পান্না কায়সার: আলোয় আলোয় মুক্তির এক জীবন

শত বাধার মাঝে বারবার গেয়েছেন তার মুক্তি আলোয় আলোয়। আলোয় দেখেছেন মুক্তি, দেখিয়েছেন অন্যদেরও। অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন প্রথম জীবনে বাবা ও মায়ের কাছে, পরবর্তী জীবনে শহীদুল্লা কায়সারের মাঝে।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 5 August 2023, 06:43 AM
Updated : 5 August 2023, 06:43 AM

জন্মেছিলেন জমিদার ঘরে। জমিদার বাবা ছিলেন একজন সাক্ষাৎ ঋষি। যিনি জীবনের মানে খুঁজেছেন শিক্ষা, সঙ্গীত আর মানবকল্যাণে। নিজের ধনদৌলত অকাতরে অভাবী নিপীড়িত মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। এমনকি ঘোষণা দিয়ে স্ত্রীর গয়নাগাটি গ্রামের সমবেত দরিদ্র মানুষদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এরকম সহায়সম্পত্তির প্রতি নির্লোভ ক্ষ্যাপাটে মানুষটির এহেন প্রবণতায় তার স্ত্রীর সমর্থন ছিল ঠিক ঠিক।

পান্না কায়সারের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, তাঁর আলোচনা শোনার অভিজ্ঞতা এবং আত্মজৈবনিক রচনা পাঠ থেকে যতটা জেনেছি, ওই সময় তাদের পরিবার এবং এলাকার রেওয়াজ ছিল মেয়েরা কেবল প্রাথমিকের গণ্ডি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারবে। প্রাথমিকের পর বিদ্যালয়ে যাওয়া বারণ। তিনি বাড়িতেই মেয়েদের শিক্ষার বন্দোবস্ত করেছেন। স্কুলের শিক্ষকগণ জমিদার বাড়িতে এসে জমিদার কন্যাদের পড়িয়ে যেতেন। এতেও আত্মীয়স্বজন আর গ্রামবাসীদের রোষ থেকে রেহাই পাননি। তারা মেয়েদের দেখলে টিপ্পনি কেটে নানা অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা বলত। হিন্দু বনে যাবার রটনা করত। এমন ঋষিতুল্য মানুষটি বংশের পরলোকগত মানুষদের কবরের কাছে গিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। এতে আত্মীয় প্রতিবেশীরা তার দিকে তেড়ে আসত। তিনি তাতে দমে যেতেন না। তিনি বলতেন, “পূর্বপুরুষরা তো সবসময় দোআ-দরূদ শোনেন। মাঝে মাঝে গান শুনলে ওঁদের মনটা ভালো থাকব। ওঁরা আনন্দ পাবেন।”

এই ঋষি মানুষটি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে তার সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে গান করতেন। ওই আসরে তার স্ত্রীও এসে যোগ দিতেন। রাতের বেলায় কখনো মেয়েকে বলতেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাতে। আর তিনি বাইরে পুকুরঘাঁটে বসে মেয়ের বাঁশি বাজানোর সুরে সুরে জীবনের 'সুন্দর' উদযাপনে নিমগ্ন থাকতেন।

তার মেয়েদের দূরের মহাবিদ্যালয়ে হোস্টেলে রেখে পড়িয়েছেন। এরকম দাতা হাতেম তাই স্বভাবের কারণে জমিদারি ক্ষয়ে যায়, আর্থিক দুর্দশা পেয়ে বসলেও মনে ভেঙে পড়েননি। সন্তানদের সাহস ও উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন ঋষিতুল্য মনীষীর মতোই। মেয়ের উচ্চমাধ্যমিক পাশের খবরে বাড়ির বাইরে আতশবাজি ফুটিয়েছেন। এতে গ্রামবাসী বিরাগভাজন হয়েছে, ভুল প্রচারণা চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সেই বাবা তার এক মেয়েকে বাড়িতে পড়শোনা করিয়ে মফস্বল শহরে নিবন্ধন করে পরীক্ষার বন্দোবস্ত করেছেন। আত্মীয় ও গ্রামবাসীরা সেই কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক এবং থানায় গিয়ে নানা অভিযোগ করে মেয়েটির পরীক্ষা ঠেকানোর তৎপরতা চালিয়েছে। কোনো তৎপরতাই তাদের দমাতে পারেনি। না বাবাকে, না তার মেয়েকে। আর ১৯৬০-এর দশকে এভাবে সংগ্রাম করে মাধ্যমিক পাশ করা মেয়েটিই আজকের মহিয়সী নারী পান্না কায়সার।

