জাহাঙ্গীরনগরের ‘সুন্দরবনে’ শুরু হয়েছে ‘পরিবেশ-গণহত্যা’

জাবির শালবন বাস্তুতন্ত্রের নিজের এক অর্ন্তগত শক্তি আছে। মানুষ হিসেবে এটি বারবার আমরা ভুলে যাই। আর একটার পর একটা ভুল করতে থাকি। মাটি, পানি, বৃক্ষ, মাছ, পতঙ্গ, কী পাখিরা কিন্তু সব মনে রাখে।

পাভেল পার্থপাভেল পার্থ
Published : 12 Nov 2023, 11:28 AM
Updated : 12 Nov 2023, 11:28 AM

জাহাঙ্গীরনগর। প্রাচীন এক পাতাঝরা বনের স্মৃতি নিয়ে জেগে থাকা দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় । অনেকে বলেন, সবুজের বুকে লাল প্রজাপতি। বহুদিন এমনটাই হয়তো ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে নিদারুণভাবে বদলাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে জাবির প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশ। উন্নয়নের আঘাতে রক্ত ঝরছে সর্বত্র। বিদ্যায়তনটি ‘মধুপুর গড়ে’ অবস্থিত। শালবন কেটে ‘কুরুক’ ও ‘ছইলা’ মৌজায় গড়ে তোলা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়াঞ্চলের আদি বৈশিষ্ট্য তছনছ হয়েছে। বিশেষ করে ‘বাইদ’ বা নিম্নভূমি এবং ‘চালা’ বা উঁচুভূমি এবং জলাভূমির বাস্তুতন্ত্র ওলোটপালট হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো জাবির বাস্তুতন্ত্র বৈচিত্র্য হারাচ্ছে। এমনকি নিখোঁজ হচ্ছে উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্য। জোর করে বদলে ফেলা হচ্ছে এখানকার প্রতিবেশগত বিন্যাস।

বহুদিন জাবির মাটিতে পত্রঝরা বনভূমির গন্ধ ছিল। এই গন্ধ প্রতিদিন উধাও হচ্ছে। এক এক ঋতুতে এক এক বর্ণবিভা ও গন্ধমাধুরী বহুদিন টের পেয়েছেন এখানের বাসিন্দারা। শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও বিদ্যায়তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টজন। সেই রূপ, সেই রস প্রশ্নহীনভাবে বদলে ফেলা হচ্ছে। জাবি খেলার মাঠ পেরিয়ে ভাসানী হলের যাওয়ার রাস্তায় হলুদ শিমূল কিংবা কবির সরণির মহুয়ার ঝাঁঝ আমাদের বহুজনকে উত্তুঙ্গ করেছিল বহুদিন। এখানেই খুঁজে পেয়েছি কুমারীলতা, পাতাঝাঁঝি, বনবড়ই কিংবা বিরল ফার্ন। মন বিষণ্ন ও দুর্বার হয়ে ওঠে যখন শুনি শ্রেণিকক্ষ বানানোর নামে একের পর এক গাছ কাটছে বিশ্ববিদ্যালয়। তাহলে এসব শ্রেণিকক্ষে কী পড়ানো হবে? পরিবেশ-গণহত্যা?

ফেলে আসা গাছ, পাখি, বন, জলাশয়ের জন্য কলিজা কাঁপে। কারণ কেবল শ্রেণিকক্ষ নয়; আমাদের গড়ে তুলেছিল জাবির এইসব লতাগুল্ম, পাখিদের ডানা কিংবা কুয়াশার চমক। কীভাবে আজ জাবির পরিবেশগত অবদান ভুলে যাই! নির্দয়ভাবে অস্বীকার করি?   

ঘুমন্ত গাছেদের খুন করতে পারে কেউ? 

