একটা দেশ গঠিত হয় বিভিন্ন গ্রুপের সহাবস্থানে। প্রত্যেক গ্রুপের নিজেদের পছন্দের এবং অপছন্দের বই আছে। প্রতিটা গ্রুপ ইচ্ছে করলে দলবেঁধে তাদের অপছন্দের বই যারা প্রকাশ করে তাদের স্টলগুলো গুঁড়িয়ে দিতে পারে। ফল হবে, মেলায় আর কোনো স্টল দাঁড়ানো থাকবে না।
Published : 23 Feb 2025, 06:15 PM
বইমেলা এখন জমজমাট। প্রতিদিন বেশ লোকজন আসছেন। আর আসছে নতুন বইও। ফাল্গুনের আগমনে বসন্ত বাতাসের ছোঁয়ায়, বইমেলার পরিবেশ যতটা আনন্দঘন হয়ে উঠতে পারত, তা হয়নি।
ছয় বছর পর দেশে ফিরে, কয়েকদিন বইমেলায় গিয়ে এমনটাই দেখে-শুনে এসেছি। যারা দেশে থাকেন, বইমেলা শুরু হলে নিয়মিত মেলায় যান, এমন কারো কারো সঙ্গে আলাপে মনে হয়েছে, আমার কাছে যতটা মনে হয়েছে, এবারের মেলাটায় তার চেয়ে বেশি ছন্দপতনের ঘটনা ঘটেছে।
ছন্দপতনের ঘটনাগুলো মেলা শুরুর আগে থেকেই হচ্ছে, স্টল বরাদ্দ নিয়ে। অন্যপ্রকাশ, আগামী প্রকাশনীসহ অনেকদিন ধরে বইমেলাকে জমিয়ে রেখেছে, এমন অনেক প্রকাশনাকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে গড়িমসি করা হচ্ছিল।অন্যপ্রকাশের কথা বিশেষ করে বলার কারণ, ওদের স্টল বরাদ্দ নিয়ে টানাটানি ঘটনাটি আমার একটু ভালো করে জানা আছে। কারণ এই প্রকাশনা সংস্থাটি থেকেই এবার আমার একটি গল্পের বই ‘বেচু সরদারের ট্রুথ কমিশন’ প্রকাশ হয়েছে। শুরুতে অন্যপ্রকাশকে প্যাভিলিয়ন দেয়া হলেও আকারটি ছোট করে দেওয়া হয়েছিল।পরে অবশ্য প্রমাণ সাইজের প্যাভিলিয়নই দেওয়া হয়েছে।
আরও কয়েকজন স্বনামধন্য প্রকাশক, যারা প্যাভিলিয়ন পেতেন প্রতিবছর, তাদেরকে বরাদ্দ করা হলো স্টল। প্যাভিলিয়নের পরিবর্তে স্টল বরাদ্দের কারণ হিসেবে দেওয়া হলো ‘দোসর’ ট্যাগ। এই ট্যাগিংয়ের রাজনীতিটা বাংলাদেশে বেশ পুরোনো।তবে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছায় এবং গণ-অভ্যুত্থানের পর তা আবার ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। উদার-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী কেউ স্বৈরাচারে পরিণত হওয়া আওয়ামী সরকারের এক-আধটু সমালোচনা করলেই সেই সময় ‘জামাত-শিবির’ বলে ট্যাগিং করা হতো। জুলাই অভ্যুত্থানের অর্ধবার্ষিক হতে না হতেই নতুন ট্যাগ আবিষ্কৃত হলো ‘স্বৈরাচারের দোসর’। বইমেলায়ও দেখা গেল প্রকাশকদের কাউকে কাউকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে প্রাপ্য পরিসর অর্থাৎ যার প্যাভিলিয়ন পাওয়ার কথা তাকে দেওয়া হয়েছে স্টল। দেনদরবারের পর প্যাভিলিয়ন পেলেও পাননি কাঙ্ক্ষিত পরিসর। ফলে পার্ল পাবলিকেশন্সের মতো দুয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা মেলা বর্জন করেছে।
