দেশবন্ধু: প্রাসঙ্গিকতা, আক্ষেপ ও করণীয়

আশফাক আনুপআশফাক আনুপ
Published : 5 Nov 2021, 10:08 AM
Updated : 5 Nov 2021, 10:08 AM

লম্বা ও খর্বাকৃতির দু'জন মানুষ একটি প্রাচীরের উপর থেকে খেলা দেখতে চেষ্টা করছে; দু'জনের জন্যই প্রাচীরের উচ্চতা সমান- এটা সমানাধিকার বা ইক্যুয়ালিটি। অন্যদিকে খর্বকায় মানুষটির পায়ের তলায় একটি পাটাতন দিয়ে তাকে লম্বা মানুষটির সমউচ্চতায় তুলে আনা হচ্ছে- এটা সমদর্শিতা- ইক্যুইটি। নাগরিক অধিকার বিষয়ক যেকোনো আলাপে এই সমানাধিকার বনাম সমদর্শিতার পার্থক্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয় ইদানিং। এরই প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনবার দর্শন নিয়ে আলোচিত হয় 'ইতিবাচক ক্রিয়া' বা 'অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন' নামক ধারণাটির। পশ্চিমা সভ্যতায় সর্বপ্রথম নীতিগতভাবে এই অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন-এর বাস্তবায়ন সম্ভবত হয়েছিল ১৯৬৫ সালের মার্কিন সিভিল রাইটস অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে।

বাংলাদেশে সম্প্রতি কোটা বিষয়ক বাস্তব আলাপের একটি সুযোগ সৃষ্টি হলেও তা বেশ নোংরাভাবে সমাপ্ত হয়েছে। নানান সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে চালুকৃত বেশকিছু 'ইতিবাচক ক্রিয়া/অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন' যা প্রচলিত শব্দে 'কোটা' হিসেবে পরিচিত ছিল; তা প্রথমে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ 'বাতিল'-এর এবং পরে ২০১৮ সাল নাগাদ 'সংস্কার'-এর দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। উদ্দেশ্যহীন, বিক্ষিপ্ত এবং কক্ষচ্যুত এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ততোধিক বিক্ষিপ্ত সিদ্ধান্তে সকল প্রকার কোটার বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে সরকারি কর্মক্ষেত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

ফলশ্রুতিতে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সাম্প্রতিক অতীতে আমরা যতগুলো সফল আন্দোলন সংগঠিত হতে দেখেছি, তারমধ্যে সবথেকে স্বার্থপর, গোষ্ঠীবদ্ধ, মিথ্যাভিত্তিক ও অসৎ এই আন্দোলনটির সমর্থক-সংগঠকরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে! এই আন্দোলনটির ব্যাপারে এতটা নেতিবাচকতা প্রকাশের কিছু কারণ আছে। সবথেকে দুঃখজনক দিকটি হচ্ছে এই আন্দোলনটির সংগঠক ও সমর্থক ছিল/আছে একদল শিক্ষার্থী। জ্ঞানার্জন, সামাজিক সাম্যের দিকে যাত্রা, সমানুভূতির চর্চা আর ন্যায়ের পথ যাদের পাথেয় হবার কথা ছিল সেই ছাত্রদের একটি আন্দোলন কতটা বাস্তবতাবিবর্জিত, অমানবিক, অসাম্যমূখী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই আন্দোলনটি থেকে। তথাকথিত 'মেধার অবমূল্যায়ন' সূত্রে একদল শিক্ষিত, জ্ঞানার্থী মানুষও এদের খুব একচোট সমর্থন যুগিয়েছেন। কোটাবিরোধী আন্দোলনের কাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির দিকটি তাই যতটাই হোক, স্বাধীন বাঙালির পরিশীলিত মননে এর নীতিগত ক্ষয়ক্ষতির দিকটি তাই আমার কাছে সবথেকে বেশি দুঃখজনক ও ঘৃণার্হ। এই আন্দোলনের কুশিলবগণ ও উদ্দেশ্য সমর্থনকারীদের তাই ক্ষণিকের ভুলে পা হড়কানো অর্বাচীন বলে মনে করি না।

আন্দোলনোম্মুখ জাতি হিসেবে বাঙালির ইতিহাসে এমন আরেকটি স্বার্থপর আন্দোলন বা আন্দোলন-প্রচেষ্টার উদাহরণ প্রায় নেই বললেই চলে। খুঁজতে গেলে দীর্ঘকাল যাবত কেবল অন্য একটাই ইতিহাস চোখে পড়ে। যা সংগঠিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে। মুলত সেই ইতিহাসে প্রধান বিয়োগান্তক নায়কটিকে নিয়েই এই লেখা। বাঙালির মনে দেশবন্ধু হিসেবে আসন নেয়া রাজনীতিক চিত্তরঞ্জন দাসের কথা বলছি। আজ থেকে ১৫২ বছর আগে (৫ নভেম্বর ১৮৭০) জন্মগ্রহণ করেন এই দুরদৃষ্টিসম্পন্ন আইনজীবি, সুলেখক ও রাজনীতিক। তৎকালীন আধুনিক মানব ইতিহাসের মানবিকতম নীতিমালা তিনি গ্রহণ করেছিলেন বাঙালি সমাজের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে। পশ্চিমা সভ্যতায় এসব ব্যাপারে তাত্ত্বিক আলাপ শুরুরও বহু বছর আগেই ১৯২৩ সালে 'বেঙ্গল প্যাক্ট' নামক এক নীতিমালায় দেশবন্ধু তৎকালীন সময়ে পিছিয়ে পড়া মুসলমান বাঙালিকে কোটাভিত্তিক সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় তুলে আনার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। কোটাভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে জনসংখ্যার অনুপাতে চাকুরিক্ষেত্রে ৫৫% ও যতদিন পর্যন্ত এই অনুপাত নিশ্চিত না হয় ততদিন পর্যন্ত মুসলমান বাঙালিকে ৮০% নিয়োগদানের ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে 'অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন/ ইতিবাচক ক্রিয়া' ধারণা আসার বহু বহু আগেই এই বাঙালি মহামানব সেই ধারণার বাস্তবায়নে ব্রতী হয়েছিলেন। সে হিসেবে বৈশ্বিকভাবে এই বাঙালি রাজনীতিককে অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন ধারণার প্রবর্তক বলে রায় দেয়া যেতে পারে!

