মাতৃদুগ্ধ, পাবলিক প্লেস এবং শিশুর কান্না

আশীষ কুমার দাস
Published : 19 July 2022, 05:58 PM
Updated : 19 July 2022, 05:58 PM

বছর পাঁচেক আগে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের একজন সদস্য প্রথমবারের মতো অধিবেশন চলাকালে শিশুকে বুকের দুধ খাইয়েছিলেন। তার কয়েকমাস আগেই অস্ট্রেলিয়ায় কর্মস্থলে নারী তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন বলে একটি আইন পাস হয়েছিল।

২০১৭ সালের মে মাস ১০ তারিখের ওই ঘটনায় অস্ট্রেলিয়ার নারী সিনেট সদস্য লারিসা ওয়াটারস নিজেকে ইতিহাসে বিরল ও প্রথম ওই মুহূর্তটির জন্য নিজেকে 'গর্বিত' বলে পরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।

একই ধরনের ঘটনা স্পেন, ব্রিটেনসহ আরও নানা দেশের পার্লামন্টে ঘটেছে। জনসম্মুখে শিশুকে স্তনপান করানো নিয়ে এরপর নানা ধরনের বিতর্কও হয়েছে। সেই বিতর্ক এখনো থামেনি। কর্মক্ষেত্রে শিশুকে বুকের স্তন পান করানোর অনেকগুলো দেশে আইনও তৈরি হয়েছে। নারী অধিকার সংস্থাগুলোও এ ব্যাপারে দারুণ সোচ্চার। তবে আমাদের দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী, ওভাবে কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে করতে শিশুকে স্তন পান করানোর দৃশ্য চিন্তাও করা যায় না। অথচ দেখুন সব সমীক্ষাতেই মাতৃদুগ্ধ পানে বাংলাদেশের অবস্থান সামনের সারিতে।ওয়ার্ল্ড ব্রেস্টফিডিং ট্রেন্ডস ইনেশিয়েটিভের র‌্যাংকিংয়ে মাতৃদুগ্ধ পান করানোয় বাংলাদেশ বিশ্বে এক নম্বর। ইউনিসেফের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৫৫ শতাংশ শিশু ছয় মাস পর্যন্ত কেবল মায়ের দুধ পান করে, বিশ্বে যে হার ৪২ শতাংশ।

২০১৬ সালের এক হিসেবে দেখা গিয়েছিল- ঘণ্টায় ২৫৩ জন শিশু জন্মেছে। আর দিনে ৬ হাজার ৭০ জন। এভাবে বছর পেরোতে পেরোতে শিশুর সংখ্যা সে বছর বেড়েছে ২০ লাখেরও বেশি। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী খসড়া হিসেবে ধরে নেই, দেশে কমপক্ষে ৪০ লাখ শিশু রয়েছে যারা মাতৃস্তন পান করে। অর্থাৎ কম করে হলেও ৩৫ বা ৩৬ লাখ মা এই সংখ্যক শিশুর জন্মদাত্রী। শিশু এবং মায়ের সংখ্যা মিলিয়ে ৭৫ লাখ বা পৌনে এক কোটি। অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ পান করানোর সাথে কমবেশি দিনে ৭৫ লাখ মানুষ সংশ্লিষ্ট থাকেন।

সত্যিকার অর্থে শিশুখাদ্য হিসেবে মাতৃদুগ্ধের কোনও বিকল্প নেই। কোভিড-১৯ সংক্রমণে দুই থেকে আড়াই বছর থমকে গিয়েছিল পৃথিবী। তখনও এটাই প্রমাণ হয়েছে দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর রোগপ্রতিরোধের জন্যও মায়ের দুধের কোনও বিকল্প নেই। মাতৃদুগ্ধ ছয়মাস বয়সী শিশুর জন্য এমনকি পানিরও বিকল্প। অর্থাৎ সদ্য আলোর মুখ দেখা ফুটফুটে ছানাদের জন্য এটাই ওষুধ, এটাই জীবন।

কিন্তু দেখুন, আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো মা তার শিশুকে নিয়ে কোথাও বের হলে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। নেই প্রাইভেসি রক্ষা করে সন্তানকে প্রয়োজনীয় খাবারটুকুর জোগান দেওয়ার জায়গা। ধরুন কেউ একজন তার স্ত্রী ও  শিশু সন্তানকে নিয়ে কোথাও খেতে গেছেন। রেস্তোরাঁর জমকালো পরিবেশে সময়টা ভালোই কাটছিলো। শিশুটিও বাবা-মায়ের সাথে রেস্তোরাঁর আলো-আঁধারি উপভোগ করছিল, খেলছিল। কিন্তু এসময়ই তার মাতৃস্তন্য পান করা নেশা লাগলো কিংবা ক্ষুধাও তৈরি হলো। কী করবেন?

অথবা বাসে-ট্রেনে করে ঘুরতে গিয়েছেন কোথাও, বাচ্চা হঠাৎই কান্না শুরু করলো বুকের দুধ খাওয়ার জন্য। কী করবেন?