মেলা বর্জনের, এমন কী মেলায় স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার সংস্কৃতিও নতুন নয় বলে জানতে পারলাম। বিগত বইমেলাতেই স্টল বরাদ্দ পায়নি আদর্শ বলে একটি প্রকাশনী সংস্থা– যে প্রকাশনাটি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধীদের বই প্রকাশ করেছিল সাহস করে। এবার দেখা গেল তসলিমা নাসরিনের কবিতার বই বের করায় ‘সব্যসাচী’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার স্টল বন্ধ করে দেওয়া হলো। ‘উজান’ নামে অন্য একটি প্রকাশনা সংস্থা ভয়ে স্টল বন্ধ রেখেছে। উজান থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত সোহেল হাসান গালিবের একটি কবিতার বই নিয়ে ব্যাপক নিন্দামন্দ করা হচ্ছে। কবিকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। সরকারি কলেজের শিক্ষক এই কবির চাকরি-বাকরি নিয়েও টানাটানি শুরু হয়েছে।
আমি তো প্রবাস থেকে গিয়েছিলাম বইমেলা দেখতে। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক খবর পত্রিকায় পড়তে পড়তে আমি মাঝে মাঝে খুব হতাশ হতাম। বইমেলায় গিয়ে অনেক নেতিবাচকতা দেখার পরেও বাঙালি মনের অনন্ত আনন্দপ্রবাহ দেখে দারুণ উজ্জীবিত হয়েছি। উদ্দীপনার মধ্যেই কাটিয়ে এসেছি কয়েকটা দিন।
যে কয়দিন ঢাকায় ছিলাম, প্রায় প্রতিদিনই মেলায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি।বইমেলায় সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে ছুটির দিনগুলোতে। মূল মেলা হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও বেশ কিছু স্টল আছে।
যারা বলছেন আমাদের ছেলে-মেয়েরা বই-পুস্তক, লেখা-পড়া ছেড়ে দিয়েছে তাদেরকে ভুল প্রমাণ করে তরুণ-তরুণীরা বই কিনছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গল্প-উপন্যাসসহ সব ধরনের বই। বই কিনছেন চাকরিজীবী এবং গৃহবধূরাও। শিশুচত্বরেও ছোটরা মা-বাবাকে নিয়ে দেখছে তাদের পছেন্দের বই।
যারা বলছেন বাংলাদেশিরা হাসতে ভুলে গিয়েছে, আনন্দ করা ছেড়ে দিয়েছে তারাও সম্ভবত ভুল বলছেন। মাথায় ফুলের ব্যান্ড লাগিয়ে গলায় ফুলের মালা দুলিয়ে তরুণীরা খিল খিল করে হাসছে সর্বত্রই। তরুণরা ব্যস্ত সঙ্গিনীর ছবি তুলতে। যারা একা, তারা তুলছেন সেলফি, হয়তো মনে মনে ভাবছেন– বই খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যেতে পারেন একজন ভালো বন্ধু।
আমাদের ধর্মীয় নেতারা যারা বলছেন, দেশের লোক ধর্ম-কর্ম ভুলে গেছে, শুধু পড়ছে গল্প-উপন্যাস, তারাও সম্ভবত ভুল বলছেন। কারণ অনেক অনেক মানুষ বইমেলায় ধর্মীয় বই দেখছেন এবং কিনছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন অল্প বয়সীরাও।
