অভিজিৎ হত্যাকারীদের যুক্তরাষ্ট্রে বিচারের সম্ভাবনা কতোটুকু?

মোস্তফা সারওয়ারমোস্তফা সারওয়ার
Published : 24 Dec 2021, 07:20 PM
Updated : 24 Dec 2021, 07:20 PM

২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলা সাড়ে ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবনের কাছে জঙ্গি নরপশুদের চাপাতির আঘাতে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখকদের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের পতন ঘটে। বিজ্ঞানের ও দর্শনের জনপ্রিয় ধারার লেখক ড. অভিজিৎ রায়-কে হত্যা করা হয় নিদারুণ নিষ্ঠুরতায়। তার স্ত্রী আইটি বিশেষজ্ঞ রাফিদা আহমেদ বন্যাকেও আহত করা হয়।  অদূরে নিথর ভাবে দাঁড়িয়েছিল শান্তিরক্ষা বাহিনী। পৃথিবীব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। অভিজিৎ ও বন্যা উভয়েই মুক্তমনা। জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য সহ মানুষের চিন্তার জগত হবে মুক্ত, থাকবে না কোন বাঁধা,- এই মহান আলোকিত ধারায় তাদের বিশ্বাস ও অগ্রপথিকের ভূমিকা ছিল কুলাঙ্গার নরপশুদের জঘন্য ও হিংস্র হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ।

ছয় বছর দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও বিচারের শেষে ২০২১ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি আসামিদের পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই ছয় জনের মধ্যে দুইজন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত  খুনি, বরখাস্ত মেজর জিয়া ও আকরাম, নিখোঁজ রয়েছে।    

পলাতক আসামিদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ২০২১ সালের ২০শে ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট (পররাষ্ট্র দপ্তর) ৪২ কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনসহ অনেকেই সাধুবাদ দিচ্ছেন পুরস্কারটিকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা ব্যক্ত করেছেন যে, এই পুরস্কার ঘোষণা পলাতক অপরাধীদের ধরায় সহায়তা করবে।  

কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- দীর্ঘ দশ মাস চারদিন পর হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিপুল অর্থের পুরস্কার ঘোষণার অংশ, "জিয়া, আকরাম কিংবা জড়িত অন্য কারও তথ্য থাকলে সিগন্যাল, টেলিগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে নিচের নম্বরে (+1-202-702-7843) বার্তা পাঠান। এরপর আপনি পুরস্কার পেয়েও যেতে পারেন।" পররাষ্ট্র দপ্তর আরও বলেছে, "তদন্ত কাজ চলছে এবং যাতে এ জঘন্য সন্ত্রাসী আক্রমণে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা যায়, সেজন্য তথ্য চাওয়া হচ্ছে।"

লক্ষ্য করুন 'জড়িত অন্য কারও তথ্য' এবং 'তদন্ত কাজ চলছে'। এ দুটো উদ্ধৃত শব্দগুচ্ছে প্রতীয়মান যে যুক্তরাষ্ট্র ১৬ই ফেব্রুয়ারির বিচারিক রায়কে মানছে না। দীর্ঘ দশ মাস চারদিন পর আর্থিক ও সামরিক শক্তিতে ভয়ঙ্কর বলিয়ান একমাত্র সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের ঘুম ভাঙলো। ৯ই ডিসেম্বর হতে ২০শে ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ঘোষণায় অনেকেই ভাবতে পারেন- দানবীয় শক্তির অধিকারী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বর্তমান শাসক শ্রেণির ওপর 'ক্ষেপে' গিয়েছে। 'যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ানক ক্ষেপে' যাওয়ার পরিণতি ইরাক ও আফগানিস্তানে অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। আমার ধারণা কোন না কোন কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভয়ানক নয়, কিছুটা খেপেছে।  

তাই দেখছি, ডিসেম্বর ৯ থেকে ১০ পর্যন্ত 'গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলন'- এ ১১১টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের ঠাঁই মেলেনি। অবাক হয়ে দেখলাম উপমহাদেশের পাকিস্তান, ভারত, নেপাল আমন্ত্রিত হয়েছে – কিন্তু বাংলাদেশ নয়। এই সম্মেলনের সমাপ্তি ঘণ্টা বাজার আগেই ১০ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র‍্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাতজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। এর মাত্র দশ দিন পর ২০শে ডিসেম্বর অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও বিচারটি শেষ করে বাংলাদেশ রায় দিয়েছে দশ মাস চার দিন আগে। মনে হয়, আরব্য রজনীর বিশালাকার দৈত্য কিছুটা নড়েচড়ে বসছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো,  যুক্তরাষ্ট্র কি একাই অভিজিৎ হত্যার বিচার কাজ সম্পাদন করতে পারবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাংঘর্ষিক বক্তব্যে প্রতীয়মান যে তারা দুইজনেই যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ছিটেফোঁটাও আঁচ করতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে আদৌ গণ্য করেনি। এটা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য সুখবর নয়। কোথাও যেন মন্ত্রী অথবা উপদেষ্টা পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগে একটু বিচ্ছিন্নতা উঁকি দিয়েছে।    

উপরের প্রশ্নের উত্তরের শুরুতেই উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই হত্যাকাণ্ড তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই যুক্ত ছিল। অতএব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রমাণাদির অংশবিশেষ জানা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিচারকার্য এক জটিল ব্যাপার। প্রথম প্রশ্ন হলো- এক রাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার এককভাবে সম্পন্ন করার অধিকার রয়েছে কি?  

