আগুন বনাম ছাই 

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 June 2022, 02:36 PM
Updated : 9 June 2022, 02:36 PM

সীতাকুণ্ডের আগুন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম করেছে। বহুদিন পর বিবিসিসহ দুনিয়ার নানা মিডিয়ায় এই সংবাদ দেশের ভাবমূর্তিকে ফেলেছে নতুন বিপদে। এ কথা সবাই জানি নানাভাবে ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে শেখ হাসিনার সরকার। বিশেষত অর্থনৈতিক সূচকে তরতর করে ওপরে ওঠার কারণে বাংলাদেশের কপালে লেপ্টে থাকা অনেক বদনাম ঘুচে গেছে। একসময় যারা আমাদের ফকির বা গরীব বলে জানতো তারাও ফিরে তাকাতে বাধ্য হয়েছে। দেশি পোশাক, দেশি পণ্য বিদেশে তার আপন বলয় তৈরি করে সুনাম কুড়াচ্ছে। তার ওপর আছে এক কোটির কাছাকাছি প্রবাসী বাংলাদেশী। এরা দেশে যে যা-ই করুক বিদেশে সবাই খাঁটি বাংলাদেশি। যারা বিদেশে বসবাস করেন কিংবা করে গেছেন তারা জানেন এদের দেশপ্রেম কতটা গভীর। সব মিলিয়ে যে বাংলাদেশ বারবার ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়ায় সেই বাংলাদেশের কপালে কলঙ্ক তিলক পরিয়ে দেয় রানা প্লাজা কিংবা সীতাকুণ্ডের মতো ঘটনা। কী হয়েছিল সে দিন?

আগুন লাগার পর প্রথমে কুমিরা ও সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এ সময় স্থানীয়রাও আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেন। আবার অনেক উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে ভিড় করেন। হঠাৎ একটি কনটেইনারে রাসায়নিক থাকায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের কারণেই মানুষের মৃত্যু বেড়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিপোতে রাসায়নিক থাকার খবর তাদের জানানোই হয়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন। রাসায়নিকের কারণে বিস্ফোরণে এত প্রাণহানি হয়েছে।

এর বেশি জানার দরকার পড়ে না। কারণ এমন কোনো বাঙালি নেই যে এই আগুনের আঁচ টের পাননি। তাই আসল কথায় ফিরতে চাই। এই দুর্ঘটনাই কি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের নিয়তি? ঢাকার চকবাজারসহ নানা জায়গায় একেকবার আগুন লাগে আর আমরা মানুষের মৃত্যু দেখি। পশু-পাখির চাইতেও অসহায় বাঙালিকে দেখে কি আপনার মনে হয় এদেশে সত্যি উন্নতি বলে কিছু হচ্ছে? আগেও লিখেছি এটা সরকারের দোষ না কিন্তু ব্যর্থতা এড়ানো অসম্ভব। প্রশ্ন উঠবে কীভাবে? বা কেন? সুশাসন কাহাকে বলে? তাহা কত প্রকার? এটা তো রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে জানতে হয় না। যেসব দেশে শ্রম-শ্রমিক ও মানুষ নিরাপদ তারাই বলে দেয় কাকে বলে সুশাসন। আপনি যদি দৃষ্টিভঙ্গি বড় করে দেখেন তাহলে সবাই শ্রমিক। সরকারি আমলাও একজন শ্রমিক। আর আগুনের মতো ভয়াবহ বিপদ কাকে কখন আক্রমণ করবে কেউ বলতে পারে না। আপনি কি নিশ্চিত সরকারি ভবনে এমন কিছু ঘটলে সবাই নিরাপদ থাকবেন? থাকবেন না। কারণ আমাদের সবকিছুই মুখে মুখে। কাজের বেলায় অনেক কিছুই নাই।

সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আরও একজন নিহত হয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা বেড়ে এখন পর্যন্ত ৪৪ জনে দাঁড়িয়েছে। ৮ জুন সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। নিহত মাসুদ রানার (৩৬) বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায়। তিনি বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আরএসটি অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। লেখার সময় এই ছিল সর্বশেষ সংবাদ। হয়তো সংখ্যা আরও বেশি। এদেশে কোনো পরিসংখ্যানই সঠিক বা আপডেটেড না। কাজেই অর্ধশতাধিক মানুষ যে মারা গেছেন এটা নিশ্চিত। যারা বেঁচে মরে আছেন তাদের কী হবে? বছরের পর বছর চলে গেলেও রানা প্লাজার আহতদের কোনো সমাধান মেলেনি। প্রতিবছর ওই দিনটিতে তাদের করুণ আর্তনাদ শুনতে পাই। অতঃপর তাদের কান্না হারিয়ে যায় এক বছরের জন্য। এই যেন কপাল।

