কিউবার কমিউনিস্ট শাসন কি অবসানের পথে?

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 4 August 2021, 02:15 PM
Updated : 4 August 2021, 02:15 PM

সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি থেকে "সমাজতন্ত্র" যখন বিদায় নিল, তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিল, আমেরিকার ঘরের পাশে থাকা কিউবার পক্ষে তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ফিদেল ক্যাস্ত্রো এবং তার সরকারকেও হয়তো অচিরেই বিদায় নিতে হবে। নানাবিধ মার্কিন এবং পশ্চিমা চাপের মাঝে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যে দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোটামুটি জনসমর্থন নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় টিকে আছে, সে দেশটিতে হঠাৎ এমন কী ঘটল যে, রাজধানী হাভানাসহ ১৪টি শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসল?

সোভিয়েত আমলে কিউবার অর্থনীতি নির্ভরশীল ছিল সোভিয়েত সাবসিডি এবং সাহায্যের ওপর। ফলে, সোভিয়েত পতনের পর দেশটি নিমজ্জিত হয় কঠিন অর্থনৈতিক সঙ্কটে। এ সঙ্কটে নতুন মাত্রা যোগ করে গেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কিউবার উপর বহু ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এর একটি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কিউবানদের দেশে রেমিটেন্স পাঠাবার পথ বন্ধ করা। বর্তমান বাইডেন প্রশাসন কিউবার ওপর ট্রাম্পের সমস্ত নিষেধাজ্ঞাই বহাল রেখেছে। তারা মুখে মুখে ট্রাম্প বিরোধিতা করলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ইরাক, আফগানিস্থান, ইসরায়েলসহ সব জায়গায় কার্যত তার দেখানো পথ ধরেই চলছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট থেকে কিউবানরা বছরে গড়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠান। কিউবার ৬০ শতাংশ পরিবার এ রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল। নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতায় এ বছর যুক্তরাষ্ট থেকে রেমিটেন্স কিউবাতে যেতে পারেনি। সাথে যোগ হয়েছে কোভিড মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ।

কোভিড সঙ্কট সমস্যা তৈরি করেছে পর্যটন শিল্পেও। বিদেশী পর্যটক না আসবার ফলে দেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে ১১ শতাংশ। উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবা পর্যটন খাতসহ আরো কিছু খাত উন্মুক্ত করে ফরেন কারেন্সি সংগ্রহ করবার জন্য। কেননা, ফরেন কারেন্সি না থাকলে তার পক্ষে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানী করা সম্ভব নয়।

ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার ফলে একদিকে রেমিটেন্স বন্ধ হয়ে যাওয়া; অপরদিকে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিদেশী পর্যটক না আসবার ফলে কিউবা চরম কারেন্সি সঙ্কটে পড়েছে। এ সঙ্কটের ফলে তার পক্ষে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করা সম্ভব হয়নি, যেটি আজকের সঙ্কটের মূল কারণ। খাদ্য সমস্যার পাশাপাশি ওষুধ, জ্বালানী তেল এবং বিদ্যুতের ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এর সবকিছই জনমানসে পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে বিক্ষোভে পরিণত করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বছরে ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যায় করছে। আমেরিকা প্রবাসী কিউবানরা যাদের বেশিরভাগ মায়ামিতে থাকেন, তারা মার্কিন সরকারের সহায়তায় নানাভাবে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয়। পাশাপাশি ক্যাস্ত্রোকে বহুবার হত্যা প্রচেষ্টাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে চেষ্টা করে এসেছে ঘরের পাশ থেকে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করবার।

এখন প্রশ্ন হল ভারত, আমেরিকাসহ পশ্চিমা নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু কোনো সময়েই এতে কেউ আশঙ্কা করে নাই যে, এতে তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বসে পড়বে। এর বিপরীতে কিউবা, গণচীনসহ সমাজতান্ত্রিক দাবিদার দেশগুলিতে বিক্ষোভ দেখা দিলে, তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বসে পড়বার আশঙ্কা তৈরি হয় কেন?

এর মূল কারণ হল, সমাজতান্ত্রিক দাবিদার দেশগুলি বহুমত এবং পথকে ধারণ করবার মত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। কার্ল মার্কসের "সর্বহারার একনায়কত্বের" ধারণাকে ভিত্তি করে এসব দেশ গড়ে তুলেছে একদলীয় শাসন। কিন্তু মানুষ কখনো একই মত এবং পথের অনুসারী হয় না। কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি ভিন্নমতকে প্রকাশ করতে না দেয়, মানুষ সেখানে বিদ্রোহ করবেই।

অনেক তাত্ত্বিকই মনে করেন মার্কসের একনায়কত্বের বক্তব্যটি শুধু প্যারি কমিউনের বিশেষ প্রেক্ষাপটেই প্রযোজ্য। সার্বিকভাবে মার্কস কখনো একনায়কত্বের পক্ষে ছিলেন না, বরং সবাই যাতে মুক্ত ভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, এমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলবার পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। প্যারি কমিউনের ক্ষেত্রেও তিনি সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণির একনায়কত্বের কথা বলেছেন, কোনো দল বা ব্যক্তির একনায়কত্বের কথা বলেননি। শ্রেণির এবং দলের একনায়কত্ব এক বিষয় নয়। কমিউনিস্ট পার্টিসহ দুনিয়ার কোনো দলই শুধু একটি শ্রেণি থেকে আগত লোকজন নিয়ে গড়ে ওঠে না।

