বল এখন পাবলিকের কোর্টে

মোহাম্মদ আবদুল হালিমমোহাম্মদ আবদুল হালিম
Published : 4 June 2020, 10:26 AM
Updated : 4 June 2020, 10:26 AM

শুরুর কচকচানি বাদ দিয়ে কথা সরাসরি পেড়ে ফেলাই ভালো। শ্রম, সময়–দুইই বাঁচে। বিষয়টা হলো এই যে 'সাধারণ ছুটি' উঠে গেল, সেটা। এ নিয়ে বিস্তর কথা হয়েছে। যা বলা হচ্ছে, এক দল বলে ছুটি দরকার নেই, উঠিয়ে দাও। আরেক দল বলে থাকুক আর ক'টা দিন, তাহলে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।

ভাবলাম আমিও একটু বলি (পড়ুন লিখি), একটু হাওয়া দেওয়া আর কি!

এখন আবারও কথা। আবারও এই দুই দলই। প্রথম দলটি বলছে, ঠিক হয়েছে। ও দলের এক কথা- ঠিক হলো না। সরকার ভুল করল।

সরকার বাহাদুরের দোষই বা দি-ই কি করে? (দয়া করে আমাকে সরকারের লোক ভাববেন না, নেতারা কেউ আমাকে চেনে না।) 'পাটা-পুতায় ঘষাঘষি, মরিচের জান শেষ'।

ঝেড়ে কাশি, বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত (৮ মার্চ) হয়। সরকারও শুরু করে কৌশলী পথে হাঁটা। অনেকটা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো 'দেখি না কি করে' অবস্থান আরকি। সম্ভবত সরকারের ইচ্ছা ছিল অন্তত স্বল্প পরিসরে হলেও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনটা সেরে নেওয়ার পর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া। হলোও তাই, ২৬ মার্চ থেকে শুরু হলো 'সাধারণ ছুটি'।

এখানেও কৌশলী সরকার 'লকডাউন'র পথে না গিয়ে বেছে নিল 'সাধারণ ছুটি' শব্দযুগল। কারণটা স্বাভাবিক, লকডাউনের যে ব্যাপকতা সেটা তো অনেক উন্নত অর্থনীতির পক্ষেই সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য। সেখানে বাংলাদেশের মতো 'নাই-নাই, খাই-খাই' এর দেশে সেটা আরও দূরূহ। যদিও অর্থনীতি এগিয়েছে অনেকটা, কিন্তু তারপরও স্থানীয় জনশক্তির একটা বিরাট অংশই তো অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে জড়িত।

সবকিছু 'লকডাউন' করে এই বিপুলসংখ্যক মুখের খাবার জোগানো তো চাট্টিখানি কথা নয়। সরকার অবশ্য সীমিত সক্ষমতা নিয়ে শুরু করেছিল, কিন্তু ওই যে চাটার দল, তারা আবার যথারীতি হাজির বিরাট হা নিয়ে। কেউ পায় তো কেউ পায় না, কেউ খায় তো কেউ খায় না–হৈ হৈ কাণ্ড অবস্থা। গুদামে, বাসা-বাড়িতে, খাটের তলায় চাল-তেল। তারপরও চলছে সরকারের চেষ্টা।

বলা হলো- সবাই ঘরে থাকুন। পুলিশ-আর্মিও নামল নির্দেশ তামিল করতে। আমরাও কোমর বেঁধে নেমে দোকানপাট ঝেঁড়ে-পুছে নিয়ে ঘরে সেঁধোলাম। মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ডেটল, স্যাভলন, চাল-ডাল, তেল, আলু, মাছ-মাংস, তরিতরকারি–একেবারে ঘর বোঝাই। ভাবখানা এমন, লম্বা সময়ের জন্য আত্মগোপনে যেতে হচ্ছে।

কিছুদিন কাটলো খুব সতর্কতায়, তারপর শুরু হলো উসখুস–কাঁহাতক ঘরে খেয়েদেয়ে, শুয়েবসে, গড়াগড়ি করে কাটানো যায়। গলির মুখে একটু আড্ডা না দিলে পেটের ভেতরে ভাত 'চাল চাল' মনে হচ্ছে। ব্যাস, বেরিয়ে পড়। ফাঁকফোকরে চায়ের দোকানে গিয়ে বসা, সিগারেট ফোঁকা চলল। মাঝে মাঝে পুলিশের ধাওয়াও চলে। চোর-পুলিশ খেলা আর কি। উল্টো ভাইরাসের কাছে ধরা খেল পুলিশই। আরও আলগা।