যার যেমন পছন্দ বই কিনছে, এই স্বাধীনতা যেন কখনো হারিয়ে না যায়। একটা দেশ গঠিত হয় বিভিন্ন গ্রুপের সহাবস্থানে। প্রত্যেক গ্রুপের নিজেদের পছন্দের এবং অপছন্দের বই আছে। প্রতিটা গ্রুপ ইচ্ছে করলে দলবেঁধে তাদের অপছন্দের বই যারা প্রকাশ করে তাদের স্টলগুলো গুঁড়িয়ে দিতে পারে। ফল হবে, মেলায় আর কোনো স্টল দাঁড়ানো থাকবে না। আবার আমরা সহিষ্ণুতা দেখিয়ে নিজের পছন্দের ও অন্যদের পছন্দের বইগুলোকে মুক্তভাবে সবার সামনে তুলে ধরতে সহায়তা করতে পারি। তাতে নিজেদের পছন্দের বই বাড়বে আর বাড়বে অন্যদের পছন্দের বইগুলোও। এতে বই পড়ুয়াদের আনন্দ বাধাহীনভাবে ছড়াবে এবং দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
আনন্দের আরেক উপাদান খাওয়া-দাওয়া। হরেকরকম ঐতিহ্যবাহী খাবার বিক্রয় হচ্ছে মেলার পুর্বদিকের খাবারের দোকানগুলোতে।তবে এবারের মেলায় পিঠার বৈচিত্র্য সীমিত।আমাদের দেশে পিঠার কদর কি কমে যাচ্ছে? বইমেলায় অংশগ্রহণকারীদের আরেকটা আনন্দ চোখে পড়ল, সারি সারি তরুণ-তরুণী লেকটার চারপাশের কঙ্করের বেঞ্চিগুলোতে বসে আছে। কেউ সশব্দে গল্প করছে, কেউ নিশ্চুপ আকাশের দিকে চেয়ে আছে, কারোর দৃষ্টি পাশে বসা প্রিয়জনের প্রতি আর কেউবা দৃষ্টি মেলে দেখে দূরের হেঁটে যাওয়া কাউকে।কিন্তু লেকটার নোংরা পানি ও ময়লা জঞ্জাল পরিবেশের সঙ্গে খুবই দৃষ্টিকুটু। আর সুজলা সুফলা বাংলাদেশে যেখানে মানুষ ছাদে ও বারান্দায় ফুল গাছ লাগাচ্ছে, সেখানে এতবড় একটা লেকের পাশে কোনো গাছ-গাছড়া, বিশেষ করে ফুল গাছ নেই, সেটা দৃষ্টিকটু ঠেকছে। অবিলম্বে লেকটাকে ঘিরে সুন্দর সবুজ প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছি।
এবার বইতেই ফিরে যাই। বইমেলা এইবার মনে হচ্ছে দারুণ ‘জিয়াময়’। অনেকগুলো স্টলে প্রেসিডেন্ট জিয়া, বেগম জিয়া ও তারেক জিয়াকে নিয়ে বই বিক্রি হচ্ছে। একটা স্টল করা হয়েছে জিয়াউর রহমানের বগুড়ার বাগবাড়ির নাম প্লেটে লাগিয়ে। রাজনৈতিক বইয়ের তুখোড় লেখক মহিউদ্দিন আহমদও বেগম জিয়াকে নিয়ে বড় একটা নতুন বই লিখেছেন, ‘খালেদা’, যা প্রকাশ করেছে অনন্যা।
আহমদ ছফার বইগুলো এখনো বেশ জনপ্রিয় । ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেকগুলো স্টলে বিক্রি হচ্ছে।হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর পরেও বইমেলায় আধিপত্য ধরে রেখেছেন। যদিও এবারের বইমেলাটা জুলাই বিপ্লবের নামে, তবে জুলাই বিপ্লব নিয়ে খুব বেশি বই মেলায় চোখে পড়েনি। হয়তো আরো আসবে। প্রথমা কিছু বই প্রকাশ করেছে জুলাই বিপ্লব নিয়ে, খুব তাড়াহুড়ো ধরনের বই মনে হলো, এর মধ্যে রয়েছে আসিফ নজরুলের বইও। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) ‘৩৬শে জুলাই’ নামে ৫০৫ পাতার একটি বইয়ে জুলাই অভ্যুথানের সময় দেয়ালে আঁকা লেখা, গ্রাফিতি ও কার্টুনের সংগ্রহ, ঝকঝকে সুন্দর প্রকাশনা, সংগহে রাখার মতো বই।