যুক্তরাষ্ট্রের আইনে জাতীয়তা তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে- 'দ্য প্যাসিভ পারসোনালিটি প্রিন্সিপ্যাল'। এটি অনুযায়ী, এক দেশের নাগরিক যদি অন্য দেশের ভূখণ্ডে অন্য দেশের নাগরিক দ্বারা  ক্ষতিগ্রস্ত হন, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকের দেশের আওতায় (jurisdiction) আসবে এই অপরাধের বিচার । উদাহরণস্বরূপ, অভিজিতের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের নাগরিকরা তাকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে খুন করেছে। এই খুনের বিচার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত অভিজিতের দেশ যুক্তরাষ্ট্র সম্পাদন করতে পারবে।

১৯৯৮ সালে এমন একটি মামলার নিদর্শন রয়েছে লুজিয়ানা স্টেটে- যেখানকার আমি এখন অধিবাসী। মামলাটির নাম 'যুক্তরাষ্ট্র বনাম রবার্টস'। মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, সেইন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনেডাইন নামক রাষ্ট্রের নাগরিক রবার্টস যৌন হয়রানি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অপ্রাপ্তবয়স্ক এক নারীকে। ঘটনা স্থান একটি সামুদ্রিক জাহাজ। জাহাজটির নিবন্ধন ছিল লাইবেরিয়ায় এবং মালিক ছিল পানামার।  ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি দ্বারা অপরাধীকে অভিযুক্ত করা হয়, লুজিয়ানার পূর্বাঞ্চলীয় ফেডারেল ডিসট্রিক্ট কোর্টে। ফেডারেল ডিসট্রিক্ট কোর্টে অপরাধীর কৌঁসুলিরা প্রশ্ন তুলে ছিল জুরিসডিকশন এর বৈধতা নিয়ে। ফেডারেল কোর্ট এই চ্যালেঞ্জকে নাকচ করে দেয়। তার অর্থ – এই মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা অভিজিতের খুনের মামলা তদন্ত এবং বিচার সম্পাদনে উপরোক্ত মামলাটিকে পূর্ববর্তিতা (precedence) র উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

তবে সমস্যা হলো- সাক্ষী পাওয়া ও অন্যান্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করা। সাক্ষীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমন জারি অধিকার নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। এর অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই মামলাটি এককভাবে সম্পাদন করা হবে নিতান্ত দুরূহ। আর যদি বাংলাদেশের সহযোগিতা থাকে, তবে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র এই মামলাটি করলেও করতে পারে। কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই ইচ্ছাটা জেনেছে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে। অন্তত সেটাই আমার মনে হয়েছে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ের বক্তব্যে। 

আরও একটি প্রশ্ন। পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড ও একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এর পরিবর্তে ছয় জনের মৃত্যুদণ্ডই কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা? অথবা যুক্তরাষ্ট্রের ধারণায় কেউ যদি পার পেয়ে থাকে, তাকে ধরার চেষ্টা?

গুয়ান্তোনামো বে-র বন্দিদের অনেকেই হিংসাত্মক জঙ্গি কাজ করেছে। এমনকি গুয়ান্তোনামো থেকে ছাড়া পেয়ে পুনরায় যোগ দিয়েছে জঙ্গি সংগঠনে। কয়েকজন আফগানিস্তানের বর্তমান তালেবান সরকারের মন্ত্রী। অনেক প্রমাণ ও স্বীকারোক্তি থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র কোন মামলা দায়ের করতে পারেনি- এমনকি সামরিক আদালতে। তার অর্থ কি গুয়ান্তোনামো বে-র বন্দিরা সবাই ধোয়া তুলসি পাতা? মোটেই নয়।

ঘটনা হলো মারাত্মক নির্যাতনের মাধ্যমে ওই বন্দিদের স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল অতি উৎসাহী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এমন কি সামরিক আদালতে এসব স্বীকারোক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই ওই বন্দিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে কোনও মামলা দেওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে অভিযুক্তদের উত্তম-মধ্যমসহ নানা নির্যাতনের অভিযোগ বহু পুরনো। সংবাদে, সোশাল মিডিয়ায় হরহামেশাই এ ধরনের নির্যাতনের সত্যতাও দেখা যায়। এমনকি রাজনৈতিক বন্দিদেরও কপাল তেমন ভাল থাকে না। অভিজিতের খুনিরাও নিশ্চয়ই জামাই আদর পায় নি। যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে যদি ওদের বিচার হয়, তবে নির্যাতনের যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা (defence) আইনজীবীরা ফরিয়াদি (prosecution) আইনজীবীদের জীবন দুর্বিষহ করে ফেলবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমার উপসংহার হলো, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারকে চাপে রাখার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ৪২ কোটি টাকা পুরস্কার দুই পলাতক অপরাধীকে ধরতে অবশ্যই সাহায্য করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত ও মামলার ধমক হলো 'বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া' (অত্যধিক ঘটা করে আরম্ভ অনুষ্ঠানের ফল সামান্যমাত্র)। তথাপি একে শেকসপিয়ারের নাটক 'Much Ado About Nothing' বলে উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন বলে মনে হচ্ছে না। একচ্ছত্র আর্থিক ও দানবীয় সামরিক শক্তির অধিকারী দেশটির কুনজরে পড়াটা মঙ্গলজনক মনে হয় না। ঝুঁকি এবং পুরস্কার এর হিসেব নিকেশ সঠিকভাবে সম্পাদন ও বিশ্লেষণ করাই শ্রেয়।