আবার শুষ্ক মৌসুম, আবারও বায়ুদূষণ

মো. মাসুদ রানা
Published : 20 Dec 2021, 10:29 AM
Updated : 20 Dec 2021, 10:29 AM

সারাদিন কেমন যাবে, সকাল যেমন তার ধারণা দেয় তেমনি নভেম্বর মাস ধারণা দেয় সারা শুষ্ক মৌসুমে ঢাকাবাসীর জন্য কেমন বায়ু অপেক্ষা করছে। গত বছর নভেম্বর মাসের বায়ুমান তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলাম, সে মাসে (নভেম্বর, ২০২০) ঢাকা শহরের বাতাসে পিএম২.৫ (২.৫ মাইক্রোমিটারের চেয়েও ক্ষুদ্র বস্তুকণা)-এর মাসিক গড় মানমাত্রা তার পূর্ববর্তী নভেম্বর মাসের (নভেম্বর, ২০১৯) মানমাত্রার চেয়ে ৫.৪% বেশি ছিল– অর্থাৎ গত শুষ্ক মৌসুমে বায়ুর অবস্থা তার পূর্ববর্তী বছরগুলোর শুষ্ক মৌসুমের বায়ুর অবস্থার সাপেক্ষে উর্দ্ধমুখী থাকলেও খুব বেশি খারাপ ছিল না। যদিও, পিএম২.৫-এর সেই মাত্রাও (প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৯৭.০ মাইক্রোগ্রাম) বাংলাদেশ অনুমোদিত দৈনিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ১.৫ গুণ উপরে, আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত দৈনিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ৩.৯ গুণ উপরে।

এ বছর নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমাত্রায় ঢাকার বায়ু দূষিত হতে দেখা যায়– সারা মাসে মাঝেমধ্যেই বায়ুমান সূচক আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড সাপেক্ষে "অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর" পর্যায়ে অবস্থান করেছে। এ বছরের নভেম্বর মাস শেষে পিএম২.৫ এর মাসিক গড় মানমাত্রা পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১৩০.০ মাইক্রোগ্রাম হয়েছে যা বিস্ময়কর, উদ্বেগজনকও বটে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বায়ুর মান সাধারণত সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকে, তখন বাতাসে পিএম২.৫ এর গড় মানমাত্রা ১৯০.০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার হয়ে থাকে। কিন্তু, এ বছর নভেম্বর মাসে বায়ুমান মাত্রা পূর্বের একই সময়ের তুলনায় যে হারে (৩৪.০%) বৃদ্ধি পেয়েছে সেই একই হারে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসেও বৃদ্ধি অব্যহত থাকলে ঢাকাবাসী যে একটি ভয়াবহ অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে, এখন থেকেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ জরুরী হয়ে পড়েছে।

আবহাওয়াজনিত কারণে নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে শুরু করে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা তীব্র বায়ুদূষণপ্রবণ হয়ে ওঠে। এই সময়ে উক্ত এলাকা জুড়ে সংঘটিত বায়োমাস দহন এবং কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও যানবাহনের নিঃসরণের কারণে ভয়াবহ মাত্রায় বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। সারা মাস জুড়েই লাহোর, পেশোয়ার, দিল্লি– এই শহরগুলি বায়ুদূষণ সূচকে বিশ্বে প্রথমদিকে অবস্থান করে। বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, চীনসহ আমাদের অত্র অঞ্চলটির বাতাসই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত। আইকিউ এয়ার- এয়ার ভিজুয়ালের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত ১০০ শহরের সবগুলোই চীন এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত; তার মধ্যে ভারতের ৪৬টি, চীনের ৪২টি, পাকিস্তানের ৬টি, বাংলাদেশের ৪টি এবং ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের ১টি করে শহর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইফেক্ট ইন্সটিটিউট ও ইন্সটিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন কর্তৃক যৌথভাবে ২০২০ সালে প্রকাশিত স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার রিপোর্ট-২০১৯ অনুযায়ী বায়ুদূষণজনিত কারণে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে মোট ৬.৬৭ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে যার ৫৮.৭ শতাংশই চীন ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের। উক্ত রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত কারণে মোট মৃতের সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ১৪ হাজার।