সময়টা খুব বেপরোয়া ও বিদীর্ণ। দীর্ঘ মহামারীর দাগ নিয়ে এক যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ইসরায়েলি হামলায় রক্তাক্ত আজ ফিলিস্তিন। গাজায় ঘুমন্ত শিশুরা আর চোখ মেলেনি। আহারে এমনি এক নিদারুণ দুনিয়ায়, জাবিতে ঘুমন্ত গাছেদের ওপরেও হামলা হয়েছে। ইসরায়েলি কায়দায় ঘুমন্ত গাছেদের ওপর নির্দয় কোপ পড়েছে। দোসরা নভেম্বর সকালে ফিলিস্তিনের গাজার শিশুদের মতো গাছেদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় জাবির সুন্দরবনে। এর আগেও ফিলিস্তিনের শিশুদের মতো জীবন্ত ছিল গাছগুলো। রাতে গাছেরা ঘুমায়। এও কী আজ আবার জানাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে? রাতে গাছের একটা পাতা ফুলও ছিঁড়ে না কেউ। এ কেমন পাষণ্ড উন্মত্ত উন্মাতাল উন্নয়ন বাহাদুরি। ঘুমিয়ে থাকা গাছেদের খুন করা হবে। এক একটি গাছের গায়ে সংসার পাতা লাইকেন, শৈবাল, ছত্রাক, পিঁপড়া কী পতঙ্গরা মুহুর্তেই হবে গৃহহীন। গাছ থেকে ছিটকে পড়বে পাখিরা। এ কেমন উন্নয়ন, ছানা পাখিদের থেকে মা পাখিকে আলাদা করা হবে? এমন উন্নয়ন-দর্শনই আজকাল শেখায় আমাদের বিদ্যায়তন। তা না হলে বারবার প্রাণ-প্রকৃতির বিরুদ্ধে কেন দাঁড়াচ্ছে জাবির উন্নয়ন? 

বিস্ময়কর হলো ঘুমন্ত গাছেদের ওপর এমন হামলা কারা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা জানেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. নূরুল আলম গাছ হত্যা বিষয়ে তাঁর না জানার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন গত ২ নভেম্বর। বরং তিনি জানান, ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় গাছ না কেটে ভবন করার কথা জানান তিনি। উপাচার্যের অজান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধ-শতাধিক গাছের প্রাণ যাওয়া নিদারুণ দুশ্চিন্তার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসানী হল এবং খেলার মাঠ ও মুক্তমঞ্চের কাছাকাছি ‘সুন্দরবন’ হিসেবে পরিচিত শালবনের গাছ কে বা কারা কেটে ফেলেছে কেউ জানে না। আইবিএর পরিচালক গণমাধ্যমকে জানান, ইনস্টিটিউটের ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করেন তারা, এই দরপত্রের কার্যাদেশ যারা পেয়েছেন তারাই গাছগুলো কেটেছেন। তার মানে আইবিএ’র নির্দেশেই গাছ কাটা হয়েছে। আইবিএ ভবনের শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য সংবেদনশীল এই শালবনটিকে বেছে নেয়া হয়। শুরু থেকেই গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে জাহাঙ্গীরনগর। গাছ বা পরিবেশ হত্যা করে ভবন নির্মাণের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। জাবির সকল অংশীজনদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি ঘুমন্ত গাছেদের হত্যার প্রতিবাদে আবারো সরব জাহাঙ্গীরনগর। মিছিল, পথনাটক, সভা, প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান, গাছের চারা রোপণ নানা কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীরা গাছ না কেটে পরিবেশ রক্ষা করে আইবিএ ভবন নির্মাণের দাবি জানিয়েছে। ২ নভেম্বর আইবিএর শিক্ষার্থীরাও তাদের ভবনের দাবিতে মিছিল করে। গণমাধ্যম আইবিএর মিছিলকে ‘পাল্টা বিক্ষোভ মিছিল’ বলেছে। মিছিলকারীরা যে কোনো মূল্যে ভবনের নির্মাণের দাবি তুলেছেন। আর বিপদ এখানেই। ভবন বনাম প্রকৃতি।দুনিয়ার কেউ কী প্রাণ-প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে পারে? নিজের বিরুদ্ধে কী কেউ সংঘাতে যায়? কিন্তু বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে ‘উন্নয়ন বনাম পরিবেশ’ এই ধরণের সমাধানহীন তর্ক তৈরি হয়েছে। বা কোনো পক্ষ বাণিজ্য, মুনাফা বা লাভের জন্য নানামুখী অহেতুক বিতন্ডা তৈরি করেছে। বন্ধুর বিরুদ্ধে বন্ধুকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের সপক্ষে দাঁড়ানো আন্দোলনকারী আর আইবিএর শিক্ষার্থীদের ভেতর সস্তা দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি তৈরি করে কোনোপক্ষ এখান থেকেও ফায়দা লুটার কসরৎ করবে। জাবির কেউ কী গাছেদের খুন করে, পরিবেশ বিনষ্ট করে নিজেদের দালানবাড়ি চাইবে? চাইতে পারে? পারে না।

কিন্তু বিস্ময়কর হলো কেন উপাচার্য এই গাছ কাটা বিষয়ে জানবেন না। কারণ ভবন নির্মাণের অনুমোদন, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন সবই তিনি করেছেন। আমরা আশা করবো জাবির সাম্প্রতিক এই গাছহত্যার তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে কোনোভাবেই জাবির প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে বিপন্ন করা যাবে না। জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাস্টার প্ল্যান আছে। পরিবেশবাদী স্থপতি মাজহারুল ইসলাম জাবির উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন। জাবির এই সংকটময় সময়ে আমরা স্থপতি মাজহারুল ইসলামের চিন্তাভাবনাকে নতুনভাবে পাঠ করতে পারি। বিশেষ করে তাঁর জন্মশতবর্ষের সন্ধিক্ষণ জাহাঙ্গীরনগরের কাছে হয়তো এক প্রাণমুখী স্থাপত্য ও অঞ্চল পরিকল্পনার জিজ্ঞাসা তৈরি করছে। জাবির মতো একটা অতি সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন কেমন হওয়া দরকার এ নিয়ে আমাদের সকল চিন্তা, গবেষণা, চর্চা, অনুশীলন ও তর্ককে একত্র করা জরুরি। আশা করবো প্রশাসন ক্ষমতা ও গায়ের জোরে গাছেদের বিপক্ষে যাবে না। বিদ্যায়তনের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত সর্বপ্রাণ ও সর্বজনদের নিয়ে এক সবুজ সংহতির বলয় বিস্তৃত করবে। জাবির এই সবুজ সংহতির বলয়ই হয়তো এর অনন্য পরিচিতি তুলে ধরবে বিশ্বমাঝে। 

জাবিতে কী শাল গাছ থাকবে? 

জাবিতে ১৪৫ গোত্রের ৫৭৪ পরিবারের ৯১৭ প্রজাতির উদ্ভিদ সনাক্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ। এর ভেতর প্রায় ৭০ ভাগই স্থানীয়ভাবে প্রকৃতিতে জন্মে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম ‘রেড ডাটা বুক অব ভাস্কুলার প্ল্যান্টস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে দেশের বিপদাপন্ন উদ্ভিদের তালিকা করেছে। এর ভেতর প্রায় ১৪টি বিপদাপন্ন উদ্ভিদ জাহাঙ্গীরনগরের প্রকৃতিতেও জন্মে। ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এই গবেষণাটি চলে। ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব প্ল্যান্ট ট্যাক্সোনমিতে’ ২০২১ সালে ‘ফ্লোরিস্টিক কম্পোজিশন অব জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস : অ্যা সেমি ন্যাচারাল এরিয়া অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরে সপুষ্কক উদ্ভিদের সংখ্যা বেশি, প্রায় ৮৮৩ প্রজাতির। ১২ প্রজাতির নগ্নবীজী উদ্ভিদ ও ২২ প্রজাতির ফার্নও দেখা গেছে। উদ্ভিদকূলের প্রায় ৫২ ভাগই ভেষজ। বাসক, কালমেঘ, শতমূলী, পুনর্ণভা, ধুতরা, কুরচি, তুলসী, অর্জুন, হরিতকি, বহেরা, নিশিন্দা, চন্দন এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ জন্মে জাবিতে। জলজ উদ্ভিদের ভেতর শাপলা, পদ্শ, কলমি, পানিকলা, পানিমুরিচ, পাতাঝাঁঝি, চাঁদমালা, পানিসিংগারা, ঢোলকলমি, বড়নুখা, কেরালি, শীতলপাটি, ক্ষুদিপানা, টোপাপানা জন্মে জাবির জলাশয়ে। জাবি থেকে কত প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়েছে এর কোনো খতিয়ান আমাদের হাতে নেই। কিন্তু যেভাবে প্রাণবৈচিত্র্যবিনাশী উন্নয়ন সম্প্রসারিত হচ্ছে তাতে খুব দ্রুত জাবি বৈচিত্র্য হারাতে থাকবে। কারণ এই উন্নয়ন বাহাদুরি বৈচিত্র্যবিমুখ। অচিরেই জাবি থেকে নিখোঁজ হবে শাল গাছ।

