নির্বাচন কমিশনে আস্থা ফিরবে কবে?

জায়েদ বিন নাসেরজায়েদ বিন নাসের
Published : 9 April 2022, 02:07 PM
Updated : 9 April 2022, 02:07 PM

বাংলাদেশের ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে আবারও  একজন আমলাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচন কমিশনে এখনও পর্যন্ত নিয়োগ পাওয়া ১৩ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে ৭ জন উচ্চ আদালতের বিচারক আর ৬ জন সাবেক সরকারি আমলা ছিলেন। এবারসহ টানা চার বার নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে এলেন সরকারি আমলা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করে ৫১-তে পা দিয়ে একটা আইন বানানো হয়েছে। 

যদিও সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ, নির্বাচন কমিশনের নিয়োগসহ আরও অন্যান্য বিষয়ে আইন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার সেটি ৫০ বছরেও পারেনি বা করেনি। বিএনপির সংসদ সদস্যরাও সংসদে এই আইন প্রণয়নে অংশ নিয়েছেন। যদিও সংসদের বাইরে নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত কাজে বিএনপি-র কোনওরূপ অংশগ্রহণ ছিল না, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে প্রস্তাবিত নাম চাইলেও তা দেয়নি, এমনকি রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতেও যায়নি দলটি। অনুসন্ধান কমিটিকেও দলটি মেনে নেয়নি। 

আইনমন্ত্রী গত বছরের শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন, কম সময়ে আইন করে এবার নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা সম্ভব নয়। হুট করে আওয়ামী লীগ যেদিন রাষ্ট্রপতির সাথে নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত ব্যাপারে আলাপে গেল, সেইদিন এই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে জনগণকে জানিয়ে চমকে দেওয়া হলো। 

গত দুইটি সংসদ নির্বাচন হয়েছিল রকিব কমিশন আর নুরুল হুদা কমিশন দায়িত্বে থাকাকালীন। ২০১৪ আর ২০১৮ সালের নির্বাচনের একটিতে অংশগ্রহণ না থাকা এবং অন্যটিতে 'ভোট কারচুপি', 'জালিয়াতিসহ সময়ের আগেই ভোট কেটে ফেলার' অভিযোগ রয়েছে। প্রাণহানি ঘটার পরও বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে বাজে মন্তব্য, প্রার্থীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে ঘটনার তদন্ত করে ব্যবস্থা না নেওয়া, কথা বলে মানুষ হাসানো, আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মসহ নানান অভিযোগ রয়েছে গত দুই কমিশনের ব্যাপারে। আগে আইন ছিল না, এখন আইন করা হয়েছে। 

আইনে অনুসন্ধান কমিটির হাতে ক্ষমতা দেওয়া আছে রাষ্ট্রপতিকে নাম প্রস্তাব করার। আইনটা খুব কম সময়েই করে ফেলা হয়েছে। তবে আইন নিয়ে আলাপ হয়েছে, সংসদীয় বৈঠকে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। আইনমন্ত্রী বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, কুড়ির অধিক (২২টি) সংশোধনী নেওয়া হয়েছে, যা আর কোনো আইনের ক্ষেত্রেই নেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আইনে অনুসন্ধান কমিটির কথা বলা হয়েছে। আইনের ধারা ৪ এর উপ-ধারা ১ এ অনুসন্ধান কমিটির কাজের ক্ষেত্রে 'স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা'-র নীতি অনুসরণের কথা হয়েছে। অনুসন্ধান কমিটিতে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংসদ সদস্যদের রাখা হয়নি। সরকার দলীয়, বিরোধী দলীয় ও স্বতন্ত্র সাংসদদের অনুসন্ধান কমিটিতে রাখা উচিত ছিল। শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি ও সক্রিয় ভূমিকা গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে বিকশিত ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়। এসমস্ত প্রতিষ্ঠানে যারা দায়িত্বে আসবেন তাদের নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে বাহাস হতে পারে, আলোচনা হতে পারে সংসদের সাধারণ বা বিশেষ অধিবেশন ডেকে। 

অনুসন্ধান কমিটি যাদের দিয়ে গঠন করার কথা বলা হয়েছে তারাও থাকবেন। অনুসন্ধান কমিটি বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত ৩০০টির বেশি নাম প্রকাশ করেছে, তবে কোত্থেকে কোন নাম অনুসন্ধান কমিটি পেল সেটি জানা গেল না। আবার চূড়ান্তভাবে অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে কোন নামগুলো প্রস্তাব আকারে পাঠালো সেটাও প্রকাশ করা হলো না। এতে স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ করা হয়নি বলে অনেকেই অভিযোগ করতে পারেন। 

আইন মোতাবেক কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দুইটি নাম প্রস্তাব করতে পারেন। কিন্তু জনগণ প্রস্তাবিত নামগুলো জানতে পারলেন না। ধারা ৫ এ চন্দ্রবিন্দুর যথেচ্ছ প্রয়োগ হয়েছে। একই ব্যক্তির কথা বলতে গিয়ে এক জায়গায় চন্দ্রবিন্দু না দিয়ে বাকি তিনটি জায়গায় চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করা হয়েছে। ধারা ৭ অনুযায়ী সাচিবিক দায়িত্ব মন্ত্রীপরিষদ বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। তবে অনুসন্ধান কমিটির কার্য-সম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ব্যবহারটাই যথাযথ হতো বলে মনে হয় আমার কাছে। 