গত কয়বছর বাংলা একাডেমির স্টলটা থাকত জমজমাট। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বই বা তাদের সম্বন্ধে রচিত বই নিয়ে বড় বড় রথী-মহারথীরা ভিড় জমাতেন, ছবি তুলতেন।মেলার দর্শনার্থীরাও থাকতেন দারুণ উৎসুক। এইসব এখন নিভে গেছে। আমি বাংলা একাডেমি স্টলে জিজ্ঞেস করলাম, শেখ মুজিবের আত্মজীবনী ও চীন সফরের ওপর লেখা বইটা কেনা যাবে কিনা। বাংলা একাডেমির স্টলের এক কর্মী জবাব দিলেন, ‘না, ওগুলো এখন ক্লোজড।’ ভেবে পেলাম না কেন বন্ধ করা হলো! কাছের একটা দোকানে পাওয়া যাচ্ছে হিটলারের ‘মাইন ক্যাম্ফ' এবং আইয়ুব খানের ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার’।
মেলায় ক্রেতাদের মূল ভিড় জনপ্রিয় লেখকদের উপন্যাসকে ঘিরে। অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে উপচেপড়া ভিড়– ক্রেতারা চোখ বন্ধ করে কিনছে হালআমলের জনপ্রিয় তরুণ লেখক সাদাত হোসাইনের। এই স্টলে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে এখনও জনপ্রিয়তার শীর্ষেই আছে কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমদের উপন্যাসগুলো। অন্বেষা ও অনন্যা– এই দুই প্রকাশনীও এই দুই লেখকের বেশ কিছু বই প্রকাশ করেছে। মাওলা ব্রাদার্স আমাদের দেশের একটা বনেদি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। তাদের স্টলে দেখলাম, মুহাম্মদ ইউনূসের আত্মজীবনীমূলক বই ‘গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন’।
কিছু কিছু বই যেন ঠিক বই হয়ে উঠেনি, কিন্তু পাঠকদের চেয়েও দর্শকরা বেশি আনন্দ পাচ্ছেন। টিপু সুলতান প্রকাশ করেছেন বড়দের-ছোটদের সাহায্যমূলক বই, চটি চটি বই, সুন্দর ছাপা।একটা বইতে দেখলাম ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। জিজ্ঞেস করলাম, ডিকশনারি কিভাবে এত ছোট হয়? টিপু সুলতান বেশ বিরক্ত হলেন, বললেন এটা ডিকশনারি নয়, শব্দের অর্থের নিচে টীকা আছে শব্দটা কিভাবে মনে রাখা যায়।
নেই প্যাভিলিয়ন, নেই স্টলের নাম-ধাম, তবুও বইমেলায়
মেলার ঘেরাওয়ের বাইরেও বই মেলা আছে, মেলার টিএসসির গেটে স্ট্রিট ফুডের গাড়িগুলোর মাঝে মতিন মিয়ার বইয়ের ভ্রাম্যমাণ দোকান, বেশির ভাগ বই ৪০ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি হচ্ছে, এরপরও দরাদরি করা যায়। অনেক সিরিয়াস এবং পুরোনো দিনের জনপ্রিয় বইও আছে মতিন মিয়ার দোকানে। বিমল মিত্রের 'কড়ি দিয়ে কিনলাম', বিভূতিভূষণের ‘উপন্যাস সমগ্র’সহ আরো অনেক বই খুব কম কড়িতে কেনা যায়।