দূষিত দেশসমূহের মধ্যে ইদানীংকালে চীন এবং ভারতকে বায়ুমান উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দসহ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে, যার টেকসই সুফলও দৃশ্যমান হচ্ছে। দুই দশক আগেও চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের বাতাস ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত। ২০০৮ সালের অলিম্পিককে সামনে রেখে উন্নয়নমূলক কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও সেখানে অলিম্পিক পরবর্তী সময়েও বায়ুমান উন্নয়ন কর্মসূচি অব্যহত থাকে। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে শক্তি উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানী ও উন্নত টেকনোলজির ব্যবহার বৃদ্ধি করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধি করা, শীতকালে আবাসিক ভবন উষ্ণতায় কাঠ/কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা, রাস্তায় বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। এমন সব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে বেইজিংয়ের বাতাস এখন অনেকটাই দূষণ মুক্ত– এক সময়ে এক নম্বর স্থান দখলকারী বেইজিং শহরকে এখন আর অধিক দূষিত শহরগুলির তালিকায় পাওয়া যায় না। শুধু বেইজিংই নয়, প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চীন তার অন্যান্য শহরের বায়ুমান উন্নয়নেও কাজ করা অব্যহত রেখেছে।

ভারতও ইদানীংকালে দূষিত শহরগুলির বায়ুমান উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ২০১৮ সালে ভারতের দূষিত শহরগুলির বায়ুমান উন্নয়নে 'জাতীয় পরিচ্ছন্ন বায়ু কর্মসূচি' গ্রহণ করা হয় যেখানে ১২২টি শহরকে প্রাথমিকভাবে 'নন-এটেইনমেইন্ট' শহর হিসেবে চিহ্নিত করে উক্ত কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। উক্ত কর্মসূচির আওতায় ২০২৪ সালের মধ্যে 'নন-এটেইনমেইন্ট' শহরগুলির বাতাসের দূষণ ২০১৭ সাল সাপেক্ষে ২০–৩০% হ্রাস করার টার্গেট করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, সকল শহরে একই কর্মসূচি না নিয়ে বরং শহরভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, শহর/রাষ্ট্রভেদে বায়ুদূষণের কারণ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন, চীনে শীতকালে ভবন উষ্ণ রাখতে কাঠ/কয়লার ব্যবহার বায়ুদূষণের একটি অন্যতম কারণ যেখানে দিল্লি শহরে বায়োমাস দহন একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শহরগুলিতে ধুলার উৎসসমূহ বায়ুদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। কোনো কোনো শহরে দূরবর্তী, এমনকি আন্তঃরাষ্ট্রীয় উৎসও বায়ুদূষণের কারণ হয়ে থাকতে পারে। ভারতে আকস্মিক বায়ুদূষণ থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য সবার্থে তাৎক্ষণিক বা স্বল্পমেয়াদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেও দেখা যায়। যেমন, নভেম্বরে দিল্লিতে তীব্র বায়ুদূষণকালে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা, ১১টির মধ্যে ৫টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করা, বাসা থেকে অনলাইনে অফিস চালানোর পরামর্শ দেয়া ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশেও শুধু ঢাকার বায়ুমান উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে; তন্মধ্যে, ঢাকা থেকে ২-স্ট্রোক বেবি ট্যাক্সি অপসারণ এবং গত দুই মৌসুম ধরে ঢাকার আশেপাশে বিদ্যমান অবৈধ ইটভাটা বন্ধকরণ অন্যতম। ইটভাটা সম্পর্কিত নতুন আইন ও বিধিমালা গ্রহণ করা হয়েছে যেখানে নিঃসরণ মানমাত্রাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে; ইটভাটার প্রচলিত প্রযুক্তি দিয়ে এই মানমাত্রা অর্জন সম্ভব নয় বিধায় ইট উৎপাদনে পুরাতন পদ্ধতির স্থলে উন্নত, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্রসারিত হবে বলে আশা করা যায়। উক্ত বিধিমালায় ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ সরকারি স্থাপনায় ব্লক ইটের ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে; এর ফলে পোড়া ইটের ব্যবহার কমবে। তবে, ইটভাটার বিরুদ্ধে এসব অভিযান ও আইন প্রণয়ন ঢাকার বায়ুদূষণ হ্রাসে তেমন অবদান রেখেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। প্রথমত, ঢাকার বায়ুদূষণে ইটভাটা কতটা দায়ী তা নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে আর দ্বিতীয়ত, 'ইট প্রস্তুতকরণ ও ভাটা স্থাপন' আইনটি ২০১৮ সালে এবং নিঃসরণ মানমাত্রা পুনর্নিধারণ সংক্রান্ত বিধিমালাটি ২০২০ সালে গ্রহণ করা হলেও এখনো মাঠ পর্যায়ে এসব বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়নি। এমতাবস্থায়, দেশের শহরগুলির বায়ুদূষণ হ্রাসে কার্যকর পদ্ধতি চিহ্নিতকরণসহ মাঠ পর্যায়ে তার সঠিক প্রয়োগ সময়ের একান্ত দাবি হয়ে উঠেছে।