গত তিন বার আওয়ামী সরকারের আমলে যে তিনটি কমিশন গঠিত হলো সেখানে প্রতিবারই সাবেক আমলাকে নেতৃত্বে থাকতে দেখা গেছে। এই তিনটি কমিশনে মোটামুটিভাবে একজন সাবেক সামরিক আমলা আর একজন নারীকেও পেয়েছি অনুসন্ধান কমিটির দ্বারা; কখনও আরও আমলা, কখনও বিচারকও নিয়োগ পেয়েছেন। তবে গত দুই কমিশনের কাজের ফিরিস্তি জনগণ জানে। 

সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাবেক আমলা। তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের লিগ্যাল অ্যান্ড ড্রাফটিং শাখার অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। এটি প্রশাসনিক ক্যাডারের একটি পদ। এই পদে থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ পাওয়ার নিয়ম না থাকলেও তিনি সেখানে নিয়োগ লাভ করেন। এ কারণে পদোন্নতি বিধিমালা- ২০০২ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ কাজী হাবিবুল আউয়ালের নিয়োগ অবৈধ বলে রায় দেয়।

কাজী হাবিবুল আউয়ালকে আইন সচিব নিয়োগ দেওয়ার পরই আদালতের বিচারকসহ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা তার অপসারণ দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এর আগে অবশ্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ দিয়েও সুফল পাওয়া যায়নি। বিচারপতি আব্দুর রউফের সময় মাগুরার উপ-নির্বাচন হয়, যেটি ছিল অনেকটাই বিতর্কিত। 

আবার বিচারপতি এম এ আজিজের সময়কালও ছিল চরমভাবে বিতর্কিত।  কম-বেশি সব দলই নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কথা বলেছে, কেউ কেউ এখনও বলছে। তবে সাবেক কমিশনগুলোর মূল্যায়নে কেউই উদ্যোগী হয়নি, কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। 

এভাবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি বজায় রাখলে কেউই ভালো কাজে উৎসাহ-আগ্রহ পাবেন না। দায়িত্বে থাকাকালীন খারাপ কাজে সম্পৃক্তদের বিচার না করলে বর্তমানে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের খারাপ কাজের পরিণতি বোঝানোও সম্ভব না। আমলারা আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছেন, এর আগে বিচারকদের দিয়ে কমিশন করেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ভালো ফল পাওয়া যায়নি। 

সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা দিবে- একথাটাই বলা আছে। এতে বোঝা যায় নির্বাচনকালীন বা কমিশনের প্রয়োজনে নির্বাহী বিভাগটা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকে না, নির্বাচন কমিশনের অধীনস্ত থাকে। তবে মাগুরার উপ-নির্বাচনে নির্বাহী বিভাগ সরকারের আজ্ঞাবহই ছিল বলে মনে হয়েছে। 

কিন্তু বিচারটা কি হয়েছে? বিএনপির ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন, তামাশার নির্বাচনের বিচার কই? ভোট জালিয়াতি, ব্যালট বাক্সে মরা মানুষের ভোট ফেলানো ইত্যাদি অপরাধের বিচার আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে একটিও হয়নি। ভোটাধিকার একটি মৌলিক অধিকার। অন্যভাবে বললে বলতে হয় সকল মানবাধিকারের জননী হচ্ছে ভোটাধিকার। নির্বাচন কমিশনের একটা নির্বাচন পরিচালনা করার মতো পর্যাপ্ত জনবল নেই। তাই কমিশনকে নির্বাহী বিভাগের কর্মচারীদের দ্বারস্থ হতে হয়। নির্বাহী বিভাগ কমিশনকে সব রকমের সহায়তা দিবে- এমনটাই সংবিধানের আদেশ। কিন্তু যদি না দেয় তবে নির্বাহী বিভাগে কর্মরত কর্মচারীদের কী শাস্তি হবে সেটার উল্লেখ কোথাও নেই। সাধারণ চাকরি বিধি অনুযায়ী বিধিভঙ্গ, দায়িত্বে হেলা, দায়িত্ব পালন না করা, অসৌজন্যতা বা আদেশ উপেক্ষা করার শাস্তি নাকি রাষ্ট্রদ্রোহিতার সাজা নাকি মানবতাবিরোধী অপরাধের সাজা নাকি নতুন করে বিধান তৈরী করে সাজার কথা উল্লেখ করতে হবে- এটা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। অথচ বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর এবং একাধারে গুরুত্বপূর্ণও বটে। তাই সামষ্টিকভাবেই আমাদের কাজ করতে হবে। বাঁচাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলোকে, ফিরিয়ে আনতে হবে ভোটাধিকার। এরজন্য পুরো জাতির সামগ্রিক ঐক্য ও সম্মিলিত প্রয়াসের কোনও বিকল্প তো দেখি না। 

যে জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা আনতে জানে, যে জাতি ঘোষণা দিয়ে নিজ রক্তক্ষয়ী বিপ্লবী সংগ্রামের ন্যায্যতা যাচাই করতে জানে, যে জাতি ২৩ বছরের মাথায় অধিকার হরণ, কথার বরখেলাপ আর বৈষম্যের জন্য সামরিকভাবে জগৎজোড়া শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধে কাবু করতে জানে, যে জাতি নিজ ভাষা-সংস্কৃতি ও সত্তা রক্ষায় প্রাণ ঝরাতে পারে, যে জাতি স্বৈরাচারকে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিদায় জানাতে জানে সেই জাতি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না- এ কথা বিশ্বাস করি না। দরকার শুধু জনতার রাজনৈতিক ঐক্য আর প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার।