জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম লাগানহীনভাবে বেড়ে যায়। ফলে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সমাজ ও রাষ্ট্রে। জ্বালানির মূল্যহ্রাসে উল্টোটা অর্থাৎ দাম কমার ঘটনা ঘটেই না বললে চলে।
Published : 14 Sep 2024, 06:11 PM
জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণ কমেছে, সে হিসাবে বাংলাদেশের বাজারে এর প্রভাব খুবই কম দেখা যাচ্ছে।তেলের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে আরও হ্রাস পেতে পারত দ্রব্যমূল্যে– সাধারণ জনগণ তাই মনে করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের বাজারে যে প্রভাব দেখা যায়, মূল্য হ্রাসে সে প্রভাব পড়ে না। জ্বালানি তেল এমন একটি দ্রব্য যার মূল্য বাড়লে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পায়। চাষাবাদ থেকে শিল্প-কারখানা পরিচালন– সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জ্বালানি। তাই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম লাগানহীনভাবে বেড়ে যায়। ফলে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সমাজ ও রাষ্ট্রে। জ্বালানির মূল্য হ্রাসে উল্টোটা অর্থাৎ দাম কমার ঘটনা ঘটেই না বললে চলে।
সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে সরকার। ঘোষিত দামে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমেছে ১ টাকা ২৫ পয়সা। পেট্রোল ও অকটেনের দাম কমেছে ৬ টাকা। সরকারের নতুন মূল্য নির্ধারণে লিটার প্রতি ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৬ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা। পেট্রোলের দাম প্রতি লিটার ১২৭ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২১ টাকা ও অকটেনের দাম ১৩১ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২৫ টাকা।
বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ মার্চ থেকে শুরু করা হয়েছিল। নতুন দাম ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হচ্ছে। জ্বালানি তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে ৩১ অগাস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের সূত্র নির্ধারণ করে নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি। এতে বলা হয়, দেশে ব্যবহৃত অকটেন ও পেট্রোল ব্যক্তিগত যানবাহনে অধিক পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। তাই বাস্তবতার নিরিখে বিলাস দ্রব্য হিসাবে সব সময় ডিজেলের চেয়ে অকটেন ও পেট্রোলের দাম বেশি রাখা হয়।
অকটেন ও পেট্রোল বিক্রি করে সব সময় মুনাফা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। মূলত ডিজেলের ওপর বিপিসির লাভ-লোকসান নির্ভর করে। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি। আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তেলের দাম আরও কমানো উচিত। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম বিপিসির প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক কম। ফলে পণ্যটি আমদানিতে বিপিসির খরচও অনেক কম। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপিসি ভোক্তার কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহের পরিবর্তে মুনাফায় মনোযোগ দিচ্ছে বেশি।
বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দামে রেকর্ড পতন হয়েছে। ২০২১ সালের পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আবার আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের নিচে নেমেছে। অনেকের আশঙ্কা, তেলের দাম ৬০ ডলারে নেমে যেতে পারে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে চীন। তাদের চাহিদার ওপর বিশ্ব বাজারে তেলের দাম অনেকটা নির্ভর করে। কিন্তু সেই চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। সেখানে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ায় তেলের বাজারে মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। বছরের প্রথম ভাগে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চীনের তেল আমদানি কমেছে। চাহিদা কম থাকায় তেল খুব একটা মজুত করছে না চীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলের দাম কমার এটাই মূল কারণ।
তেল রফতানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেকের আশঙ্কা, ২০২৪-২৫ সালে তেলের চাহিদা আরও কমতে পারে। ওপেকের তথ্য বলছে, এখন দৈনিক চাহিদা ১৭ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল হলেও চাহিদা কমে ১৭ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেলে নেমে আসতে পারে। অ্যাঙ্গোলা, আলজেরিয়া, ইরাক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, নাইজেরিয়া, ভেনেজুয়েলা, লিবিয়া, সৌদি আরব, গ্যাবন, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি এই ১২ দেশ নিয়ে গঠিত জোট ওপেকের ওপর মূলত নির্ভর করে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কতটা বাড়বে বা কমবে।
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ওপেক তেলের উৎপাদন হ্রাস করেও বাজারে দাম খুব একটা বাড়াতে পারেনি। তবে ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো আগামী বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়াতে পারে বলে জানা গেছে। ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তেলের দাম ৭০ ডলারের নিচে নেমে যাওয়ায় তারা উত্তোলন বৃদ্ধির সময়সীমা দুই মাস পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওপেক প্লাস জানায়, প্রয়োজনে তারা উত্তোলন কমানো বা অন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এশিয়া-প্যাসিফিক পেট্রোলিয়াম কনফারেন্স (এপিপিইসি) এর বহুজাতিক কোম্পানি ট্রাফিগুরার তেল বিভাগের প্রধান বেন লাকক বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে জ্বালানি তেলের বাজারে রীতিমতো উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। শিগগির বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলারে নেমে যেতে পারে। এমনকি ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো উত্তোলন না বাড়ালেও বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হয়ে যেতে পারে।
জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বাস ভাড়ায় এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্ন সাধারণ যাত্রীদের। আগের যে ভাড়া ছিল সেই ভাড়াতেই চলবে রাজধানীর গণপরিবহন, নাকি ভাড়া কমানো হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, মহাখালী, বংশাল, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, রামপুরা, বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, যাত্রীদের কাছ থেকে এখনও আগের ভাড়াই নেওয়া হচ্ছে। গণপরিবহনের ভাড়া সর্বনিম্ন ১০ টাকা, সেটা দূরত্ব যা-ই হোক।পণ্যবাহী পরিবহনেও একই অবস্থা। জ্বালানির দাম কমানোর সুফল পাচ্ছেন শুধু পরিবহন মালিকরা। সরকার নির্ধারিত কিলোমিটার প্রতি ভাড়া অকার্যকরই থেকেছে। যাত্রী হিসেবে বলতে পারি সরকার শুধু বাসের ভাড়া বাড়ানোর সক্ষমতা রাখে। ভাড়া কমলে সরকার সেটা কার্যকর করতে পারে না পরিবহন মালিকদের দাপটে। বাস মালিকদের সঙ্গেই সরকার সমঝোতা করে, কিন্তু কোন সরকারই যাত্রীর পাশে থাকেনি।
দেশ পরিচালনায় এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দলীয় সরকারের পতন হয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে নতুন সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে ছাত্রদের পথ ধরে দেশে গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সম্প্রতি। দেড় দশক ধরে দেশের সড়ক পরিবহন খাতে দাপিয়ে বেড়ানো মালিক ও শ্রমিক নেতারাও এখন লাপাত্তা। সরকারের পতনের পর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন এ খাতের ডজনখানেক শীর্ষ নেতা। বিগত ১৫ বছরে পরিবহনে নিয়ন্ত্রণহীন চাঁদাবাজি আর অপকর্মের কারণেই গা ঢাকা দিয়েছেন তারা। তাদের কেউ কেউ অবৈধ অর্থে হয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। বাড়ি গাড়িসহ দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।
আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এক মাসের মাথায় সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে। সাধারণ ভোক্তাদের কাছে তা প্রত্যাশিত ছিল। উৎপাদন কেন্দ্র বা আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করে ডিজেল দিয়ে। লিটার প্রতি ডিজেলের মূল্য কমেছে ৬ টাকা। অতীতে আমরা ভোক্তারা জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ধারাবাহিক প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। পরিবহন মালিকগণ জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে মুনাফা লুটেছেন। প্রভাব পড়েছে বাজারে। ফলে পণ্যের মূল্য বেড়েছে। জ্বালানি তেল ডিজেলের দাম কমেছে। ফলে পণ্য পরিবহনে খরচ কমে গেছে বা যাবে এটাই স্বাভাবিক।
পণ্য বিপণনে সাপ্লাই চেইন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে পণ্যমূল্য হ্রাস বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। উৎপাদন খরচ বা আমদানিকৃত পণ্যমূল্য, পরিবহন ভাড়া, সেতু পারাপারের টোল খরচ, প্রশাসন যন্ত্র বা রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি এসব যুক্ত হতো সরবরাহ প্রক্রিয়ায়। ফলে কম দূরত্ব থেকে আসা পণ্যেও ভোক্তাকে বেশ টাকা দিতে হতো। কিন্তু এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে দলীয় সরকারের সেই অনিয়মগুলো আপাতত দৃশ্যমান নয়। অথচ বাজারে জ্বালানি তেল মূল্য হ্রাসের প্রভাব তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয়নি এখনও। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনও উর্ধ্বমুখি। ব্যবসায়িদের ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙ্গেনি। বাজার তদারকিকরণ প্রক্রিয়ায় সরকারের নিয়োজিত দফতরগুলো অকার্যকর বহুদিন ধরে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা দক্ষ ও সৎ একজন অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব কেমন তা তিনি বেশ ভালোই বুঝেন। এ উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, পরিবহন মালিক ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে বৈঠক করে পরিবহন ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করে দেওয়া খুবই জরুরি। সাধারণ মানুষ এখনও নিদারুণ কষ্টে আছে! তাই নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত পরিবহন খাতকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে সহায়তা দেবে। নিয়ন্ত্রণে থাকবে মূল্যস্ফীতি। আর এর ফলে বাজারে ইতিবাচক ফল দেবে। সাধারণ মানুষও পাবে স্বস্তি।