মিডিয়ায় ব্যক্তির মর্যাদা এবং ‘আজকের ভাইরাল শিশু’

আহসান হাবীব রাভীআহসান হাবীব রাভী
Published : 20 April 2022, 03:12 PM
Updated : 20 April 2022, 03:12 PM

আমাদের এ যুগে 'ভাইরাল' এখন খুবই চেনা পরিচিত একটি শব্দ। 'ভাইরাল' হলেই স্যোশাল মিডিয়ায় মানুষ সেই ইস্যু নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা। কখনো সমালোচনা, হাসাহাসি। অনেকেই আবার 'ভাইরাল' হয়ে বহুল পরিচিত হয়ে উঠেছেন। 

'ভাইরাল' হয়ে কেউ কেউ যেমন সমাজে ইতিবাচকভাবে পরিচিত হয়েছেন তেমনি অনেকেই চরম নেতিবাচকতার মুখোমুখি হয়েছেন। এবার ভাইরাল নিয়েই একটা প্রসঙ্গে চলে আসি। এবারের পহেলা বৈশাখে স্যোশাল মিডিয়ায় তিনটি  শব্দবন্ধ সম্ভবত সকলের টাইমলাইনে ঘুরেছে। শব্দবন্ধটি 'আজকের ভাইরাল শিশু'। সত্যিই একজন শিশু স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। পহেলা বৈশাখে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত লাইভে শিশুটির দেওয়া একটি বক্তব্য তাকে ভাইরাল করে দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ সেই ভিডিও দেখেছেন। অনেকেই ভিডিওটি ডাউনলোড করে নিজের টাইমলাইনে শেয়ার দিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকেই সেই শেয়ার দেওয়া ভিডিওর ক্যাপশন দিয়েছেন 'আজকের ভাইরাল শিশু'। হাজার হাজার 'হা হা' রিঅ্যাকশন পড়েছে সেই ভিডিওগুলোর পোস্টে। মন্তব্যের ঘরে হাসাহাসি হয়েছে, ট্রল হয়েছে। 'আজকের ভাইরাল শিশু' ছাড়াও পহেলা বৈশাখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় (সম্ভবত রমনা পার্ক, শাহবাগ) ঘুরতে আসা আরও কিছু শিশু, নারী ও ব্যক্তিদের মন্তব্য নিয়ে টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে 'হা হা' রিঅ্যাকশন পড়েছে এবং অনেকেই এটা নিয়ে ট্রল করেছেন। পহেলা বৈশাখে আনন্দ নিয়ে ঘুরতে আসা এ মানুষগুলো আমাদের 'দায়িত্বশীল গণমাধ্যমে'র বদৌলতে ভাইরাল হয়েছেন এবং ব্যক্তি হিসেবে যে এই মানুষদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে পারে, তা আমাদের গণমাধ্যম হয়তো একবারও ভাবেনি।   

ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে যা ছিল   

পহেলা বৈশাখে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সংবাদে কয়েকজন ব্যক্তির বক্তব্য নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক ট্রল হয়। তাদের মধ্যে একজন শিশুকে ফেইসবুকের বিভিন্ন পোস্টে 'আজকের ভাইরাল শিশু' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। একটি টিভি চ্যানেলের লাইভে শিশুটিকে পহেলা বৈশাখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। সেই প্রশ্নের উত্তরে শিশুটি বলেন, 'ভালো লাগছে৷ পহেলা বৈশাখ মানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷' এছাড়াও আর একটি টিভি চ্যানেলের তিন বছর আগে প্রকাশিত একটি ভিডিও এবং এর বিভিন্ন ক্লিপস নতুন করে ভাইরাল রয়েছে। সেই ভিডিও প্রতিবেদনে প্রতিবেদক একজন কিশোরীকে জিজ্ঞাসা করছেন যে, বাংলা সনে মাস কতোটি আর ছয়টি ঋতুর নাম কী কী, এখন বাংলা কতো সন? একই প্রশ্ন আর একজন ব্যক্তিকে করা হয়। তারা কেউই এ প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেননি। আর এটা নিয়েই স্যোশাল মিডিয়ায় হাসি, ঠাট্টা, তামশা আর ট্রল শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এর আগেও জিপিএ ফাইভ নিয়ে, বিভিন্ন জাতীয় দিবস নিয়ে টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদকের করা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ভুল উত্তরের ফলে ব্যাপক ট্রলের শিকার হন শিশুরা।   

গণমাধ্যমে কি ব্যক্তি মর্যাদা উপেক্ষিত? 

