সংবাদমাধ্যমগুলোতে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংবাদ ছাপানো, প্রকাশ, প্রচার ও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ইস্যু বা বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপন কায়দা এবং গুরুত্বারোপ কৌশল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের আস্থা কমিয়ে দিতে জোরালো ভূমিকা রাখে।
Published : 04 Jan 2025, 04:36 PM
সপ্তাহদুয়েক আগে একটি গবেষণার কাজে গিয়েছিলাম দিনাজপুর। প্রত্যন্ত একটি গ্রামের উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স আমার গবেষণাক্ষেত্র। হাসপাতালেই ভিআইপি রোগীদের জন্য নির্ধারিত একটি কক্ষে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ডাক্তার, নার্স, রোগী ও রোগীর স্বজনসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের সঙ্গে কথা বলছি। দেখছি, স্মরণে রাখছি ও নোট নিচ্ছি। আর রাতে ঘরে বসে সংক্ষিপ্ত নোটের বিস্তারিত লিখছি।
এক রাতে বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছি, হঠাৎ দরজায় টোকা। দরজা খুলতেই দেখি এক তরুণ ডাক্তার। ওইদিন দুপুরেই তার সঙ্গে কথা হয়েছে, ভাবও জমেছে খানিকটা। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন নিজ এলাকার এই হাসপাতালে। ওইদিন রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালনের ফাঁকে এসেছেন আমার সঙ্গে আড্ডা দিতে। আর এই আড্ডার মাধ্যমে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা এই আশায় আমি পুলকবোধ করলাম।
শুরু হলো আড্ডা। হাসপাতালে তার কর্মজীবন, চিকিৎসা দর্শন, জীবনবোধ, কাজ ও জীবন অভিজ্ঞতা, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যনীতি, স্বাস্থ্য শিক্ষা, চিকিৎসা শিক্ষা, মেডিকেল কলেজ, ডাক্তার হওয়ার প্রক্রিয়া, উপজেলা পর্যায়ে মানুষের রোগ ও তাদের মনস্তত্ত্ব এবং স্থানীয় রাজনীতিসহ নানান বিষয়ে কথা হলো আমাদের। এক পর্যায়ে তিনি জানলেন যে, আমি পেশাগত জীবনের শুরুতে বেশ কয়েকবছর সাংবাদিকতা করেছি। এছাড়া আমার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনাও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে। আমার বিদ্যায়তনিক এই অতীত জেনে তার মুখে, চোখে, বোধে এক ধরনের পরিবর্তন খেয়াল করলাম। ওই পরবর্তনটিতে ছিল খানিকটা সন্দেহ, অভিযোগ, রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ও অনাস্থার মিশেল। মনে হলো তিনি আমার সঙ্গে কথা বলার উৎসাহ পাচ্ছেন না আর। কিন্তু তারপরও কিছুক্ষণ কথা হলো। একপর্যায়ে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। খুলে বললেন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সাংবাদিকতা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা, মতামত ও পর্যবেক্ষণ। আজকের লেখাটির চিন্তাবীজ এসেছে ওই তরুণ ডাক্তারের সঙ্গে আড্ডা থেকেই। এই লেখাটিকে বলা যেতে পারে আমার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ও পেশাগত বাস্তবতার আত্মবিশ্লেষণ বা আত্মানুসন্ধান।
যাই হোক, স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে জনমানসে আস্থাহীনতা জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাটি খুবই জটিল কিসিমের। এটি বহুমাত্রিকও বটে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সংবাদমাধ্যমগুলোতে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংবাদ ছাপানো, প্রকাশ, প্রচার ও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ইস্যু বা বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপন কায়দা এবং গুরুত্বারোপ কৌশল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের আস্থা কমিয়ে দিতে জোরালো ভূমিকা পালন করে। আর ওই ভূমিকাটি পালন করে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও কাঠামোগতভাবে। প্রত্যক্ষ কায়দাটি হলো নেতিবাচক সংবাদ নির্বাচনে ঝোঁক, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে ধরা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার বয়ান হাজির করা। জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিদ্যা বিশেষজ্ঞ নন, এমন ব্যক্তিদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাজির করা। স্বাস্থ্যখাতের অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে বড় করে তুলে ধরা। এ খাতের রাজনৈতিক মাত্রা ও বিভাজনকে উৎসাহিত করা। স্বাস্থ্য ও জীবন কুশলতাসম্পর্কিত বিষয়গুলো চাকচিক্যময়, সুড়সুড়িময় ও যৌন আবেদনময় করে তুলে ধরা।