অদম্য এই মেয়েটির বাবা হচ্ছেন কুমিল্লা জেলার পয়ালগাছা গ্রামের জমিদার মোসলেম উদ্দিন চৌধুরী। যিনি গ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যে জমি দান করেছিলেন। পরে স্কুলের আয়ের জন্যে আরও সম্পত্তি দিয়ে দিয়েছিলেন অকাতরে। সেই গ্রামের স্কুলটি আজ পান্না কায়সারের হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত হয়েছে।

এভাবে আলো ছড়ানো, আলো বিলিয়ে দেয়া আর আলোর খোঁজে প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা এক পারিবারিক পরিবেশে ১৯৫০ সালে জন্মেছিলেন, বেড়ে উঠেছিলেন আর লড়াই করেছিলেন পান্না কায়সার। পান্না কায়সারের জীবনে পিছিয়ে পড়া সমাজের অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার কাহিনী ছবির গল্পের মতো রোমাঞ্চকর।

প্রতিকূলতা পেরিয়ে, পুলিশের কাছে অভিযোগকে আমলে না নিয়ে, জমিদারের লাল টুকটুকে কিশোরীকন্যা পরীক্ষা কেন্দ্রে বসলেন। এ এক কৌতূহল ছড়ানো ঘটনা ছিল কুমিল্লা শহরে। পরীক্ষার প্রতিদিনই কেউ না কেউ তাকে দেখার জন্যে কেন্দ্রে যেতেন। পরীক্ষা পরিদর্শকের নির্দেশ মতো দর্শনার্থীদের উদ্দেশে তাকে দাঁড়াতে হতো। সেই কিশোর মেয়েটিই আজকের পরিণত বয়সে চলে যাওয়া নারীমুক্তির মহিয়সী নাম পান্না কায়সার।

তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং লেখক। তার লেখালেখির পরিধি আত্মজীবনী, মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ হাসিনার রাজনীতি নিয়ে নিবিড় গবেষণা, কথাসাহিত্য এবং প্রবন্ধ। তিনি সম্পাদনা করে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো গ্রন্থ। বিশেষ করে প্রজন্ম একাত্তর বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের ১৯৭১ সালে বাবাকে হারানো বেদনাবিধুর অনুভূতির দলিল। তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন বাংলার কিংবদন্তি প্রগতিশীল সাংবাদিক লেখক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে।

পান্না কায়সারের জীবন, কর্ম ও সংগ্রামকে তুলে ধরার জন্যে মোটাদাগে তিনটি ভাগে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। প্রথম ভাগে তার জন্ম থেকে শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে পরিচয় পর্যন্ত, দ্বিতীয় ভাগে শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে পরিচয় থেকে তাঁর তিরোধান পর্যন্ত; তৃতীয় এবং শেষভাগে ১৯৭১ থেকে ২০২৩ সালের সময়ে দুই সন্তান শমী কায়সার এবং অমিতাভ কায়সারকে নিয়ে তার টিকে থাকার লড়াইয়ের পাশাপাশি আলোয় আলোয় দেখা যাপিত জীবন ও জাতির মুক্তির লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘটনাবহুল এক যাত্রা।

বাবা-মেয়ের সম্মিলিত লড়াইয়ে মাধ্যমিক পাশ করলেন ঠিক। আর্থিক টানাপোড়েনে পরহেজগার উদার দৃষ্টিভঙ্গির এক মামার আশীর্বাদে কুমিল্লা মহিলা কলেজে ভর্তি হলেন, থাকেন কলেজ হোস্টেলে। মাঝপথে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার এক বোনের পরিচয়ের সূত্রে পুরান ঢাকার উর্দু সংস্কৃতির ধনাঢ্য এক পরিবারে বিয়ে হয়ে গেল রাতারাতি। বিয়ে তো নয় এ ছিল এক দাসত্ব, বাবার আশ্রয়ের অতি চঞ্চল আদরের ‘দস্যি’ মেয়েটি হয়ে গেল রাজধানী ঢাকার ধনাঢ্য অন্দরের এক ক্রীতদাস। জীবন ও জীবনের আলো বলে কিছু থাকল না। আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগের পথটিও নিয়ন্ত্রিত। রাত দিন দাসীবৃত্তি, গৃহপালিত গবাদিপশুর দেখভাল থেকে শুরু করে বালতি বালতি পানি টেনে বিশাল বাড়ি ধোয়ামোছা করে প্রাণান্ত পরিশ্রমের পরও চলত বিয়ের সময় যৌতুক না দেয়া নিয়ে হাজারটা খোঁটা।