এর মধ্যেই 'খেয়ে, না খেয়ে' থাকা মানুষগুলোর পেট পিঠের সাথে লাগার দশা। গার্মেন্ট মালিকদের 'নাকি কান্না'–'বেতনভাতা দিতে পারছ না, কারখানা খুলে দাও', বাস-ট্রাকের চালক, হেলপাররাও মাঠে। কিসের সমাজিক দূরত্ব, কিসের কি–'গাড়ি চালাতে দাও'। কর্মচারীদের বেতন দিতে হবে, দোকানভাড়া দিতে হবে, ঘরে খাবার নেই–মার্কেট, 'শপিং মল খুলে দাও'। খুলে দাও, খুলে দাও, সব খুলে দাও (দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না)। গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের নিয়ে কি খেলাটাই না খেললেন! ফুটবলের মতো, একবার এদিক, আরেকবার ওদিক।

সরকারের কাছ থেকে সুবিধা ঠিকই নিলেন, কিন্তু ঈদের আগে কেউ কেউ শ্রমিকদের বেতনটাও দিলেন না। দুধ-সেমাই দূরে থাকুক, নোনাজলে ডালভাতে উদোরপূর্তি।

অগত্যা, সরকার মহাশয় 'ধুচ্ছাই' বলে ছুটি-ফুটি উঠিয়ে দিলেন। সাথে বলেও দেয়া হলো- যার যার সুরক্ষা তার তার কাছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে নিজের সাথে অন্যদেরও বিপদ। এই যে এত জড়াজড়ি, গলাগলি করে থাকা, এসব চলবে না। হাতে ফেনা তোলো, 'মুখবন্ধ' ব্যবহার করো।

যতই বলা হোক- ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সক্ষমতা আছে, 'লকডাউন' বলি আর 'সাধারণ ছুটি', উঠিয়ে নিলে আক্রান্ত যখন 'কাতারে কাতারে' বাড়বে তখন সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স জড়ো করেও আর সামাল দেওয়া যাবে না। এটা সবাই জানে। লাভ কি? সরকারকে বলে কোনো লাভ নেই। কথা তো শোনেননি। সব ঢিলে করে দেওয়া হয়েছে। এখন টপাটপ পটল তুললেও কিছু বলতে পারবেন না। কারণ বল আপনার-আমার কোর্টে।

আহা-হা, বল তো আরো আছে কোর্টে। এই দেখুন, সিগারেট নিয়ে বেহুদা একটা কাণ্ড ঘটে গেল। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে ধূমপায়ীদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে উদ্ধৃত করে এই মহামারীকালে দেশে তামাক উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন সাময়িকভাবে বন্ধ করতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে চিঠি দিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে।

শিল্পমন্ত্রী বললেন এই অনুরোধ 'ওষুধের ব্যবস্থাপত্র'র মতো। আর তার মন্ত্রণালয় তামাকশিল্প থেকে বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্বপ্রাপ্তি, বহু চাষি, শ্রমিকের কর্মসংস্থান জড়িত থাকার যুক্তি তুলে ধরে শেষমেষ বলটা পাবলিক, মানে ধূমপায়ীদের কোর্টেই ঠেল দিল।

তাদের ভাষ্য, ধূমপান কিংবা তামাক জাতীয় পণ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও এর সেবনকারীরা তা জেনেশুনেই সেবন করছেন; এ শিল্প সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিলেও, তারা এটি সেবন করবেন বলে মনে করে মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মোটিভেশন ছাড়া উৎপাদন বন্ধ করে ধূমপান প্রতিরোধ করা যাবে না। মানে হলো, নিজের ভালোটা নিজেই বুঝে নাও বাপু। কেন এসব দিগদারি!

লকডাউন (সরকারি ভাষায় সাধারণ ছুটি) উঠে গেল, গণপরিবহন চলছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে সব আগের মতোই, পেটভর্তি করে; সেই গাদাগাদি, ঠেলাঠেলি, ধস্তাধস্তি। কিসের সামাজিক দূরত্ব, কিসের কি। বাঙালি এতই বেশি সামাজিক যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই চলাটাই যে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

বল এখনও পাবলিকের কোর্টেই ঘুরছে। একটা-দুইটা না, আরো আছে। ঘাড়ত্যাড়া ফরোয়ার্ডের মতো পাবলিকও বল নিয়ে কারিকুরি করছে, প্রতিপক্ষের জালে বল আর ফেলা হচ্ছে না।

অন্যদিকে স্কোর কিন্তু বড় হয়েই চলেছে।