নেতিবাচক সংবাদ নির্বাচনের ঝোঁকটি কাজ করে বিভিন্নভাবে। যেমন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে কোনো ভুল-ভ্রান্তি ও অবহেলাকে বেশ অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা; অপারেশনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের যে কোনো ভুলত্রুটিকে বড় করে দেখানো; প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর ওপর গুরুত্বারোপ করা; চিকিৎসা খরচ ও কোনো কোনো হাসপাতালে অতিরিক্ত ফি আদায়কে বিশেষভাবে তুলে ধরা; হাসাপাতালে যে কোনো মৃত্যুকে চিকিৎসা অবহেলা হিসেবে অভিহিত করার মাধ্যমে।
আর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো সাধারণত কোনো ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কিত বিপন্নতা ও দুর্ভাগ্যের নাটকীয় বয়ান হাজির করে। চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় যে কোনো দুর্ঘটনার ব্যাপক প্রচার দেয়। কোনো রোগীর নেতিবাচক অভিজ্ঞতাকে মাত্রাতিরিক্ত আবেগমথিত করে তুলে ধরে। কোনো একটি বিশেষ ঘটনাকে বারবার তুলে ধরে। ফলো-আপ সংবাদগুলোতে দায়িত্বে অবহেলা ও দোষারোপের আলোকপাত করা হয় ব্যাপকমাত্রায়। মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে মানবীয় আবেদনময় দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরে। এছাড়াও চিকিৎসা ক্ষেত্রে নেতিবাচক কোনো অভিজ্ঞতা বা বয়ান সামাজিক মাধ্যমগুলো ভাইরাল হলে তা মূলধারার সংবাদগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার বয়ান হাজির করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সম্ভাবনা নয় বরং সমস্যাগুলোকে নিয়মিত জনগণের সামনে হাজির করে। তারা হাসপাতালের ছবি বা বয়ান হাজির করার ক্ষেত্রে জরুরি সেবা কক্ষে অতিরিক্ত রোগীর আধিক্যের চিত্র; চিকিৎসা প্রাপ্তিতে দীর্ঘলাইন ও দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষার প্রতিবেদন এবং হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য কর্মী ঘাটতির নিয়ে প্রতিবেদন করে না। উল্টোদিকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে কোনো যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ না করে, সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না করা, কিংবা কেনাকাটায় দুর্নীতি সম্পর্কে প্রতিবেদন করে। চেষ্টা করে প্রশাসনিক দুর্বলতাকে বড় করে দেখানোর এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা পায়নি বা বঞ্চিত হয়েছে এমন ঘটনাকে উপজীব্য করে প্রতিবেদন করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। আলোপাত করে কাঠামোগত বৈষম্যের ওপর।
এবার দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থাকে মারাত্মক নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার প্রশ্নে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ও কর্মকৌশল বিশ্লেষণ করা যাক। একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হলো, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদগুলোতে যে প্রবণতা খেয়াল করা যায়— বিশেষজ্ঞ কর্তৃত্বকে নেই করে দেওয়া; রাজনৈতিক মেরুকরণকে উৎসাহিত করা; ঠুনকো ও উত্তেজনামূলক বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে সংবাদ ও অন্যান্য আধেয় প্রকাশ করা এবং ভুয়া তথ্য ও অপতথ্যের বিস্তারের বাহন হিসেব কাজ করা।
এখন আমরা এসব কর্মকৌশলকে আরেকটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে চাই। প্রথমেই আসা যাক প্রকৃত চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উপেক্ষা বা গুরুত্ব না দেওয়ার প্রসঙ্গে। স্বাস্থ্য ও জীবন কুশলতা বিষয় প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো বিশেষজ্ঞ নয় এমন ব্যক্তিদের মতামত ও সাক্ষাৎকার প্রকাশের সুযোগ করে দেয় এবং কোনো বৈজ্ঞানিক বিতর্ককে বড় করে দেখায়। সংবাদে এসব বিতর্ককে উসকে দিয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ করে। যাচাই-বাছাই না করে কিংবা গভীরভাবে বিশ্লেষণ না করেই বিকল্প ধারার ওষুধ বা নিরাময় সম্পর্কিত সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ করে। চিকিৎসা সম্পর্কিত বিতর্কগুলো বেশ চাঞ্চচল্যকরভাবে হাজির করে। কখনো কখনো প্রমাণভিত্তিক ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অযথা প্রশ্ন করে বৈজ্ঞানিক ঐকমত্যকেও। শুধু তাই নয়, সংবাদ বা অন্যান্য আধেয়গুলোতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদের খাটো করে দেখা হয়। প্রবণতা দেখা যায় এসব বিশেষজ্ঞের মতামত ও পেশাগত উৎকর্ষকে গুরুত্ব না দেওয়ার। অনেক সময় এদের বিশেষজ্ঞ বা বিজ্ঞানী নামেও অভিহিত করা হয় না। বরং বলা হয় বিশ্লেষক।
দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যখাতে রাজনৈতিক মেরুকরণে গণমাধ্যমগুলো বেশ কিছু কৌশল অবলম্বণ করে। সেগুলো হলো: স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোনো সংবাদ বা আধেয় নির্মাণ, প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলকভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের ও স্বার্থের লেন্স দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যের সিদ্ধান্তগুলোকে রাজনীতিকীকরণ করে। মতাদর্শিক ফ্রেমে আবদ্ধ করে জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণকে। জনস্বার্থের কথা চিন্তা না করে রাজনৈতিক দলের নীতিগত পার্থক্যগুলোর ওপর আলোকপাত করে। সাক্ষাৎকার ও মতামতের ক্ষেত্রে রাজনীতি ঘেঁষা বিশেষজ্ঞদের নির্বাচন করে।
তৃতীয়ত, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সংবাদ ও আধেয় প্রকাশের ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যমূলক কভারেজের ক্ষেত্রে তারা চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল-ভ্রান্তি ও অবহেলার ঘটনাগুলোকে বেশ ফলাও করে প্রকাশ করে। এছাড়াও পাঠক-দর্শক-শ্রোতার মনে ভয় ও ক্ষোভের জন্ম দেয় এমন নাটকীয় শিরোনাম দেয়। স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে সাফল্য ও ব্যর্থতাকে সমান নিক্তিতে না মেপে বরং ব্যর্থতার গল্পগুলো বেশি বেশি তুলে ধরে। মূল মনোযোগটা থাকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাক্ষেত্রে সংঘাত ও বিতর্কমূলক বিষয়গুলোতে।
চতর্থত, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে ভুয়া ও অপতথ্য বিস্তারের বাহন হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে, মূলধারার গণমাধ্যমগুলো প্রয়োজনীয় যথাযথ যাচাই-বাছাই না করেই নতুন কোনো আবিষ্কার কিংবা দাবিকে তাৎক্ষণিক প্রকাশ ও প্রচার করে। ভুয়া দাবি একবার প্রকাশ করে ফেলার পর প্রয়োজনে সংশোধন করে না কিংবা দেরিতে করে। ফলে স্বাস্থ্য চিকিৎসা সম্পর্কে ভুল ধারণা, পদ্ধতি ও চর্চাগুলো ইকোচেম্বার ইফেক্টের মতো আরও জোরদার হতে থাকে। আর ওই জোরদারীকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূলধারার কোনো গণমাধ্যমের বেঠিক কিংবা তুলনামূলক কম যাচাইকৃত আধেয়কে ব্যাপকমাত্রায় ছড়িয়ে দেয় তারা। বিশেষ করে রোগী ও তাদের স্বজনদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোকে। ফলে মানুষের মাঝে যুক্তিসিদ্ধ চিন্তার বদলে আবেগতাড়িত হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। কেননা আধেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত হয়। এখানে কোনো প্রেক্ষাপট থাকে না। থাকে কেবল সামান্যকিছু তথ্য। এছাড়ও ব্যবহার করা হয় বাহারি কিছু শব্দবন্ধ। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষগুলোকে অতিরিক্ত সরলীকরণ প্রবণতাও কিন্তু ভুল তথ্য বিস্তারে ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশ সংবাদ্যমগুলোর দিকে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাই, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ, প্রচার ও আধেয় নির্মাণ করে। এখাতর স্ক্যান্ডালগুলোকে আদল দেয় বিশেষভাবে; হাসপাতালে হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে ব্যাপকমাত্রায়। সংবাদজুড়ে থাকে স্বাস্থ্য, হাসপাতাল, ও চিকিৎসাক্ষেত্রে দুর্নীতি, অবহেলার খবর, হাসাপাতালের জরুরি বিভাগের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির বয়ান ও ছবি। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যগুলোর কাছে উপজেলা ও জেলার পর্যায়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদ মানেই চিকিৎসা উপকরণ, যন্ত্র ঠিক মত কাজ করে না। ব্যবহারহীন পড়ে আছে এক্স-রে মেশিন। হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত ওষুধ ও কর্মীবাহিনী। চিকিৎসা খরচের মাত্রা বেশি। খবর জুড়ে থাকে সীমাহীন দূর্নীতির অভিযোগ। এছাড়ও থাকে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা সেবার তুলনা। এছাড়াও থাকে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের আচরণ, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের ব্যর্থতা। সংবাদ বয়ানের এক বড় অংশজুড়ে থাকে হাসপতালের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রশ্ন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খেয়াল করা যাছে রেফাল ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে সংবাদের আধিক্য। এছাড়া রয়েছে হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক অদক্ষতা, দুর্নীতি, অর্থ ও তহবিল ঘাটতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও স্বাস্থ্যনীতির বিভিন্ন দিক।
এসবার আসা যাক এসব প্রতিবেদন কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা খাত সম্পর্কে জনগণের আস্থাকে কমিয়ে দেয় ওই প্রসঙ্গে। আমরা প্রায়ই খেয়াল করি সংবাদের শিরোনা লেখা হয় ‘ওমুক হাসপাতাল যেন মৃত্যু ফাঁদ: এক দিনে এত সংখ্যক রোগীর মৃত্যু’। এখাবে একাধিক মৃত্যু সম্পর্কে নাটকীয় চটকদার শিরোনাম দেওয়া হয়। হাসপাতালের সম্পদ তথা চিকিৎসাকর্মী বাহিনীর ঘাটতি, প্রয়োজনীয় উপকরণের ঘাটতি, তাদের কাজের চাপ নিয়ে তেমন কিছুর উল্লেখ থাকে না সংবাদে। শুধু তাই নয়, উল্লেখ থাকে না চিকিৎসা প্রদানে তাদের সাফল্যের কথাগুলো। আবার আবার দেখা যায়, ‘ওমুক হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু’ কিংবা ‘ডাক্তারের ভুলে রোগীর মৃত্যু’ এমন শিরোনামেও খবর দেখতে পাই আমরা। এসব এক্ষেত্রে কেবল ট্রাজেডির ওপর ফোকাস করে অত্যন্ত গভীর আবেগীয় বয়ান হাজির করা হয়। চিকিৎসা প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থাগত বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করা হয় না।
অন্যদিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বর্ণনা হাজির করতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো শিরোনামে লেখে ‘হাসপাতালের বারান্দাতেই রোগীর মৃত্যু’। এখানে রোগীর ভিড়ের তন্ন তন্ন বিবরণ হাজির করা হয়। সংবাদে সেঁটে দেওয়া হয় মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে আছে এমন রোগীর ছবি। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সক্ষমতার প্রেক্ষাপটটি হাজির করা হয় না। সংবাদজুড়ে থাকে রোগীর পরিবারগুলোর আবেগঘন সাক্ষাৎকার ও বয়ান। এছাড়াও স্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদের শিরোনামগুলো এরকম: ‘ওমুক উপজেলায় চিকিৎসা সঙ্কট: এত সংখ্যক মানুষের জন্য রয়েছে একজন মাত্র ডাক্তার’; ‘হাসপাতালে ওষুধ নেই: রোগীরা বাধ্য হচ্ছেন নিজ খরচে ওষুধ কিনতে’, ‘জমি বিক্রি করে মেটালেন চিকিৎসা খরচ’, ‘সরকারি ওষুধ বিক্রির দায়ে হাসপাতালকর্মী আটক’, ‘হাসপাতাল ময়লা ও দুর্গন্ধে ভরা, দেখার কেউ নেই’ ‘রমরমা বেরসরকারি হাসপাতাল ব্যবসা’ ইত্যাদি। এসব সংবাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেবল রোগীর দুর্ভোগের বয়ান থাকে, স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের সফলতা ও সততা সম্পর্কে ছিটেফোঁটা বর্ণনাও থাকে না। কেবলই থাকে তাদের দুর্বলতা ও দুর্নীতির অভিযোগ।
এখন প্রশ্নে হলো যে, স্বাস্থ্যের মতো এমন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এভাবে সংবাদ করে কেন। জবাবটি বহুমাত্রিক। বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের গণমাধ্যমের কর্মকৌশল ও রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে হবে। গণমাধ্যম বাণিজ্যের বেশিরভাগ জুড়েই আছে মনোযোগ আকর্ষণের অর্থনীতি। তারা প্রতিনিয়তই পাঠক-দর্শক ও শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য একে-অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে থাকে। যত সংখ্যক পাঠক-দর্শক-শ্রোতা বিষয়টি দেখবে, পড়বে বা শুনবে বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির সম্ভাবনাও তত বাড়বে। এছাড়া আছে সবার আগে অতি দ্রুত সংবাদ প্রকাশের তাড়া। প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বড় গলদটি সংবাদমাধ্যমের দর্শনে— অতিসরলীকৃত বায়ান হাজির করার চেষ্টা ও প্রবণতায়।
