কেজরিওয়ালের জয় এবং কিছু প্রশ্ন

গৌতম রায়
Published : 13 Feb 2020, 03:59 PM
Updated : 13 Feb 2020, 03:59 PM

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোটা ভারতবর্ষের মানুষদের ভেতর যে আগ্রহ এবং  উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তেমনটা সাম্প্রতিক ভারতের কোনও বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে আমরা তৈরি হতে দেখিনি। দেশের রাজধানীর বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক তাৎপর্য চিরদিনই বেশি থাকে, কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ফিরে আসবার পর, মহারাষ্ট্র-রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ-ছত্রিশগড়, যে রাজ্যগুলিতে নির্বাচন হয়েছে, সেখানেই শাসক বিজেপির বিজয়রথ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

এরকম একটি পরিস্থিতির ভেতর ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা,  ৩৫ এর এ ধারার অবলুপ্তির পর, দেশের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্ট, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি, কেবল একাংশের রাজনৈতিক হিন্দুদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তথাকথিত 'রামলালা'র জমি হিসেবে নির্ধারিত করে দেওয়ার প্রেক্ষিতে, কেবল  ধর্মীয় মেরুকরণকে সম্বল করে, নাগরিকপঞ্জির নামে, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের নামে, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার যে ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক হিন্দু শিবির করছে, তার প্রেক্ষিতে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনটি ছিল গোটা ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কাছে একটি অগ্নিপরীক্ষা।

এ অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল যেন  বৌদ্ধ দর্শনের 'মজ্ঝমপন্থা' (মধ্যমপন্থার পালি উচ্চারণ) অবলম্বন করে একটা অভাবনীয় সাফল্য নিজের ঘরে তুলেছেন। সেই সাফল্যের ভাগিদার এখন গোটা অ-বিজেপি শিবির নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে নানা ধরনের আত্মতৃপ্তি পেতে চাইছে। মজার কথা হলো ভারতবর্ষে আজ নেহরু ঘরানার কিংবা বামপন্থিদের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রায় অবলুপ্ত। ব্যক্তি জীবনে ধর্মাচরণ করুন, বা না করুন, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে, প্রকাশ্য ধর্মাচরণের প্রশ্নে নেহরুর যে ধর্মনিরপেক্ষ এবং একটা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত অভিশ্রুতিজনিত আঙ্গিক ছিল, যেটি বামপন্থিরা পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরা বা সর্বভারতীয় অন্যান্য প্রেক্ষিতে ভীষণভাবে অনুসরণ করে চলে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অ-বাম রাজনৈতিক শিবির সরে এসে, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে একটা প্রকাশ্য ধর্মাচরণের আচার-আচরণের ভেতর দিয়েই ধর্মান্ধতার, সাম্প্রদায়িকতার, মৌলবাদকে মোকাবিলার রাস্তায় হাঁটতে চাইছে ।

অরবিন্দ কেজরিওয়ালের এই তৃতীয়বারের জয়ের ভেতর দিয়ে সেই বিষয়টি কিন্তু খুব পরিষ্কার হয়ে গেল। নেহরু ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটিবারের জন্য রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিজীবনের ধর্মবিশ্বাসকে, আধ্যাত্মিক চেতনাকে মিলিয়ে দেননি, মিশিয়ে দেননি। ব্যক্তিজীবনে নাস্তিক না হয়েও তিনি কখনোই রাষ্ট্রনায়কের পদে অধিষ্ঠিত থেকে, ধর্ম চর্চার পসরা নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হননি।

এই জায়গাটি তার কন্যা ইন্দিরা যে খুব সুস্পষ্টভাবে মান্যতা দিয়ে চলেছেন- এ কথা বলা যায় না। ব্যক্তি জীবনে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ হলেও একক ক্ষমতা এবং একক আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে, তার দল কংগ্রেসের ভেতর মোরারজি দেশাই, এস নিজলিঙ্গাপ্পা, কে কামরাজ, সঞ্জীব রেড্ডি, এমনকি তার নিজের শিবিরে থাকা অতুল্য ঘোষ প্রমুখ দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক শিবিরের লোকজনদের মোকাবিলা করতে, কখনও কখনও নরম সাম্প্রদায়িকতার পথে হেঁটেছেন।