বাস্তব ক্ষেত্রে সামজতান্ত্রিক দাবিদার দেশগুলিতে সর্বহারা শ্রেণির প্রতিনিধিত্বের দাবি করে প্রথমে দল এবং পরে ব্যক্তির একনায়কত্ব কায়েম হয়েছিল। কিউবাও এর ব্যতিক্রম নয়। ক্যাস্ত্রো এবং গুয়েভারার নেতৃত্বে যখন গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে একনায়ক ফ্যাসিস্ট, বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করা হয়, তখন তারা কেউ কমিউনিস্ট ছিলেন না।

এ গেরিলাযুদ্ধের সময় কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি তাদেরকে সমর্থন করেনি। হাভানা নিয়ন্ত্রণে আসার পর ক্যাস্ত্রো আমেরিকার সমর্থন চান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। কিন্তু মার্কিন মিত্র বাতিস্তার উৎখাতকে আমেরিকা ভালো চোখে দেখেনি। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্যাস্ত্রো সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। এতে বাধ্য হয়ে তিনি সোভিয়েত সমর্থন চান। সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্যাস্ত্রোকে সমর্থন করে কিন্তু একই সাথে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে একীভূত হবার কথা বলে। সোভিয়েত দেখানো পথে তিনি শুধু পার্টির সাথেই একীভূত হননি ক্রমান্বয়ে সোভিয়েত নেতাদের মত একনায়কেও পরিণত হয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হলো ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার কি কোনো উন্নয়ন হয়নি? কমিউনিস্ট শাসনে কিউবাতে মানব উন্নয়ন, বিশেষতঃ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নশীল দুনিয়ার রোল মডেলে কিউবা পরিণত হয়েছে ক্যাস্ত্রোর হাত ধরেই। কিন্তু একইসাথে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, একনায়ক এবং রাজতান্ত্রিক শাসকদের হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্যসহ আরো কিছু দেশে ব্যাপক অবকাঠামগত এবং মানব উন্নয়ন ঘটেছে। তবে যেটা ঘটেনি সেটা হলো, অবাধ বাক এবং ব্যক্তি স্বধীনতার নিশ্চিতকরণ– যে স্বপ্নটা মার্কস দেখেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীতে বসে।

বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সবার অবাধ বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো বিনির্মাণের মার্কস কল্পিত পথে না হেঁটে বিপ্লব পরবর্তী কিউবা হেঁটেছে কমবেশি বাতিস্তাসহ অন্য স্বৈরশাসকদের দেখান পথে। ফলে সেখানে বিরোধী মত এবং পথের অনুসারীদের শিকার হতে হয় নানা দমন-পীড়নের।

এ কারণে এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপ্লব পরবর্তী কিউবা থেকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ নৌকাযোগে দেশ ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছে ৯০ মাইল দূরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এ কিউবানরা আজকে ফ্লোরিডার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তাদের সমর্থন ছাড়া কোনো দলের পক্ষে সেখানে নির্বাচনে জিতে আসা কঠিন। আমেরিকাতে বসে মার্কিন সমর্থনে প্রতিনিয়ত তারা চেষ্টা করে আসছে, কিউবার বর্তমান শাসনব্যবস্থার অবসানের।

দেখা গেছে, যেসমস্ত রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে তার কোনোটিতেই অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ, সামরিক অভ্যুত্থান বা বহিস্থ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যায়নি। ফলে, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের যে সমস্ত রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, সেখানে গণবিক্ষোভের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন যেমন ঘটেনি, তেমনি ক্যু বা বহিস্থ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেও সরকার পরিবর্তন হয়নি।

ইতালির মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনি গ্রামসির মতে একটি রাষ্ট্র কাঠামোয় একটি মত যখন হেজিমনিক বা প্রাধান্যশীল হয়ে ওঠে তখন তার বিপরীতে আরেকটি মতের জন্ম হয়, সে মতটিকে চ্যালেঞ্জ করে। একে তিনি কাউন্টার হেজেমনি বলেছেন। বস্তুত এর মধ্যে দিয়েই সমাজের বিকাশ সাধিত হয়। এখন যে রাষ্ট্রকাঠামো গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে এ বিপরীত মতকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে ধারণ করতে পারে না, সেটি এক সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। রুশ বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে ১৯৪৫ সালে জর্জ ওরওয়েল লিখেছিলেন রাজনৈতিক স্যাটায়ারধর্মী উপন্যাস Animal Farm। তিনি সেখানে সোভিয়েত ব্যবস্থায় মানুষকে খোঁয়াড়ের পশুতে রূপান্তরের সাথে তুলনা করেছেন।

বস্তুত পশুর সাথে মানুষের পার্থক্যের জায়গাটা এখানেই। তাকে যত উন্নত জীবনের নিশ্চয়তাই দেওয়া হোক না কেন, মানুষ কোনো খামার বা বন্দিশালায় বাস করতে চায় না। আবার সব মানুষ একই ভাবে ভাবতে বা চিন্তা করতেও চায় না। মানুষের চিন্তাভাবনার মাঝে রয়েছে বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতা। দেখা গেছে যে রাষ্ট্র যত বেশি চিন্তার বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতাকে ধারণ করতে পারে, সে রাষ্ট্র তত বেশি শক্তিশালী।

কিউবার বর্তমান বিক্ষোভে হয়তো রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে না। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দাবিদার রাষ্ট্রগুলি যদি ভিন্নমত এবং চিন্তার বৈচিত্র্য প্রকাশের পথ তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধারণের পথ উন্মুক্ত করতে না পারে, তাহলে আজ হোক আর কাল হোক কিউবাসহ, গণচীন, ভিয়েতনাম এ সমস্ত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।