অ-চিন রাজনীতি, পথের শেষ কোথায়?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 10 Sept 2020, 02:41 PM
Updated : 10 Sept 2020, 02:41 PM

চীন নিয়ে একটা চিনচিনে ব্যথা আমাদের জেনারেশানের আছে এবং থাকবে। কারণ আমরা একাত্তর দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পার করেছি আমাদের বালক বেলা। বলতে গেলে তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে। সে সময়কার কথা আমরা ভুলব কী করে? শহর থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। সে সময় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সবাই একদিকে হলেও রাজার দালালদের জ্বালায় জীবন বাঁচাতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে বাধ্য হতো। কী করে জানি রটে গিয়েছিল বৌদ্ধরা একটু বেশি নিরাপদ। বিশেষত তারা যদি হয় চায়নিজ বুদ্ধিস্ট। কি অদ্ভুত কাণ্ড! শান্তির প্রতীক বুদ্ধের অনুসারীদেরও ভাগ করা হয়েছিল। একদিকে নাকি ইন্ডিয়ান আরেকদিকে চাইনিজ বুদ্ধিস্ট। আমি চোখে দেখেছি জান বাঁচানোর জন্য গ্রামে ঢোকার জায়গা জুড়ে বাংলা, ইংরেজি, উর্দুতে লেখা এমন ব্যানার উড়ত। রাজাকারের বাচ্চারা এগুলো পড়ে পাক মিলিটারিকে বোঝাত উধার চাইনিজ হ্যায়। এই জাতীয় ঘটনা বলে দেয় চীনের ভূমিকা কী ছিল সে সময়।

একেবারে শুরুর দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত চীন তার এই নীতি থেকে সরে আসেনি। এমন একটা ঘটনাও নাই যেখানে দেখানো যাবে চীন পাকিস্তানি বর্বরতার নিন্দা কিংবা বিরোধিতা করেছিল। তাদের কারণে জাতিসংঘে কতবার বিপদে পড়েছি আমরা। আজকের বাংলাদেশকে দেখে কি সেদিনের কথা ভাবা যাবে? জাতিসংঘে তখন দুই প্রধান শক্তি আমেরিকা আর চীন আমাদের বিরুদ্ধে। আমেরিকার সাথে চীনের তফাৎ ছিল, আমেরিকা যেহেতু গণতান্ত্রিক দেশ তার সরকার আমাদের বিরোধীতা করলেও জনগণ ছিল আমাদের পাশে। সে দেশে একের পর এক কনসার্ট আর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। জর্জ হ্যারিসন, রবিশংকর যেমনি তেমনি আমরা মনে রাখব সিনেটর কেনেডির কথা। তিনি আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছিলেন শরণার্থীদের দেখতে। অথচ না চীন সরকার না তাদের জনগণ কারো কোনো সমর্থন পাইনি আমরা। জাতিসংঘে সে সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো পাওয়ার না থাকলে কি হতো ভাবাও মুশকিল।

সবচেয়ে বড় কথা স্বাধীনতার পরও আমরা চৈনিকপন্থী নামে পরিচিত বামদের আস্ফালন দেখেছি। যারা প্রকাশ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলত। আপনি ইতিহাস জানলে বা না জানলেও জেনে নিতে পারেন বঙ্গবন্ধুর আমলে যত নাশকতা আর আত্মঘাতী কাজ তার পেছনে ছিল এদের মদদ। আর সবকিছু বাদ দিলেও শুধু এটাই জানেন চীন বঙ্গবন্ধু নিহত হবার আগে আমাদের স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি। সে চীন এখন আমাদের পরম মিত্র হতে পারে?

এ কথা আমরা সবাই মানি রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নাই। সময়ে অনেক কিছু বদলে যায়। যেমন ইসরায়েলের সাথে মিশরের বন্ধুত্ব। যেমন আরব আমিরাতের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক। কিন্তু তার মানে কি এই যে ফিলিস্তান বিষয়ে মুসলিম দেশগুলো ইসরায়েলকে সমর্থন করে? না করবে? সে যাই হোক আজকাল দেখছি চীন নিয়ে বেশ মাতামাতি হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রথিতযশা কয়েকজন বন্ধু ও অগ্রজের লেখাও চোখে পড়ল। সম্প্রতি করোনাভাইরাস আক্রান্ত বিশ্বে রাজনীতি মোড় নিচ্ছে অন্যদিকে। বলাবাহুল্য সে ঘটনায় ভারতও জড়িয়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু ও অভিভাবকের সম্পর্ক পালন করা এই দেশের নেতা ইন্দিরা গান্ধী না থাকলে আমরা কবে স্বাধীনতা পেতাম বলা যায় না। যেমন বলা যায় না তাদের সৈন্য ও দেশ যুদ্ধে জড়িত না হলে কী বা কেমন হতো ভবিষ্যত। সে দেশের সাথে মাঝে মাঝে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। মাঝে মাঝে তাদের বড় ভাইসুলভ খবরদারি আর দাদাগিরি আমাদের মন বিষিয়ে তোলে। এটা ভারতের সাথে তাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে প্রায়ই ঘটে। শ্রীলংকা রাগ করে চীনের কাছে যাবার পর তার মাশুল হিসেবে বেশ কয়েকটা সমুদ্র বন্দরের মালিকানা হারানোর পথে। সে কারণেই হয়তো করোনাভাইরাস কালে হয়ে যাওয়া নির্বাচনে জয়ী ভারতবিরোধী নামে পরিচিত নেতাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল বাক্য হলো, ইন্ডিয়া ফার্স্ট। নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক চলছে মন্দ মধুর। জায়গা নিয়ে বিরোধ, স্থল চৌকি নিয়ে বিরোধ। সেই নেপালও আবার ফিরে এসেছে তার পুরনো বলয়ে। কারণ?