বিরল বৈচিত্র্য বাহাদুরিতে বিলীন 

জাহাঙ্গীনগরের জলাভূমিগুলো দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রাণবৈচিত্র্য অঞ্চল। জলজ উদ্ভিদ ও পরিযায়ী পাখিদের এক গুরুত্বপূর্ণ বিচরণস্থল এই জলাশয়গুলো। জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হলের পাশের সরোবরের শৈবালবৈচিত্র্য নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন জাবি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চন্দ্রিমা দাশ ও শামীমা নাসরীন জলি। গবেষণাটি ২০২৩ সালে ‘কম্পোজিশন অ্যান্ড ডাইভার্সিটি অব অ্যালগাল ফ্লোরা ইন জাহানারা ইমাম-প্রীতিলতা হল সরোবর লেক অব জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস সাভার ঢাকা’ শিরোনামে ‘অ্যানুয়াল রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউ ইন বায়োলজি’ শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে (ভলিউম-৩৮, ইস্যু-৪)। গবেষণায় তারা ৮টি শ্রেণির ৯৮ টি গণের ২৩৪ প্রজাতির ফাইটোপ্ল্যাংকটন সনাক্ত করেছেন। ২০১২ থেকে ২০২২ সালের ভেতর উল্লিখিত লেকের পানি নিয়ে গবেষণার ভেতর দিয়ে প্রাপ্ত এই শৈবাল বৈচিত্র্যকে গবেষকগণ ‘খুব একটা ভাল নয়’ বলে চিহ্নিত করেছেন। সাম্প্রতিক এই গবেষণার ফলাফল অবশ্যই আমাদের সতর্কবার্তা দেয়। জাবির লেকগুলোর স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ভাল নেই। এখানে শৈবাল ও জলজ বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। খাদ্যশেকল বদলাচ্ছে।

জাবির মাকড়সা বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ফারিয়া ফারহানা রাইন, আবদুল জব্বার হাওলাদার ও কবিরুল বাশার। ২০১৬ সালে ‘ডাইভার্সিটি অ্যান্ড অ্যাবানডেন্স অব স্পাইডার ফনা অ্যাট ডিফারেন্ট হ্যাবিটেটস অব জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণাটি ‘জার্নাল অব এন্টোমলোজি অ্যান্ড জুওলজি স্টাডিজ’ জার্নালে প্রকাশিত হয় (ভলিউম-৪ এবং সংখ্যা-৫)। ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের ভেতর তারা জাবি ক্যাম্পাস থেকে ১১ পরিবারের ৪৯ গণের ১১৬ প্রজাতির মাকড়সা খুঁজে পান। ক্রাইসিল্লা লাউটাও নামের একটি মাকড়সাকে বাংলাদেশে প্রথম সনাক্ত করা হয় এই সমীক্ষায়। 

পাখির জন্য জাবি খুব গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুসংস্থান। জাবির পাখিবৈচিত্র্য নিয়ে এক গবেষণায় প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের দিলীপ কে দাশ, মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ ও সাজেদা বেগম জানান, দ্রুত নগরায়নের ফলে পাখি ও বন্যপ্রাণীর বাসস্থান বিপদাপন্ন। ‘ডাইভার্সিটি অ্যান্ড পপুলেশন ডেনসিটি অব বার্ডস অ্যাট দ্য জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০২০ সালে ‘বাংলাদেশ জার্নাল জুওলজিতে’ প্রকাশিত হয় (ভলিউম-৪৮ এবং সংখ্যা-২)। ২০০৮ সালের মার্চ থেকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির ভেতর করা গবেষণাটি জাবিতে ১০১ প্রজাতির পাখি সনাক্ত করেছে। গবেষণাটি আমাদের বিপদের বার্তা দেয়। কারণ গবেষকগণ দেখতে পান দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে জাবিতে পাখিদের আবাসস্থল এবং পাখিধারণ ক্ষমতার স্থান হ্রাস পাচ্ছে। 

নিশ্চিতভাবে জাবির প্রতিটি বিভাগ ও অনুষদের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ আছে। এসব গবেষণা ও বিশ্লেষণ কী জাবির চলমান উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে সমর্থন করে? পরিবেশগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে? জাবির কোনো বিভাগ কী এভাবে গাছ কেটে বিল্ডিং বানানোর সপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ হাজির করে? যদি এসব প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হয়, তবে এই উন্নয়ন-দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা কেন সজোরে সদলে গাছ-পাখি-পতঙ্গদের হয়ে প্রতিবাদ করছি না? 

