব অবিবেচনাপ্রসূত নীতি ও কর্মসূচির কারণে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে।

শ্রীলঙ্কার কাছে এখন সুযোগ রয়েছে অতীতের স্বৈরাচারী কৌশলের কারণে হারিয়ে যাওয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার এবং দেশ পরিচালন প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় গণতান্ত্রিক করার। এর জন্য শ্রীলঙ্কার অবিলম্বে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। একটি সামগ্রিক 'ব্যবস্থাগত পরিবর্তন'‌-এর জন্য পার্লামেন্টে নতুন সদস্যদের নিয়োগ যতক্ষণ না করা যাচ্ছে, ততক্ষণ বিক্ষোভকারীদের একটি নতুন অন্তর্বর্তী স্থিতিশীল সরকারকে সমর্থন করতে হবে। অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বৈশ্বিক সহায়তা চাইলে শ্রীলঙ্কাকে অবশ্যই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হবে, উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে পুনঃপ্রবেশ করতে হবে।