আমি অনেকবার বইমেলায় একাকী ঘুরেছি। একদিন ছুটির দিনে মেলায় গেলাম দুই পুরানো বন্ধুকে নিয়ে, তারা আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। বাসারাত আলী, রোমে জাতিসংঘে কাজ শেষে দেশের টানে ঢাকায় ফিরে নতুন করে বাড়ি বেঁধেছেন। অন্যজন আবদুল লতিফ, ভালো লেখক, এইবার বইমেলায় বের হয়েছে তার দুইটো নন-ফিকশন বই– ‘চেতনায় নজরুল’ ও ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ’।আমরা তিনজন মনের আনন্দে অনেকক্ষণ ঘুরলাম, যদিও মেলার উচ্চশব্দের সঙ্গে কান মিলানো ও তরুণদের ভিড়ে পা মিলানো আমাদের জন্য খুব সহজ ছিল না। বলা বাহুল্য, মেলায় প্রবীণদের উপস্থিতি খুবই কম। এক সামাজিক মাধ্যমে লতিফ লিখেছে, ‘অবর্ণনীয় ভিড়ের মধ্যে দেখলাম উৎসবের আমেজ। এই ভিড়ে আমরা একটু অসহায় বোধ করলেও, কম বয়েসী যারা আনন্দ করছে, তাদের দেখে ভালো লাগলো।’
ভালো লাগল অনেক দিন পর বই মেলা ঘুরে এসে। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ১৯৬৭ সালে, তখন ছিল এক অন্য ধরণের বই মেলা– ঠিক মেলা নয়, ফেব্রুয়ারির মাসে ৪০ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি হতো বাংলা একাডেমির বই। আমরা বিকেলে বর্ধমান হাউসের পেছনের জানালাটা দিয়ে লাইন ধরে দাঁড়াতাম, হয়তো ১০ থেকে ১৫ জন লোক। তখন বাংলা একাডেমির বইয়ের সম্ভার ছিল খুব সীমিত– প্লেটো, সক্রেটিসের বইয়ের বাংলা অনুবাদ, গ্রিক মিথলজির ওপর বই, সরদার ফজলুল করিমের দর্শনের বই, নজরুলকে নিয়ে লেখা কিছু বই। এর থেকে বাছাই করে আমাদেরকে কিনতে হতো। তারপর স্বাধীনতার পর বিছনা-চাদর পেতে ‘মুক্তধারা’র চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গেণে শুরু করেন অনানুষ্ঠানিক বইমেলা। স্মরণ করছি এই গুণী লোকটাকে, যিনি বইয়ের প্রকাশনা শুরু করেছিলেন নোয়াখালীর চৌমুহনীর ‘পুথিঘর’ দিয়ে। তার প্রকাশিত ‘এন এক্সপার্ট হেডমাস্টার’ রচিত সহায়ক পুস্তকগুলো ছিল পঞ্চাশের ও ষাটের দশকের স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। তখন কোচিং সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। যাদের সাহায্যের প্রয়োজন হতো, তাদের জন্য চিত্তরঞ্জন সাহার প্রকাশিত এন এক্সপার্ট হেডমাস্টারের বইগুলোই ছিল ভরসা। বোধ হয় মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশেও বহুদিন পুথিঘরের সহায়ক বই ছিল শিক্ষার্থীদের বড় ভরসা। বাংলা বইয়ের প্রকাশনা ক্ষেত্রে তার উদ্ভাবনী অবদান বাংলাদেশের পাঠকেরা প্রতিটা বইমেলায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তবে তার ‘মুক্তধারা’র স্টলটা এখন কেমন নিষ্প্রভ। এবারের বইমেলায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মারকগ্রন্থ’টাও তারা পুনর্মুদ্রণ করতে পারেনি বা করেনি। একটা ব্যানারে চিত্তরঞ্জন সাহার ছবিই স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তধারার পুরানো ঐতিহ্যকে।
বইমেলা শুধু একমাসের নয়। আমাদের মনে যখন মেলা মেলা বই আনন্দ যোগাবে; মার্চ থেকে জানুয়ারি মাসেও যখন আমরা বই কিনব, বই পড়ব এবং বই নিয়ে কথা বলব তখনই একুশের বইমেলা পূর্ণতা পাবে।