জাবি থিনীড হবে না

থিনীডভিল শহরের কোথাও কোনো জীবিত গাছ নেই। সব প্লাস্টিক, সব মেশিনে চলে। মাঝেমাঝে ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে আবার নতুন ব্যাটারি ভরে গাছকে চাঙ্গা করতে হয়। ও’হেয়ার নামের একটি কোম্পানি মূলত: থিনীড শহরটি চালায়। যেহেতু শহরে কোনো গাছ নেই, তাহ মানুষকে অক্সিজেন কিনে খেতে হয়। ও-হেয়ার কোম্পানিটিই বোতলে ভরে অক্সিজেন বিক্রি করে। শহরের এ অবস্থা মূলত তৈরি হয়েছে ওয়ান্স-লার নামের এক গাছ হত্যাকারী লোকের জন্য। ওয়ান্স-লার নামের এক লোক সব গাছ কেটে থিনীড শহর বানানোর পরিকল্পনা করে। বনদেবতা লোরাক্স তাকে থামাতে বহু চেষ্টা করে। বনের পশুপাখিরা গাছেদের প্রাণভিক্ষা চায়। কিন্তু ওয়ান্স-লার সেসব কানে নেয় না। উন্মত্ত হয়ে ওঠে, শেষ জীবিত গাছটিও কেটে ফেলে। তৈরি হয় গাছবিহীন এক নতুন শহুর থিনীডভিল। ততদিনে ওয়ান্স-লার থেকে শহরের মালিকানা দখল করে ও-হেয়ার ও তার পোষা মাস্তানবাহিনি। থিনীড শহরের এক ছোট্ট ছেলে টেড উইগিনস ও ছোট্ট মেয়ে অদ্রি আর শহরের অতিষ্ঠ জনতাই শেষমেষ ও’হেয়ারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং সবাই মিলে থিনীডে আবারো ফিরিয়ে আনে সত্যিকারের গাছ। উপরের এ কাহিনিটি সত্যি নয়। ২০১২ সনে ইউনিভার্সাল স্টুডিও থেকে নির্মিত ‘দ্য লোরাক্স’ নামের একটি কার্টুন অ্যানিমেশন সিনেমার গল্প। ড. সিউ্যসের কাহিনি থেকে ক্রিস রিনাউড এটি নির্মাণ করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি জাবি কর্তৃপক্ষ গাছ কেটে পরিবেশ বিনাশ করে এক অনিন্দ্য সুন্দর ক্যাম্পাসকে থিনীডে পরিণত করবেন না। 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পরিবেশ গণহত্যা করে কেউ টিকেনি। বনের হাতি ধরে বাণিজ্য করার বিরুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন হাজং মনা সর্দার। খর্জুর বৃক্ষ বাঁচাতে রাজার তলোয়ারে জীবন দেন অমৃতা দেবী। জুমপাহাড় রক্ষায় জীবনবাজি রাখেন অবিনাশ মুড়া। শালবন রক্ষায় শহীদ হয়েছিলেন পীরেন স্নাাল। আগ্রাসী গাছের বিরুদ্ধে লড়াই করে জেলজুলুম খাটেন অজিত রিছিল। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বাঁশঝাড় ও আগ্রাসী একাশিয়া বাগানের নিচে কী ধরণের উদ্ভিদবৈচিত্র্য আছে তার এক তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ আমরা করেছিলাম। একাশিয়ার নিচে তেমন কিছু ছিল না, কিন্তু বাঁশঝাড়ের বৈচিত্র্য ছিল বিস্ময়কর। জাবিতে একাশিয়া রোপণের কোনো দরকার ছিল না। বরং এটি পরাগরেণুজনিত এলার্জি থেকে শুরু করে খাদ্যশৃঙ্খলে নানা বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। যদিও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক ব্যাংকদের চাপেই এমন আগ্রাসী প্রজাতির আমদানি ঘটে দেশে। অথচ জাবির শালবন বাস্তুতন্ত্রের নিজের এক অর্ন্তগত শক্তি আছে। মানুষ হিসেবে এটি বারবার আমরা ভুলে যাই। আর একটার পর একটা ভুল করতে থাকি। মাটি, পানি, বৃক্ষ, মাছ, পতঙ্গ, কী পাখিরা কিন্তু সব মনে রাখে। মানুষের সদয় ও নির্দয় সব ব্যবহার। কেবল মানুষ নয়; প্রাণজগৎও বিরক্ত হয়, অভিমান করে। জাবির গাছেরা যদি আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অভিমান করে, তবে কী এই বিদ্যায়তন জীবন্ত থাকবে? মাননীয় উপাচার্য নিশ্চিতভাবে এসব জানবেন না, কারণ আমাদের জানিয়ে গাছেরা অভিমান করবে না।