এই 'বেঙ্গল প্যাক্ট' বংগীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণীর হিন্দু রাজনীতিক 'মেধার অবমূল্যায়ন' জাতীয় সেই ঠুনকো যুক্তি দিয়ে এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। দেশবন্ধুর মতো দেবতুল্য মানুষকে নিয়ে খিস্তি-খেউরের মেলা বসে তাদের পরিচালিত নানান গণমাধ্যমে। তবে প্রথমে উল্লেখিত 'কোটাবিরোধী আন্দোলনের' মতোই 'বেঙ্গল প্যাক্ট' বিরোধী এই আন্দোলনপ্রচেষ্টার সবথেকে বাজে দিক শুধু কাঠামোগত নয়, বরং জাতির মননের যে নীতিগত ক্ষতিটি এর মাধ্যমে হয়েছে তার তুলনা হয় না। সবথেকে বাজে দিক আমি মনে করি এই স্বার্থপর ও বৈষম্যমূখী আন্দোলনটিতে নানান কারণে এমন কিছু মানুষকে আমরা সমর্থন দিতে দেখি যারা নিজেদের দৃশ্যমান সাম্যবাদী চরিত্রের জন্য খ্যাতিমান। খুব বেশি নাম নেব না, কয়েকটা নাম বলি- সুরেন ব্যানার্জি, বিপিন পাল আর প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শেষোক্ত এই লোকটি এমনকি দেশবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরেও নিজের লেখা প্রবন্ধে বেঙ্গল প্যাক্ট করবার জন্য দেশবন্ধুকে নিয়ে টিপ্পনি কেটেছেন ক্রমাগত! এদের সন্মিলিত বিরোধীতার কারণে, সুভাষ বসুদের মতো তরুণদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও, ১৯২৫-এ দেশবন্ধুর হঠাৎ মৃত্যুর সাথে সাথেই রহিত হয় 'বেঙ্গল প্যাক্ট'-এর মত প্রগতিশীল ও সময়োত্তীর্ণ ধারণাটি! এরই ফলশ্রুতিতে বাংলা ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষার সর্বশেষ বাস্তব প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয় যার মূল্য দিতে হয় ১৯৪৬-৪৭-এর দাঙ্গা আর ১৯৭১-এর ৩০ লক্ষ প্রাণ দিয়ে!

অথচ আজকে দেশবন্ধুর এই ১৫২তম জন্মদিনে এসে দাঁড়িয়েও আমাদের পরম বেদনার সাথে দেখতে হয় যে, স্বাধীন বাঙালির মূলধারায় চিত্তরঞ্জন দাস বা তার 'বেঙ্গল প্যাক্ট' নিয়ে আলাপ নেই বললেই চলে। দুঃখের সাথে উপলব্ধি করি যে, স্বাধীন বাঙালি দেশবন্ধুকে ভুলে গেছে। যেন তাকে খুব সফলভাবে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে বাঙালির মানসপট থেকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটা শ্রেণিতে দেশবন্ধুকে অপমান করা, সাম্যের গান গাওয়া অথচ চরম মুসলমান-বাঙালি বিদ্বেষী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ারে লেখা কিশোরদের পড়ানো হচ্ছে! অথচ সুলেখক, সুসাহিত্যিক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের একটি লেখাও স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে নেই। কোনোদিন ছিলও না! দেশবন্ধুকে করে তোলা হয়েছে একটি বিস্মৃত নাম! দেশবন্ধুর মতো মহান, আধুনিক আর ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি নেতা, লেখককে উপেক্ষা করে সাম্প্রদায়িক ভণ্ডদেরকে পরিচিত করাব আমরা আমাদের কিশোরদের সাথে; আর সেই অর্বাচীনতাকে ছুতো করে ধর্মব্যবসায়ীরা যখন আমার ধর্মনিরপেক্ষ পাঠ্যক্রমে কাঁচি চালানোর দাবি তুলবে তখন বুঝে উঠতে পারব না ভুলটা কোথায় করলাম! হুমায়ূন আজাদের মতো করে বলতে হয়, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা আজও শেখেনি কার সাথে পর্দায় যেতে হয়, আর কার সাথে শয্যায়।

১৫২তম জন্মজয়ন্তীতে দেশবন্ধুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে দাবি জানাচ্ছি স্বাধীন বাঙালির মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে দেশবন্ধুর রচিত প্রবন্ধসমূহ অন্তর্ভুক্ত করবার।