কারণ পরিষ্কার। এবারের করোনাভাইরাস দুনিয়াকে আবার নতুন মেরুকরণের মুখোমুখি করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের শুরু চীন থেকে। তারপর তাদের লুকোছাপা আর নানাবিধ ঘটনায় আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া সবাই চীনের বিরুদ্ধে। বলা যেতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানাভাবে চীনকে একঘরে করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। বলাবাহুল্য সে কারণে তারা আমাদের এলাকায় ভারতকে বেছে নিয়েছে বিকল্প হিসেবে। খেয়াল করবেন হঠাৎ করেই ভারত-চীন সংঘর্ষ আর যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। এমন কিছু হয়নি যে লড়াইটা জরুরি। আসলে সমস্যা এক জায়গায় আর তার প্রভাব পড়ছে সীমান্তে। চীন যে এখন এই অঞলে বন্ধু খুঁজবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা আমাদের দেশের ভরসা ও দূরদর্শী নেতা শেখ হাসিনাকে ভুল বোঝাচ্ছেন সমস্যা তাদের নিয়ে। না জেনেও অনুমান করতে পারি এদের কারণেই মাঝখানে হঠাৎ ইমরান খানের ফোনালাপ। যে আলাপের পর জন্ম নিয়েছে ব্যাপক কৌতুহল আর প্রশ্নের পাহাড়। এর পরপরই আনন্দবাজার পত্রিকার কলামগুলো পড়ে আমার অন্তত ভালো লাগেনি। তারা খোলামেলা সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় বইয়ে প্রশ্ন করেছে আন্তরিকতা আর বন্ধুত্ব আসলে কতটা খাঁটি?

আমি ভারতের দিকে বা তাদের হয়ে কথা বলতে নারাজ। তারাও বেনিয়া। তাদের স্বার্থ তারা আদায় করবেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা দেশের ভেতরে-বাইরে কি কারণে অস্থিরতা আর সমস্যা টেনে আনছি? চীন যদি নানা কারণে বন্ধু হয়ও আমরা কি পাকিস্তানকে বিশ্বাস করতে পারি? আমরা কি ভুলে যাচ্ছি এই ইমরান খান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিয়ে কি বলেছিলেন, কী কী করেছিলেন? সব প্রটকল আর নিয়ম ভেঙ্গে ইমরান খান মিছিল করানো থেকে পার্লামেন্টে আমাদের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবসহ বিতর্ক তুলেছিলেন। নিয়াজীর ভাইপো ইমরান খান আমাদের কতটা বন্ধু বিশেষত শেখ হাসিনার কতটা মিত্র সে প্রশ্ন থাকবেই। তাই মনে রাখা দরকার আমাদের বন্ধুহীন করার চক্রান্ত কিন্তু পঁচাত্তরের সাথে মিলে যাচ্ছে।

শেষ করব সম্প্রতি চীনের অসন্তোষ জানানোর কথা দিয়ে। আপনারা সবাই জানেন এক সময় বাংলাদেশ থেকে যে ক'টি দেশে যাওয়া যেত না তার একটি ছিল তাইওয়ান। আমাদের সাথে সাতে-পাঁচে না থাকা এই আগুয়ান ছোট দেশটিতে না যেতে দেওয়ার কারণ ছিল চীন। চীন যেমন হংকংকে নিয়ে নিয়েছে তার আগে তিব্বত তার সাথে তাইওয়ানকেও। এদেশকে তার অঙ্গ বললেও তাইওয়ানের আছে নিজেদের সরকার ও পাসপোর্ট। এখন প্রচুর বাংলাদেশি সে দেশে কাজ করেন। এই ছোট দেশটি আমাদের করোনাভাইরাস আক্রান্তদের জন্য মাস্ক দেয়ার ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে চীন। তাদের এই দুঃখকে সম্বোধন করে আমাদের মন্ত্রী বিনয় ও লজ্জায় মারা যাচ্ছেন। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহস নাই প্রশ্ন করার আপনারা ১৫ অগাস্ট জাতীয় শোক দিবসে কীভাবে খালেদা জিয়াকে জন্মদিনের কেক পাঠালেন এবার? কীভাবে আমাদের দেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিতাড়নে সমর্থন দিলেন? এই বিষয়ে একটি কথাও বলেন না কেন আপনারা?

এই আমাদের সমস্যা। সবার সাথে মিত্রতা কারো সাথে বৈরিতা না এই নীতির নামে আমরা প্রায়ই বন্ধুকে দুশমন বানিয়ে ফেলি আর দুশমনকে সুযোগ দেই বন্ধু হয়ে ছিদ্র তৈরি করার। চীন একটি বড় দেশ। শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। তবে সে শুধু দেয় আর রপ্তানি করে, তার কিছু নিতে হয় না সহজে। আর এমন দেশের সাথে যে সব কৌশল মাথায় রেখে এগোতে হব সেটা করার মতো কিছু কি করছি আমরা?

শেখ হাসিনার পথ সুগম ও নিরাপদ করতে বিষয়গুলো ভাবা জরুরি নয় কি?