রাজীব গান্ধীর অপরিণামদর্শী, অবিবেচনাপ্রসূত রাজনৈতিক জীবন, রাষ্ট্রধর্ম আর ধর্মাচরণকে একদম ঘেঁটেঘুঁটে দিয়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনকে একটা বড় ধরনের সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।পরবর্তীতে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে যে উগ্র রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির দাপট, তার মোকাবিলার প্রশ্নে অ-বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি নেহরু ঘরানার ধর্মনিরপেক্ষতার থেকে নরম সাম্প্রদায়িকতাকেই উগ্রতা মোকাবিলার দাওয়াই হিসেবে বেছে নিয়েছে।

আরবিন্দ কেজরিওয়াল তার বিগত ১০ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে যেমন, তেমনি সদ্যসমাপ্ত দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারেও, নরম সাম্প্রদায়িকতার এই রাস্তাতে হেঁটেই আরএসএস- বিজেপির উগ্র, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করেছেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে বিজেপি যখন রাম মন্দিরের তাস খেলে, উগ্র পাকিস্তান বিরোধিতার নাম করে, মুসলমান সম্প্রদায়কে কাঠগড়ায় তোলবার মানসিকতা নিয়ে, দেশপ্রেমের নামে উগ্রতার মিশেল ঘটিয়ে, সামাজিক বিভাজনের একটা ভয়াবহ পথকে নিজেদের রাজনৈতিক সাফল্যের সোপান হিসেবে বেছে নিতে চেয়েছে, তখন কিন্তু আরবিন্দ  কেজরিওয়াল প্রকাশ্যে হনুমান চালিশা পাঠ, ধর্মস্থানে যাওয়া, এমনকি নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তাঁর নাকের ডগায় প্রবাহমান, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের গর্ভভূমি শাহীনবাগে একটিবারের জন্য না যাওয়া- এসবের ভেতর দিয়ে ভোট সমীকরণের রাজনীতিতে, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের মোকাবিলায় এক ধরনের অসাধারণ সাফল্য নিজের ঘরে তুলেছেন।

এ সাফল্য দিয়ে ভোট রাজনীতির নিরিখে সাময়িক যে দিকচিহ্ন কেজরিওয়াল স্থাপন করতে পারলেন, তা নি:সন্দেহে উগ্র রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরকে একটা বাঁধার দেওয়ালের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু সেই  বাঁধার দেওয়ালটি  সিমেন্টের, না  কাদামাটির গাঁথুনি সেটি নির্ধারণের সময় কিন্তু এখনও আসেনি। বাঁধার দেওয়ালটিকে কাদামাটির গাঁথুনি অনুভব করে হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা সেটিকে ধ্বংস করে তাদের উগ্রতার বিজয় বৈজন্তীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে কিনা এই প্রশ্নটির মিমাংসা কিন্তু দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের ভেতর দিয়ে হয়ে যায়নি।

উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলায় নরম সাম্প্রদায়িকতা সামরিক সাফল্য আনতে পারে। কিন্তু সেই সাফল্য সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে তাঁদের উপর রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় নির্যাতন, যা এখন কার্যত তাঁদের ভাতে মারার উপক্রমকে অতিক্রম করে, প্রাণে মারবার জায়গায় এসে উপস্থাপিত হয়েছে, সেই সমস্যার ক্ষেত্রে কতখানি স্বস্তিদায়ক একটি বার্তা বয়ে আনবে- তার গোটা প্রেক্ষিত এখনো পরিষ্কার হচ্ছে না ।

কারণ বিজেপি-আরএসএসের উগ্রতার মোকাবিলায়,  নরম সাম্প্রদায়িকতার যে আঙ্গিক,  যে কৌশলটিকে কেজরিওয়ালের নির্বাচনী সাফল্যের একটি দিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, সেই দিকটা কিন্তু আর যাই হোক, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান নির্দেশিত ভারতের সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণের প্রশ্নে, আদৌ কোনো স্বস্তিদায়ক মীমাংসা সূত্র নয়। নরম সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করতে আরএসএস-  বিজেপি উগ্র  সাম্প্রদায়িকতাকে কোন্  জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে, তার অভিজ্ঞতা কিন্তু আপামর ভারতবাসীর আছে ।

