মুক্তিযুদ্ধের দায় ও ছাত্রলীগের ভূমিকা

কামরুল হাসান বাদলকামরুল হাসান বাদল
Published : 8 April 2021, 05:49 PM
Updated : 8 April 2021, 05:49 PM

এক

একটি মূল্যবান প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। পাকিস্তানিরা কি আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল না কি যুদ্ধ আমাদের জন্য অনিবার্য ছিল? ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে পাকিস্তানি জান্তা ঢাকাসহ দেশের বহুস্থানে গণহত্যা শুরু করেছিল ফলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। সে কালরাতে পাকিস্তানিরা যদি গণহত্যা না চালাতো, তার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যদি দাবি মেনে নিয়ে, বঙ্গবন্ধু এবং তার দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিতো তাহলেও কি আমরা একটি যুদ্ধকে পাশ কাটাতে পারতাম?

ধরে নিলাম একাত্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়া হলো, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন- তাতে কি আজকের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতো? অখণ্ড পাকিস্তানকে কি বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের মতো একটি স্বাধীন দেশ নির্মাণ করতে পারতেন? যে লক্ষ্য, আদর্শ, স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন সেভাবে কি পাকিস্তানকে গড়তে পারতেন? পাকিস্তান নামক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটির মৌলিক নীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কি ধারণ করতে পারতেন?  তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ এবং বিশেষ করে ক্ষমতালোভী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কি তেমন কিছু বাস্তবায়ন করতে দিতো? ইতিহাস বলে তেমন সামান্য ইঙ্গিত পেলেই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিতো। বঙ্গবন্ধুকে আবার কারাবরণ করতে হতো এবং পরে কখনও মুক্তি পেয়ে রাজপথে এসে আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হতো। এবং শেষমেশ লড়াই বা যুদ্ধ করেই পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে আমাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে হতো। অর্থাৎ একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য অনিবার্য ছিল।

দুই

আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ২০০৯ সালে। এই শতাব্দীর প্রথম বছরে যে সন্তানটি জন্ম নিয়েছিল আজ তার বয়স একুশ বছর। এই সন্তানটি যখন থেকে এক-আধটুু বুঝতে-শুনতে শিখেছে তখন থেকে দেখছে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের দৌর্দণ্ড প্রতাপ। বেতার-টিভি থেকে শুরু করে সর্বত্র মানুষ শুনছে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'- গগণবিদারী স্লোগান। পথে-প্রান্তরে, অলিতে-গলিতে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতির পিতা ও শেখ হাসিনার ছবি। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য।

সবখানে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অপ্রতিরোধ্য জয়জয়কার। সে সন্তান কিংবা তার কাছাকাছি বয়সের সন্তানরা বর্তমানের এমন দৃশ্য বা পরিস্থিতি দেখে কল্পনাও করতে পারবে না এ প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ-ছা্ত্রলীগকে এ পর্যন্ত আসতে কতটা রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।  কত প্রাণ উৎসর্গিত হয়েছে, কত মায়ের বুক খালি হয়েছে।  সে সন্তান হয়ত জানেই না, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন করা দেশে, হাজার হাজার ছাত্রলীগকর্মীর রক্তের ওপর ভেসে আসা স্বদেশে দীর্ঘ সময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করা যায়নি, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যায়নি, 'জয় বাংলা' বলা যায়নি। রাজাকারকে রাজাকার বলা যায়নি। অথচ বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগ না হলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। পূর্বেই বলেছি,  মুক্তিযুদ্ধ না হলে বাংলাদেশ হতো না।

বাংলাদেশের সে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হবে, অথচ সেখানে ছাত্রলীগের নাম বলা হবে না তা কী করে হয়! বাংলাদেশের নামের সঙ্গেই তো জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম। কারণ ছাত্রলীগের জন্ম না হলে হয়ত আওয়ামী লীগেরও জন্ম হতো না। আওয়ামী লীগের জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না। ১৯৪৭ সালে