সীতাকুণ্ডের আগুনে আপনি এখন পর্যন্ত যা জানেন বা দেখছেন তা অর্ধসত্য। আপনি হয়তো জানেন না ওই এলাকার আশেপাশের অনেক বাড়িঘরের চালা পুড়ে গেছে। বিস্ফোরণে উড়ে গেছে দরজা জানালা। এই বিস্ফোরণ এত ভয়াবহ হলো কেন? আগুনে বিস্ফোরণ ঘটে এটা জানি। কিন্তু এই স্কেলে তো হবার কথা না। এর কারণ এখন সবাই জানেন। রাসায়নিক রাখার ব্যাপারটি গোপন না থাকলে ফায়ার ফাইটারদের জীবন যেত না। ফায়ার ফাইটারদের আমাদের দেশে দমকল কর্মী বলা হয়। বিদেশে তাদের নাম আগুন যোদ্ধা। অষ্ট্রেলিয়া প্রকৃতিগত ভাবে অগ্নিপ্রবণ দেশ। প্রায় প্রতিবছর গ্রীস্মকালের শুরুতে সেখানে ভয়াবহ বুশ ফায়ার হয়। ২০১৯ সালে আমি দেশ থেকে ফেরার পর এক বিকেলে কাজ থেকে বেরিয়ে দেখি চারদিক কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ভাবলাম একটু হাঁটার পর হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না কয়ক কদম এগুনোর পর দেখি গলার কাছে পোড়া কয়লার মতো কি যেন আঁটকে আছে। বন থেকে এত দূরে লোকালয়ে এমন ভয়াবহ হাল ভাবা যায়? ওই যাত্রায় ছেলে এসে গাড়ি চালিয়ে বাসায় নিয়ে যাওয়ায় মোটামুটি বেঁচে গিয়েছিলাম। আগুনের ভয়াবহতা রোধে আকাশ থেকে পানি সরবরাহে কুলিয়ে উঠতে না পারায় নিউজিল্যান্ড আর কানাডা থেকে সাহায্য নিয়েছিল দেশটি। ফায়ার ফাইটারেরা এদেশে হিরো তুল্য। মানুষ তাদের সাথে ছবি তোলে। এমনকি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট নিজেও ছিলেন একজন স্বনামধন্য আগুন যোদ্ধা। আমাদের সমাজে আমরা তাদের সেভাবে সম্মান করতে শিখিনি।

এবার যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের জাতি নতুন ভাবে চিনল। জানল এরা কত বড় হিরো। কিন্তু তাদের জীবন যাবার জন্য রাসায়নিক মজুদ করা আততায়ীদের কি বিচার হবে? আগেই লিখেছি সীতাকুণ্ড বিষয়ে সবাই কমবেশি অবগত কিন্তু যেটা কেউ জানেন না তা হলো আখেরে এর সুরাহা কোথায়? বিচার বা শাস্তি হবে কিনা। মালিক একজন সরকারি দলের নেতা। এটা সত্য তিনি আগুন লাগাননি। আগুনে তার লোকসান সর্বশান্ত হবার মতো। কিন্তু রাসায়নিক মজুদ করার কথা কেন তিনি জানালেন না? কেনইবা আত্মগোপন। এ আরেক রোগ। কিছু ঘটলেই আত্মগোপনের নামে গা ঢাকা দেয়া। রানা প্লাজার মালিক লোকটি পায়ে হেঁটে বা গাড়িতে না এসেছিল হেলিকপ্টারে উড়ে। কী সাংঘাতিক! কে জানে এই মালিক কোন আকাশযানে হাজির হবেন। আগুন হয়তো প্রশমিত হয়েছে। তবে ভাঙ্গা কপাল জোড়া লাগবে না।

এই ঘটনার ইতিবাচক দিক ছিল মানুষের সহযোগিতা। এমন দৃষ্টান্তমূলক সহমর্মিতা অবিশ্বাস্য। যে যেভাবে পেরেছে পাশে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাস ভর্তি করে এসে রক্ত দিয়েছে। এমন হয়েছে শেষে আর রক্তের দরকার পড়েনি। সিএনজি চালক বিনা ভাড়ায় সারাদিন যাত্রী পারাপার করেছেন। মানুষ মানুষের জন্য এই আপ্তবাক্য যে জাতি মানে তার কপালে এই দুর্ভোগ মানায় না।

একটা প্রশ্ন থাকবেই, আগুন নিভলেও কিন্তু ছাই থেকে যায়। সে ছাইচাপা তুষের আগুন যে কি করতে পারে তা যারা ভুক্তভোগী তারাই জানে। এটা যেন ভুলে না যাই আমরা।