এবার সংবাদমাধ্যম সৃষ্ট জন-আস্থার সঙ্কট স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কী প্রভাব ফেলে তা বুঝে নেওয়া যাক। একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থসেবাকর্মীদের ওপর জন-আস্থার এই সঙ্কট বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মোটাদাগে এই প্রভাবগুলো হলো: স্বাস্থ্যসেবাকর্মী-রোগীর মাঝের সম্পর্কটি বিনষ্ট হয় যায়; স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের পেশা ও ব্যক্তিগত জীবনে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে; স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে; সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে; স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে কোনো সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের পেশা ও ব্যক্তিগত জীবনে যে প্রভাবগুলো ফেলে তা হলো: তাদের দক্ষতা ও সেবার মান সম্পর্কে রোগীদের সন্দেহ, অবিশ্বাস ও হতাশাবাদের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে দেরি করে; ডাক্তারের পরামর্শ মেনে ওষুধ না খাওয়া ও অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরণ না করার প্রবণতা বাড়ে। হাসপাতালে সামান্যতেই স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক যোগাযোগ ও বোঝাপড়া ঠিকমতো হয় না।
অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নেতিবাচক উপস্থাপনার কারণে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবাকর্মীরা পেশাগত মনোবল হারিয়ে ফেলেন; অন্তর্জালা ও মনোপীড়নে ভুগতে থাকেন; পেশাগত সন্তুষ্টির মাত্রা কমে যায়; দক্ষ, মেধাবী ও মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা এই পেশায় আসতে চান না কিংবা এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা গ্রহণ করতে চান; কর্মক্ষেত্রে তাদের মানসিক চাপের মাত্রা বাড়ে; পেশাগত আত্মমর্যাদা কমে যায় এবং এই পেশার লোকজনের জনগণের শ্রদ্ধবোধও কমে যায়।
আর জনগণের আস্থার ঘাটতি থাকলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নিরুৎসাহিত হয় কিংবা দেরিতে সেবা নেয়। রোগ প্রতিবোধমূলক সেবা গ্রহণের প্রবণতা কমে যায়। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রবণতা বাড়ে। যেমন, একই রোগের জন্য একাধিক ডাক্তার দেখানো তথা দ্বিতীয় মতামত গ্রহণ; ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসার আগেই কোনো ওষুধ খাওয়া কিংবা অন্যকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ; বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা তথা কবিরাজ, ওঝা কিংবা ধর্মীয় গুরুদের মাঝে আরোগ্য খোঁজা; ইন্টারনেট দেখে কিংবা অন্যকোনো পন্থায় নিজেই রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা ও ওই অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া।
শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর আস্থা না থাকলে মানুষ জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম এড়িয়ে চলতে চায়। যেমন, যোগ্য ও দক্ষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করে; কোনো রোগ হলে দেরি করে চিকিৎসা নেয়; টিকা বা ভ্যাকসিন নিতে চায় না; সমাজে রোগ নির্ণয় কার্যক্রম তথা স্ক্রিনিংয়ে অংশ নিতে চায় না; চিকিৎসা পদ্ধতি বা প্রোটোকলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে; কোনো পরিস্থিতিতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনুধাবনের মাত্রা কমে যায়।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় জনগণের আস্থার সঙ্কটের প্রশ্নে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাটি খুবই জটিল ও বহুমাত্রিক। সংবাদ নির্বাচন, উপস্থাপন পদ্ধতি, দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের কাছে পৌঁছানোর কায়দা-কৌশল ব্যাপক মাত্রায় নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। একপর্যায়ে এই আস্থাকে কমিয়ে দিতে পারে। আর ওই আস্থা ফেরাতে, আস্থা গড়ে তুলতে ও বজায় রাখতে দরকার একটি সমন্বিত প্রয়াস। আর ওই প্রয়াসে যুক্ত করতে হবে সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, সংবাদকর্মী, স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের। যার মূল লক্ষ্য হলো সাংবাদিকদের ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিবেদনে উৎসাহিত করা; তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা; স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ও সাংবাদিকদের স্বচ্ছ ও পেশাদার যোগাযোগ বৃদ্ধি করা; ও পদ্ধতিগতভাবে আস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।