দেশভাগের পর নিজ দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করলেন তা হলো, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানি শাসকদের বিরোধিতার লক্ষ্যে ছাত্র সংগঠনটির জন্ম দিয়েছিলেন। এটিই পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল। এর পরের বছর  অর্থাৎ ১৯৪৯ সালেের ২৩ জুন জন্ম নেয় আওয়ামী মুসলিম লীগ।  এই দলের জন্মের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয় পরাজয় বরণ করে যুক্তফ্রন্টের কাছে যেখানে এই দলের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু  ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর তা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে এবং তার সঙ্গে ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রলীগ তৎকালীন পুরো পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে রূপলাভ করে। সত্তরের নির্বাচনের পর থেকে ২৫ মার্চের মধ্যরাত পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আর সে বঙ্গবন্ধুর অতন্দ্র প্রহরী ও অনুগতবাহিনীর মতো কাজ করেছে ছাত্রলীগ। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও নবজাগরণের যে উন্মেষ ঘটেছিল তা অত্যন্ত দক্ষতা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে কাজে লাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে এই আবেগ ও চেতনাকে তিনি একাকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে বাঙালির মনে স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল আর বঙ্গবন্ধু হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো গোটা জাতিকে মুক্তির যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার পরিবেশ ও বাস্তবতা তৈরি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন যুদ্ধ ছাড়া  বাঙালির কাঙ্ক্ষিত মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। এ বাসনা ও প্রস্তুতি তার ছিল। যে কারণে ছাত্রলীগের বাছাই করা কর্মীদের দিয়ে ১৯৬২ সালেই তিনি 'নিউক্লিয়াস' গঠন করেছিলেন। একটি কথা বলে রাখা দরকার, বাষট্টি সালের শিক্ষা আন্দোলনে আইয়ুব বিরোধী বলিষ্ঠ ভূমিকাটি পালন করেছিল ছাত্রলীগই।

এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধ।  আর সে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। যুদ্ধের প্রথমদিকে অন্যান্য দলের কর্মীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছে। এদের সবাই আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন নয়। এরা দেশকে ভালোবেসে, দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন জুন মাস থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে আলাদা বাহিনী গঠন করা হয় বাংলাদেশ লিবারেশন ফাইটার্স বা বিএলএফ নামে। তবে এরা 'মুজিব বাহিনী' নামেই সমধিক পরিচিত ছিল। ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেমন কমিউনিস্ট পার্টি,  ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কোপন্থি) অনেক নেতা-কর্মী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। চীনপন্থী রাজনৈতিক দলের অবস্থান স্পষ্ট ছিল না। যদিও ন্যাপপ্রধান মাওলানা ভাসানীকে ভারতে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছিল।  চীনপন্থিদের ভারতবিরোধী রাজনীতির কারণ সে দলের সামান্য কয়েকজনই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগে অনৈক্য,  বিভক্তি, আদর্শচ্যুতি ঘটে। একদল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধোয়া তুলে গঠন করে জাসদ। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই  ছাত্রলীগে মূলত দুটো ধারা ছিল। একটি ছিল 'অতিক্রিয়াশীল',  যাদের একটি অংশ পরে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে সংপৃক্ত হয়ে যায়। এদের আমি 'অতিক্রিয়াশীল' বলেছি কারণ সবক্ষেত্রে এরা বাড়াবাড়ি করতে পছন্দ করত। বঙ্গবন্ধু 'গণতন্ত্রে'র কথা বললে এরা 'সমাজতন্ত্রে'র কথা বলতো আবার বঙ্গবন্ধু 'সমাজতন্ত্রে'র কথা বললে এরা 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে'র কথা বলতো। যদিও বিশ্বে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' বলতে আজও কিছু নেই। স্বাধীনতার পরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন এবং দেশের মানুষকেও দেশগড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান সে কঠিন সময়ে জাসদের নামে ছাত্রলীগের 'অতিক্রিয়াশীল' অংশটি দেশজুড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল যেমন, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী,  মুসলিম লীগ ইত্যাদি অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় সে আদর্শের লোকেরা দলে দলে জাসদের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। সেসময় জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মধ্যপ্রাচ্যসহ ইংল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাতো, অর্থ সংগ্রহ করতো।  সে অর্থের বিশাল একটি অংশ জাসদের সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা হতো। জাসদের সভা-সমাবেশগুলো সফল করতো একাত্তরের পরাজিত শক্তির রাজনৈতিককর্মীরা। সে সময় জাসদ 'গণবাহিনী' নামে একটি সশস্ত্র গুপ্ত সংগঠন গড়ে তোলে যাদের হাতে সে সময় কয়েকহাজার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছিল।