সংস্কৃতিগত কারণেই সাধারণত আমাদের দেশের মায়েরা যেটি করেন, সেটি হলো বড় চাদর দিয়ে আড়াল তৈরি করে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। দু:খজনক হলেও সত্যি এ পুরো ব্যাপারটি অনেকক্ষেত্রেই পাবলিক প্লেসে বিড়ম্বনার, অস্বস্তির এবং তারচেয়ে বড় ব্যাপার বাচ্চা ও মায়ের জন্য আরামদায়ক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাচ্চা এরকম বদ্ধ পরিবেশে দুধই খেতে পারছে না। আপনি নিজেই চিন্তা করুন- বদ্ধ অবস্থায় আপনি কিছু খেতে পারেন?

প্রতিবছর অগাস্টের ১ থেকে ৭ অর্থাৎ প্রথম সপ্তাহে 'বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ' পালন করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে পালিত হওয়া এ উদ্যোগটি এবার তিন দশকে পা দিচ্ছে। এই তিন দশকে নি:সন্দেহে এই সপ্তাহ পালনের ফলে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এই বিষয়ে আইনও তৈরি হয়েছে। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সফলতার কথা তো আগেই বলেছি।

তবে এখনই আরও বেশ কিছু উদ্যোগ নিলে, মাতৃদুগ্ধ পানের প্রায় সব সূচকে বাংলাদেশ আরেকটি অনন্য ভূমিকা রাখবে।

চলতি ২০২২ সালের অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে পালিত হতে যাওয়া মাতৃদুগ্ধ পান সপ্তাহের স্লোগান- 'Step Up For Breastfeeding, Educate and Support.' লক্ষ্য করুন এই স্লোগানের শেষের শব্দটি হচ্ছে 'সাপোর্ট'।

সচেতনতা তৈরিতে আমাদের নানা সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। যারা আসলে বিস্ময়কর ভূমিকা রেখেছে বলেই আমি মনে করি। কিন্তু সাপোর্ট ইস্যুতে এখনো ঘাটতি রয়েই গেছে। সেক্ষেত্রে আমি আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবগুলো তুলে ধরছি-

ক. সমস্ত পাবলিক প্লেস- যেমন মার্কেট, বাজার, বড় বড় দোকানে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর জন্য পর্দাঘেরা একটি ব্রেস্টফিডিং কর্নার করা। সেখানে নিদেনপক্ষে তিন বা চারজন মা যেন সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন সেই স্পেস রাখা।

খ. স্টেশন-বাস স্টপ এবং ট্রেনেও এই স্পেস রাখা। বাসের জার্নিতে হাইওয়ে রেস্তোরাঁয় এটি বাধ্যতামূলক করা। আর বাসেও ড্রাইভারের পেছনের সিটে কোনও স্পেস বের করা যায় কিনা সেটি ভেবে দেখতে হবে।

গ. ফেরি বা লঞ্চগুলোতে কেবিনের বাইরে সাধারণ যাত্রীদের জন্য কমন 'ব্রেস্ট ফিডিং বুথ' রাখা।

ঘ. পর্যটন কেন্দ্র ও পার্কগুলোতেও একই ধরনের বুথ রাখা।

ঙ. এমকি মেট্রোরেলের ভেতরে এবং স্টেশনের পরিকল্পনাতেও এ ধরনের একটি বুথ রাখার দরকার ছিল।

চ. এমনিতে বাংলাদেশের মসজিদগুলোয় নারীদের যাতাযাতের চল নেই। তবে ঐতিহাসিক মসজিদ যেমন ষাটগম্বুজ, সোনা মসজিদসহ দেশের অন্যান্য ধর্মীয় উপসনালয়গুলোতেও মাতৃস্তন্য পান করার জন্য বুথ রাখা উচিত। বিশেষ করে মন্দির ও চার্চে নারী ও শিশুদের যাতায়াতের চল রয়েছে।

শিশুর নানা শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি মৃত্যুঝুঁকি কমাতে মাতৃদুগ্ধ হলো রক্ষাকবচ। তাই কোনো অবস্থাতেই দুই বছর পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত না করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি তথ্য বলছে, দুই বছর পর্যন্ত স্তন্যপান করাতে পারলে বছরে ৮ লাখ ২০ হাজার শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব।

বছর কয়েক আগে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে পড়েছিলাম নবজাতকের মায়েরা মাতৃদুগ্ধ পান করানো নিয়ে কী ধরনের বিপদে পড়েন। অনেকেই পাব্লিক প্লেসের বিচিত্র বিড়ম্বনার কথা তুলে ধরেছেন।

আমাদের দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী তাই পাবলিক প্লেসে ব্রেস্ট ফিডিং বুথ তৈরি করার বিকল্প নেই। এক বা দুই বছর বয়সী একটি শিশু বুকের দুধ খাওয়ার কান্না করছে- মা পারিপার্শ্বিকতার জন্য দিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে লোকজন বিরক্ত হচ্ছে, বা কী ভাবছে তার চেয়েও বড় বিষয়টি ঘটে শিশুটির মায়ের মনোজগতে। কেননা এ শিশুটি ভালোর জন্যই তিনি তো বিলিয়ে দেন তার জীবনের বড় অংশ, অথচ তাকেই কিনা দুধ খাওয়াতে পারছেন না!