সেই পথে বিজেপি যে হাঁটবে না, তা কিন্তু কোনও অবস্থাতেই নিশ্চিত করে বলতে পারে যায়না। তাই আমাদের ভাবতে হবে- বিভাজনের রাজনীতির,  ধর্মান্ধতার রাজনীতির, পরিবর্ত শক্তি হিসেবে রাহুল গান্ধী বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের প্রকাশ্যে কোনও উপাসনালয়ে গিয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে, সুসজ্জিত হয়ে দেবার্চনা বা ধর্মগ্রন্থ পাঠ আপামর ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু জনগণের কাছে কতখানি আশা-ভরসার বিষয় হতে পারে- সে সম্পর্কে।

ধর্মান্ধ রাজনৈতিক হিন্দু রাজনীতিকরা ভারতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বিচ্ছিন্নভাবে রাম মন্দির, মসজিদ, হিন্দু-মুসলমান, জাতি-ধর্ম, ভাষার বিভাজনকে প্রথম এবং প্রধান প্রতিপাদ্য হিসেবে তুলে ধরে। আর তার মোকাবিলা অসাম্প্রদায়িক শিবির হনুমান চালিশা পাঠ বা শাহীনবাগের মত আন্দোলনের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেও নিজের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অবস্থান-চরিত্র অটুট রাখবে। এই যে কৌশল, তাতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অর্থনীতির মূল প্রশ্নগুলো। অবহেলিত হচ্ছে মানুষের রুটি-রুজিকে ঘিরে সাধারণ দাবি-দাওয়াগুলো।

একবারও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না অস্বাভাবিক বেকারত্বের হারের কথা, ভয়ংকর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা। শিল্পোন্নয়নের প্রশ্নটি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে যাওয়ার বিষয়টিও উপেক্ষিত। ফসলের দাম না পেয়ে ঋণের দায়ে জর্জরিত কৃষকের আত্মহত্যা, বন্ধ কল-কারখানার কথা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো জলের ধারে শাসকের তাঁবেদার শিল্পপতিদের কাছে বেঁচে দেওয়া, রেল বেসরকারিকরণের উদ্যোগ, এলআইসি বেসরকারিকরণের উদ্যোগ, এমনকি ডাক ব্যবস্থাকে পর্যন্ত বেসরকারিকরণের উদ্যোগের বিষয়টি চাপা পড়ে যাচ্ছে।

আপাতভাবে বলতে হয় মানুষকে ধর্মান্ধতার বটিকা সেবন করিয়ে মাতাল করে দেওয়ার যে অভিপ্রায়, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক হিন্দু-সাম্প্রদায়িক শিবির করেছে, সেই কাজে তারা যে আপাত সফল, সেটি খুব পরিষ্কার হয়ে উঠছে অবিজেপি অ-বাম শিবিরের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রশ্নে বা নির্বাচনী সংগ্রামের প্রশ্নে নরম সাম্প্রদায়িকতার পথে হেঁটে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে মোকাবিলার এই স্তরটি থেকে।

অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সাফল্য নিঃসন্দেহে বিজেপি বিরোধিতার ক্ষেত্রে একটি বড় সাফল্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এ প্রশ্নটি উঠে আসে যে, মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরির পথে না হেঁটে সেই ক্ষেত্রের জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করবার প্রয়াস সেভাবে না নিয়ে  ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ মাশুল মওকুব বা সরকারি বাসে মেয়েদের জন্য পয়সা মওকুব- এসব বিষয়গুলো একুশ শতকের প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় সাফল্যের নিরিখে ভারতবর্ষের পঙ্গু অর্থনীতির পুনর্জাগরণকে কোন পর্যায়ে প্রভাবিত করবে?

আলঙ্কারিক উন্নয়ন নির্বাচনী সাফল্য এনে দিতে পারে। সে পথে বামপন্থিরা পশ্চিমবঙ্গে না হেঁটে কতখানি রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিচয় দিয়েছেন এ প্রশ্নও তোলা আজ অসঙ্গত নয়। কিন্তু এর পাশাপাশি এ প্রসঙ্গ উঠে আসে যে, সাম্প্রদায়িকতাকে ভারতবর্ষের সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অঙ্গ হিসেবে যখন আরএসএস ও বিজেপি উপস্থাপন করতে চায় তখন তার মোকাবিলাতে অর্থনৈতিক প্রশ্নে, সামাজিক প্রশ্নে, সাংস্কৃতিক প্রশ্নে, কোনও ধরনের দৃঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী চিন্তাভাবনার পথে না হেঁটে নরম সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যাধি উপশমের একমাত্র উপায় হিসেবে ধরে নেওয়ার ভেতর দিয়ে গোটা দেশকে আমরা কী ধরনের ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি- সেই বিষয়টি।