স্বাধীন দেশে ছাত্রলীগ নেতা হত্যার প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের টিভি রুমের সামনে ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল। হত্যার নায়ক ছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান। পরে বিচারে শফিউল আলম প্রধানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তার সাজা মওকুফ করে রাজনীতিতে আবার পুনর্বাসিত করেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শফিউল আলম প্রধান আমৃত্যু জিয়াপরিবারের রাজনীতিকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। শফিউল আলম প্রধান ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা জমিরউদ্দীন প্রধানের পুত্র।  

ছাত্রলীগে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের অনুপ্রবেশ আজকে নতুন নয়। মুসলিম লীগ পরিবারের সন্তান ছাত্রলীগের মতো সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হওয়া নিয়ে তখনও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে প্রধানকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু সরকারের নিন্দা জানিয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ড দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। ছাত্রলীগ ভেঙে 'জাসদ ছাত্রলীগ' গঠন এবং নিজ সংগঠনের কর্মীর হাতে ছাত্রলীগ কর্মী হত্যার ঘটনায় সারাদেশে ছাত্রলীগ সমালোচিত হতে থাকে।

মহসিন হলের হত্যাকাণ্ডের পর আজ পর্যন্ত ছাত্রলীগ-যুবলীগের যত নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ দিয়েছে, যুদ্ধ ছাড়া প্রতিপক্ষের হাতে এত মানুষ নিহত হওয়ার নজির আর কোথাও নেই। স্বাধীনতার পরপরই গণবাহিনীর হাতে আর জাতির পিতাকে হত্যার পর জামায়াত-শিবিরসহ মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে মারা পড়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা। একাত্তরের আগে পাকিস্তানিদের প্রধান আক্রমণের শিকার ছিল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ। আর স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোদী ও মৌলবাদী শক্তির প্রথম আক্রমণের শিকার এই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগই। দেশের যত সাম্প্রদায়িক দল আছে, যত মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠন আছে এখনও তাদের প্রধান টার্গেট আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। 

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তত চব্বিশবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।  হেফাজতের সঙ্গে দল ও সরকারের সম্পর্ক নিয়ে যত কথাই বলা হোক, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে নতজানু নীতির যত অভিযোগই আনা হোক, ধর্মাশ্রয়ী দলগুলোকে তোয়াজ করে চলার যত অভিযোগই আনা হোক- এখনও আইএস, হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরীর, জেএমবির মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রথম ও প্রধান আক্রমণের শিকার আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো। আর যতদিন ওই অপশক্তির আক্রমণের লক্ষবস্তু হবে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন ততদিন বাংলাদেশের মুক্তকামী মানুষের ঠিকানা হবে আওয়ামী লীগ,  ভরসা হবে আওয়ামী লীগ।

আগেও যেমন ছাত্রলীগে শফিউল আলম প্রধানরা অনুপ্রবেশ করে সংগঠনের ক্ষতি করেছে। বর্তমানেও তেমনি অনুপ্রবেশ বন্ধ নেই। সংগঠনে মননশীলতার চর্চা না থাকায়, সংগঠন সঠিক নেতৃত্বে না চলায়, টাকার বিনিময়ে পদ-পদবি বিক্রি হওয়ায়, নিবেদিত কর্মীদের মূল্যায়ন না হওয়ায়, গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায়, রাজনৈতিক শিক্ষাক্রম না থাকায় সংগঠনটি ইমেজ সংকটে ভুগছে। সংগঠনে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা লোপ পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংগঠনটির বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত অপপ্রচার ও প্রপাগান্ডা। যে কেউ সংগঠনে ঢুকতে পারার সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়েছে জামায়াত-শিবির-হেফাজতের সমর্থকরা। ফলে টাইমলাইনে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি রেখে ফেসবুকে এরা সরব থাকে ধর্মান্ধদলের বক্তব্য প্রচারে।