প্রযুক্তির এই যুগে একটি শহরকে ধুলামুক্ত করা যাবে না এটা সত্যি বিস্ময়কর। আমাদের নির্মাণ কাজগুলিতে পদ্ধতিগত, পর্যবেক্ষণগত ও প্রায়োগিক কোনো সমস্যা আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ হলে সেখানে আইনি প্রয়োগ হতে তেমন একটা দেখা যায় না। কোনো একটি রাস্তা নির্মাণ বা সংস্কারের সময় দেখা যায় পুরো রাস্তা জুড়ে ধুলা ছড়িয়ে গেছে; টেলিফোন, সুয়ারেজ, গ্যাস, ইত্যাদি সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলি কোনো রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করার সময় সমস্ত ধুলা/কাদা রাস্তার পাশে উম্মুক্তভাবে জমা করে, আবার কাজ শেষে রাস্তাটিকে আগের অবস্থায় না এনেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। সিটি করপোরেশন কর্তৃক রাস্তা ও ড্রেন পরিষ্কার করার পদ্ধতিও গ্রহণযোগ্য নয়। করপোরেশনের আওতায় থাকা খেলার মাঠ/ইদগাহগুলি শুষ্ক মৌসুমে এক একটি ধুলার বড় উৎস হয়ে উঠে। বিন্ডিং ভাঙ্গা থেকে শুরু করে, নির্মাণসামগ্রী পরিবহণ ও স্টোরেজ, সবকিছুই ধুলার উৎস। এসব জায়গায় পরিবর্তন নিয়ে আসা কি খুব বেশি চ্যালেঞ্জিং নাকি আমাদের মনোযোগের অভাব তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

আমাদের শহরগুলিতে উৎপন্ন হওয়া আবর্জনার পরিমাণের তুলনায় ব্যবস্থাপনা বেশ অপ্রতুল; ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিও ততটা নিয়মতান্ত্রিক নয়। পরিপ্রেক্ষিতে, আবর্জনার একটি বড় অংশ রাস্তার পাশে পোড়ানো হয়, যা শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। রাস্তার পাশের এই দহন অত্যন্ত ক্ষতিকর কারণ, এখানে আবর্জনার একটি বড় অংশ পলিথিন, যার অনিয়ন্ত্রিত দহনে ক্যান্সার উৎপাদনকারী নানান কেমিক্যালস যেমন, ডাই-অক্সিন, ফুরান, ইতাদি সৃষ্টি হতে পারে। তবে আশার কথা, ইদানীং ঢাকা ও এর আশেপাশের শহরগুলিতে আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে অনিয়ন্ত্রিত আবর্জনার ডাম্পিং ও তা পোড়ানো রোধ করতে ভূমিকা রাখবে। এ ধরনের প্রোগ্রাম যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা যায় বায়ুমান উন্নয়নের জন্য ততই ভাল হতে পারে।

উপরে বর্ণিত বায়ুদূষণের কারণসমূহ মোকাবিলা করা ততটা কঠিন ও ব্যয়বহুল হবেনা, তবে এর মাধ্যমে বর্তমানের তীব্র বায়ুদূষণের একটি বড় অংশকেই এড়ানো সম্ভব হতে পারে। শহরের বায়ুদূষণে যানবাহনের ধোঁয়া বরাবরই একটি বড় উৎস। ঢাকা শহরে এখনো প্রচুর ডিজেল চালিত পুরাতন বাস চলে; তাছাড়া, প্রতিদিন কয়েক ঘন্টার যানজটে বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হয়। পরিবেশবান্ধব নতুন গাড়ি নামানো ব্যয়বহুল হলেও যানজট কমানোর প্রতি মনোযোগী হওয়া ও ধীরে ধীরে ডিজেল বাসের পরিবর্তে ইলেকট্রিক বাসের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সেক্টর থেকে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে হবে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণকে টার্গেট করে আমাদেরকে নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে; কারণ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রিত হলে রাষ্ট্রের মানুষ সুস্থ্য জীবনযাপন করবে এবং ফলশ্রুতিতে আর্থিক সাশ্রয় হবে।