গণমাধ্যম অধ্যয়নের একেবারে প্রাথমিক স্তরে বলা হয়, গণমাধ্যম আমাদের শিক্ষিত করে, বিনোদিত করে, তথ্য দেয় এবং প্রভাবিত করে। ফলে গণমাধ্যম আমাদের নানাভাবে প্রভাবিত করে। এ কথা অনস্বীকার্য। দর্শক মুদ্রিত কোনো সংবাদ বা টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনকে নির্ভরযোগ্য মনে করে, তা বিশ্বাস করে। যেহেতু সমাজের ওপর গণমাধ্যমের আধেয় এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে- তাই প্রতিটি আধেয় নির্ধারণ, প্রকাশ ও তার শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাদের দায়িত্বশীল হতে হয়।   

অপরদিকে প্রত্যেক ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা রয়েছে। একজন শিশুরও মর্যাদা রয়েছে। একটি বৈষম্যহীন ও গঠনমূলক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বয়স, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি নির্বিশেষে সবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিৎ। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা আরও গঠনশীল হওয়া দরকার। একইসাথে গণমাধ্যমে শিশুর উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। সাংবাদিক সুশান্ত সিনহা সম্প্রচার সাংবাদিকতা নিয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ক জার্নাল ম্যাজিক লণ্ঠনে প্রকাশিত তার একটি প্রবন্ধে লিখছেন, "দ্রুত সময়ে কোটি দর্শকের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিতে জুড়ি নেই সম্প্রচার মাধ্যমের। এজন্য সংবাদের প্রতিটি শব্দ, লাইন, উচ্চারণ, উপস্থাপন ভঙ্গি সবকিছুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে প্রতি পদে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। সামান্য তথ্য বিচ্যুতি ও দু-একটি শব্দের কারণে একটি প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।"   

স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া যে টিভি প্রতিবেদনগুলো নিয়ে ট্রল হয়েছে, হাসাহাসি হয়েছে- এগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হতো। জ্ঞান যাচাইয়ের নামে কাউকে সামাজিকভাবে হেয় করা কোনো দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের কাজ হতে পারে না। বরং ব্যক্তি মর্যাদা, সামাজিকভাবে প্রতিটি মানুষকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে আরও বেশি তুলে ধরা প্রয়োজন। 

সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার দায় কে নেবে?   

একজন প্রতিবেদক কেনো একজন শিশুর, কিশোরীর বা ব্যক্তির জ্ঞান যাচাইয়ে উদ্যোগী হবেন? যারা ট্রলের শিকার হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই তাদের বক্তব্য দিয়ে সংবাদটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন। যিনি সংবাদ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন তাকেই 'অজ্ঞ' হিসেবে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা অনভিপ্রেত। তিন বছর আগে একটি টিভির ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, যারা সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর এক ধরনের অদ্ভুত শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে করে সাক্ষাৎকার দেওয়া ব্যক্তিদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি জোরালো হয়েছে। সেই ভিডিওর টাইটেলে লেখা হয়েছে, "পহেলা বৈশাখ উদযাপন করলেও অনেকেই জানেন না বাংলা মাসের নাম। সাল কত!" যাদের সেই ভিডিওতে দেখানো হয়েছে তাদের চেহারা, ভয়েসটাও অবিকল রয়েছে। ফলে খুব সহজেই পরিচিতরা তাদের শনাক্ত করতে পারবেন। তিন বছর আগের ভিডিও হলেও এ বছর সেই প্রতিবেদন থেকে সাক্ষাৎকারদাতাদের ছবি ও মন্তব্যগুলো দিয়ে বিভিন্ন ট্রল ইমেজ, শর্ট ভিডিও ক্লিপস তৈরি করে স্যোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। যাদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে তাদের ব্যক্তি মর্যাদার প্রতি প্রতিবেদকের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত ছিল। বিভিন্ন ব্যক্তির জ্ঞান যাচাইয়ের দায়িত্ব নিশ্চয়ই গণমাধ্যমের ওপর বর্তায় না। অথচ টিভি চ্যানেলগুলো ব্যক্তি মর্যাদার কথা না ভেবে সংবাদ প্রতিবেদনে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করেছে। ওই ব্যক্তিদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাশীল আচরণই করেননি। 

ভিডিওগুলো ভাইরাল হওয়ার পর সেখানে মন্তব্যকারী প্রত্যেকে যে মানসিক সংকট, আত্মবিশ্বাসহীনতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন বা করেছেন কিংবা তারা সামাজিকভাবে যে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন এর দায় কে নেবে?