এরা ছাত্রলীগ করলেও দল বা জাতির পিতার আদর্শ কী তা জানে না। এদের কাছে আওয়ামী লীগ আর যেকোনো রাজনৈতিক দলই সমান। কাল ক্ষমতা হারালে এরা রাতারাতি দলও পাল্টে ফেলবে। এদের অনেকের কাছে সাঈদী, আজহারী, মামুনুল অনেক শ্রদ্ধার পাত্র।

তবে অনেকদিন পর ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীরা সক্রিয় হয়েছে। হেফাজতের বিরুদ্ধে তারা রাজপথে নেমেছে। ঘটনাটি আওয়ামী রাজনীতির জন্য ইতিবাচক। যে যাই বলুক, সুশীলশ্রেণি যতই সমালোচনা করুক রাজপথ দখলে রাখা এবং প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার এই প্রচেষ্টার প্রশংসাই করতে হবে কারণ স্বাধীনতা রক্ষা ও জাতির পিতার আদর্শ রক্ষার দায়িত্ব তো এ দলকেই নিতে হবে।  বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন আওয়ামী রাজনীতি করা যায়নি দেশে, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যায়নি তখন এই ছাত্রলীগ, যুবলীগই শত প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম স্মরণীয় করে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান 'জয় বাংলা'কে আগলে রেখেছে যা অন্য কোনো দল করেনি। ছাত্রলীগ, যুবলীগকে রাজপথে নামতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজপথেই মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ছাত্রলীগের ইতিহাস লড়াই – সংগ্রামের ইতিহাস সে কাজটিই তাদের সর্বাগ্রে করতে হবে।

আজ হেফাজতের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।  একজন মামনুলকে রক্ষা করতে এরা ধর্মকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করছে।  একের পর এক মিথ্যার বেসাতি করে যাচ্ছে। এরা আজ রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে।  সংবিধান পরিপন্থী কাজ করছে। এরা রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করছে। সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছে। এরা বাংলাদেশকেই অস্বীকার করছে।  এরা ধরাকে এখন সরা জ্ঞান করছে। এই দেশটি একটি আদর্শ, লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ অংশ নিয়েছিল, রাষ্ট্রটি একটি সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে তা হেফাজত ও কিছু ধর্মাশ্রয়ী দলের বক্তৃতা-বিবৃতি-কার্যকলাপে বোঝার উপায় নেই।

এ অপশক্তিকে শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ অপশক্তিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এ মোকাবেলা করার শক্তি আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সহযোগী সংগঠন ছাড়া অন্য দলের নেই। থাকলেও তারা করবে না কারণ রাজনৈতিক আদর্শের দিক দিয়ে তাদের সঙ্গে জামায়াত-হেফাজতের পার্থক্য নেই। সোজাসাপ্টা কথাটি হলো এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন কাজেই একে রক্ষার দায়িত্বও এই দলের কর্মীদের নিতে হবে। জাতির পিতার হাতে গড়া ছাত্রলীগকেই  সবার আগে এই দায়িত্ব নিতে হবে। আবারও স্মরণ করিয়ে দিই এ দেশের যত অর্জন, গৌরব ও অহংকার তার সবটুকুই অর্জিত হয়েছে এই দলের নেতৃত্বেই।

পরিশেষে জাতির পিতার অবিস্মরণীয় বক্তৃতার একটি বাক্য ধার করে নিজের মতো করে বলি- "বাংলার ইতিহাস ছাত্রলীগের কর্মীদের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।" তা ভুলে গেলে চলবে না।