একদা তার জমিদার বাবা যখন অকাতরে সম্পদ বিলিয়ে দিতেন গরিব মানুষের মাঝে, পড়শী পরিজন টিপ্পনি কেটে বলত দাতা হয়ে গেছে, মেয়ে বিয়ের সময় কী করবে? বাবা পণ করেছিলেন কোনো মেয়ের বিয়েতেই তিনি যৌতুক দেবেন না। শেষতক হয়েছিলও তাই। তবে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছিল দুঃখিনী পান্নাকে।

একপর্যায়ে তার এক বোনের জামাইকে সুযোগ মতো গোপনে ফোন করে মুক্তির উপায় বের করেন। বাবার অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে বাড়ি থেকে পাঠানো তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে ১০ দিনের কথা বলে গিয়ে অনেকটা যুদ্ধে হেরে পরাজিত সৈনিকের মত ‘হারানো যুদ্ধক্ষেত্র ঢাকা’র অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে ছুটলেন। এরপর কলেজ অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব খোলাসা করে বললেন। অধ্যক্ষ মহোদয় পিতার স্নেহ নিয়ে ছায়া হয়ে দাঁড়ালেন, কলেজে আবারও ভর্তির ব্যবস্থা করলেন, বেতন মওকুফ করে দিলেন, বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন। মামা, দুলাভাই আর আত্মীয়দের সহযোগিতায় মহিলা কলেজের হোস্টেলে থেকেই স্নাতক করলেন।

মাঝখানে কুমিল্লায় কলেজ থেকে হোস্টেলে ফেরার পথে ঢাকার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে অপহরণের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিশোরী সেই মেয়েটি অপহরণের খপ্পর থেকে লাফ দিয়ে ছিটকে পড়েন, চিৎকার করে লোক জড়ো করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অপহরণকারীরাও পালিয়ে যায় যায়। আরেকবার হোস্টেলের ভেতরে রাতের বেলা হোস্টেলের ভাঙা দেয়াল দিয়ে ঢুকে ভেতরের আঙিনা থেকে তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তার চিৎকার শুনে হোস্টেলের রান্নাঘরের বাবুর্চি ও কর্মচারীরা দৌড়ে গিয়ে রক্ষা করে। এরকম এক সংগ্রাম চালিয়ে একদা ‘হেরে যাওয়া যুদ্ধক্ষেত্র’ দেশের রাজধানীর বুকে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন বাংলা বিভাগে।

স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়ে ফলের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় চৌদ্দ দিনের পরিচয়ের মাথায় ১৯৬৯-এর তুমুল গণআন্দোলনের কারফিউয়ের ম্যধ্যে বিয়ে করলেন কিংবদন্তি সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লা কায়সারকে। এভাবেই হেরে যাওয়া যুদ্ধক্ষেত্র নিরঙ্কুশ জয় করলেন তাৎপর্যপূর্ণভাবে। শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে তার পরিণয় প্রেম বোঝাপড়া ও রসায়ন ছিল অভিনব। যা পান্না কায়সার তার বিচিত্র লেখাজোখায় ও আলাপচারিতায় বারবার প্রকাশ করেছেন। তার সামগ্রিক লেখাজোখার মধ্যে তার স্বামী শহীদুল্লা কায়সারের কী একটা আভাস বা ছাপ যেন টের পাওয়া যায়। তার কথাশিল্পের নায়ক ও নায়িকাদের মাঝে কেন জানি আমি শহীদুল্লা কায়সার এবং পান্না কায়সারের পরিছন্ন এবং প্রচ্ছন্ন ছায়া খুঁজে পাই। পান্না কায়সারের লেখা ঝরঝরে মেদহীন স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। আমি তার লেখালেখির মুগ্ধ পাঠক।

শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে বিবাহপূর্ব চৌদ্দ দিনের পরিচয়পর্ব, বোঝাপড়া আর ভালোলাগা মিলিয়ে তাদের দাম্পত্যজীবন ছিল আড়াই বছরের। এই আড়াই বছরের প্রেমের যে সমাধি তারা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন তা ছিল শতবছরের মতো শক্ত ভিতের। সেই ভিতের কিছুটা টের পাওয়া যায় পান্না কায়সারের লেখা আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথা ‘মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে’ গ্রন্থে। বইটি বাংলাদেশে ও ভারতে মনোযোগ আকৰ্ষণ করেছিল। আজ থেকে তিন দশক আগে প্রকাশিত বইটি নিয়ে কলকাতার ‘দেশ; পত্রিকাসহ দিল্লির ইংরেজি কাগজেও আলোচনা ছেপেছিল।

১৯৭১-এর শহীদুল্লা কায়সারের আলোয় যেভাবে নিজেকে গড়েছিলেন সেভাবে লড়াইটা চালিয়ে গেলেন। দাঁড় করলেন নিজের দুই সন্তানকে। মানবকল্যাণে বিলিয়ে দিলেন নিজেকে সকলের তরে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন গ্রামের মানুষের জন্যে, গ্রামে তার বাবা প্রতিষ্ঠিত স্কুলের জন্যে, জাতীয়ভাবে উদীচী এবং কেন্দ্রীয় খেলাঘর সংগঠনের মাধ্যমে। প্রজন্ম ৭১ সংগঠন প্রতিষ্ঠায় একজন পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছেন। ভূমিকা রেখেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে পাঁচ বছর জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন পান্না কায়সার। ওই সময় সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতির বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সংসদের একটি কমিটির প্রধান হয়ে দেশের সংস্কৃতির বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ পর্যালোচনা করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশমালাও ওই দশকের শেষদিকে সরকারের বরাবর জমা দিয়েছিলেন। সেই প্রতিবেদন দুইযুগ পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখল না। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নেও উদ্যোগ নেয়া হল না। তিনি চলে গেলেন তার সুপারিশের বাস্তবায়ন না দেখেই।

পান্না কায়সারের লড়াকু জীবনের ভেতর ও বাইরে আলোর মিছিল কতটা বেগবান ছিল তা একটি ছোট্ট চিরকুট থেকে প্রতীয়মান হতে পারে। এই চিরকুটটি তিনি লিখেছিলেন তার কৌশোরে প্রথম দাম্পত্যের শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের উদ্দেশে। শ্বশুর বাড়ির তরফে তার প্রথম স্বামী মি. জনের এক বন্ধু যখন তাকে নিয়ে আসার জন্যে তার বোনের বাসায় হাজির হয়েছিল। তিনি নিম্নোক্ত চিরকুটটি দিয়ে ভদ্রলোককে বিদায় করেছিলেন:

“তোমাদের পুরানো ঢাকার অন্ধকার গলিতে আমি আর ফিরব না। তোমাদের বাড়ির দেয়াল ঠিকরে বাইরের আলো পড়ে না। তাই তোমাদের দৃষ্টি ও মন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তোমাদের মন ও দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখতে পাওনি বলেই ও বাড়িতে আমি কোন মর্যাদা পাইনি। তোমাদের নির্মম ও নিষ্ঠুর ব্যবহার আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তোমাদের ফাঁকি আমার কাছে ধরা পড়েছে। তোমাদের বাড়ি না গেলে তোমাদের এই অসহায় রূপ আমি দেখতে পেতাম না। সেজন্য তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি আর ফিরব না।”

পান্না কায়সার এভাবেই জীবনের ধাপে ধাপে হেরে যাওয়া যুদ্ধেক্ষেত্র জয় করেছেন নব উদ্যমে। অন্ধকারের দেয়াল সরিয়েছেন। আলোর মিছিল গড়েছেন। শত বাধার মাঝে বারবার গেয়েছেন তার মুক্তি আলোয় আলোয়। আলোয় দেখেছেন মুক্তি, দেখিয়েছেন অন্যদেরও। অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন প্রথম জীবনে বাবা ও মায়ের কাছে, পরবর্তী জীবনে শহীদুল্লা কায়সারের মাঝে।

মানবমুক্তির ধারাবাহিকতায় নারীজাগরণ ও নারীমুক্তির ইতিহাসে এই বাংলায় বেগম রোকেয়া, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম, জাহানারা ইমাম, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এরকম তালিকায় পান্না কায়সারের নামটিও একটি উজ্জ্বল সংযোজন হয়ে থাকবে।