Published : 05 Jun 2024, 04:42 PM
গাছ আর দীঘির নগরী রাজশাহী। সর্বগ্রাসী উন্নয়নে দীঘিগুলো খুন হলেও রাজশাহী শহরে এখনো বহু গাছ আছে। আছে সবুজ বলয়। তপ্ত, খরাপীড়িত এই বরেন্দ্রনগরে এখনো সড়কগুলোতে গাছেরা ছায়া দেয়। পাখি আর প্রজাপতি ওড়াওড়ি করে। নগরীর ভদ্রা মোড় থেকে রেলস্টেশন যাওয়ার রাস্তাটি যেন তপ্ত মরুতে একটুকরো বরফ। এমন ছায়াময় শীতল সড়ক দেশের খুব কম শহরেই আছে। সড়কের একধারে রেশম উন্নয়ন্ন বোর্ডের তুঁতের সবুজ বাগানও এই মায়াময় শীতলতা তৈরিতে অবদান রাখছে। যেকোনো সড়কের চেয়ে এই রাস্তায় ঢুকলেই আন্দাজ করা যায় নগরপরিকল্পনায় গাছ কত জরুরি।
শহরের তাপ কমাতে গাছ ও সবুজবলয়গুলো বাঁচিয়ে রাখা দরকার। কেবল বক্তৃতাবাজি বা মুখের কথা নয়, সড়কে নানা ঋতুতে নানা ফুলের বর্ণবিভা ছড়িয়ে রাজশাহী কিছুটা হলেও দেখিয়েছে সড়ক সাজাতে গাছের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু একইসাথে আমরা উদ্বিগ্ন আর ক্ষুব্ধ হই, যখন দেখি এই সবুজদরদী রাজশাহী আজ ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’ নির্মাণের নামে নগরীর সোনাদীঘি নামে সুপ্রাচীন এলাকার শতবর্ষী গাছেদের উপড়াতে উদ্যত হয়েছে। এই প্রাচীন নগরীতে এতদিনেও একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়নি এটি হতাশাব্যঞ্জক। একইসাথে আমাদের প্রাণের শহীদ মিনার নির্মাণের নামে আজ যদি গাছ কাটা পড়ে সেটি আরও বেশি যন্ত্রণা ও ক্ষত তৈরি করবে। গাছ ও সবুজবলয় বিনষ্ট না করে আমরা শহীদ মিনার চাই। একইসাথে সোনাদীঘির সুপ্রাচীন গন্ধ, বরেন্দ্র অঞ্চলের স্থাপত্যশৈলী এবং রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে ধারণ করে পরিবেশবান্ধব নকশার শহীদ মিনার চত্বর চাই।
সোনাদীঘি এলাকায় যারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছেন তাদেরকে এসব বিবেচনায় রাখতে হবে। দমাদম গাছ কেটে, সবুজবলয় বিনষ্ট করে, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল কংক্রিট আর ইট-পাথরের স্থাপনা ভাষা আন্দোলনের মর্যাদাকে বিপন্ন করে। ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র মানুষের মাতৃভাষা সুরক্ষার দাবি জানায় না। গাছ, পাখি, পতঙ্গ আর বুনোপ্রাণের ভাষা সুরক্ষার প্রশ্নও ভাষা আন্দোলনের চেতনা। মনে রাখতে হবে, ২০২৪ সনে দেশের এক সুপ্রাচীন বিভাগীয় শহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মিত হচ্ছে। নিশ্চিতভাবে এই নির্মাণশৈলী পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং জনবান্ধব হতে হবে। এর নকশাকার, শিল্পী, স্থপতি, প্রকৌশলী, পরিকল্পক, ব্যবস্থাপক এবং বাস্তবায়নকারীদেরকে পরিবেশবিনাশী কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে রুগ্ন এই পৃথিবীর সামনে এক বার্তাবহ শহীদ মিনার উপহার দিতে হবে। কাজটি সহজ হতে পারে যদি বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজশাহী জেলা পরিষদ সকল নাগরিক অংশীজনদের গর্বিত এই শহীদ মিনার নির্মাণ পরিকল্পনার অংশ করে। জেলা পরিষদ শিল্পী, স্থপতি, নকশাকার, ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মী,পরিবেশকর্মী, শিক্ষার্থী, গবেষক, শিক্ষক, রাজনৈতিক, সমাজকর্মী, নগরপরিকল্পনাবিদ, উন্নয়নবিদসহ সকল শ্রেণি-পেশা-বয়স-লিঙ্গের নাগরিকদের কাছ থেকে মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে।
অংশীজনের বহুমুখী অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে রাজশাহী জেলা পরিষদ এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির এক উদাহরণ তৈরি করুক। এভাবে এই স্থাপনা ও চত্বর নাগরিকদের কাছে আরও বেশি আপন জনপরিসর হয়ে উঠবে। গাছদের বাঁচিয়ে এই শহীদ মিনার নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার নতুন বার্তা দেবে।
সরেজমিন সোনাদীঘি
মে মাসের তপ্ত দাবদাহের ভেতর সরেজমিন সোনাদীঘি এলাকায় নির্মিতব্য কেন্দ্রীয় শহীর মিনার অঞ্চলে গিয়ে বিমর্ষ ও ক্ষুব্ধ হই। ঐতিহাসিক সোনাদীঘি আর দীঘি নেই। নানাভাবে জবরদখলের মাধ্যমে একে মেরে ফেলা হয়েছে। শীর্ণ, মুমূর্ষু একটুকরো দীঘির শরীর ঘিরে কংক্রিটের দমবন্ধ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এককালের টলটলা পানির সোনাদীঘির তলায় এখন ময়লা দুর্গন্ধের তরল। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণস্থলটি এখনো চারধারের কংক্রিট স্থাপনার ভেতর একমাত্র সবুজবলয়। জাম, নিম, বট, কদম, কড়ই, সেগুন, নারিকেল, আমসহ বেশ কিছু গাছ আছে। অনেক গাছেই পাখির বাসা আছে। একটি গাছের খোঁড়লে পাখির বাসায় চারটি ডিম। মা পাখিটি গাছের ডালে ওড়াওড়ি করছিল। এছাড়া ঘাস, ঝোপ, কিছু বুনো শাক ও ভেষজ লতাগুল্মও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানাদিকে। গাছগুলোর শরীরের বাকল তুলে কালি দিয়ে নম্বর দেয়া হয়েছে। গাছ কাটার আগে এভাবেই বিনাঅপরাধে গাছেদের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
চত্বরে বসে সদাহাস্য জনাকয়েক আড্ডা দিচ্ছিলেন। আড্ডায় আলাপ হয় রাজশাহীর নাগরিক আন্দোলনের নেতা এবং পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের সভাপতি মাহবুব টুংকুর সাথে। গাছ রক্ষা করে শহীদ মিনার নির্মাণের আন্দোলনকে সমন্বয় করছেন। পরিবেশকর্মী মাহবুব জামান তপন, থিয়েটারকর্মী ইকবাল আলীম, চাকুরীজীবী হুমায়ুন কবীর ও সাফিরুল হুদা, চিত্রশিল্পী এস এম আদিল, ক্রীড়াবিদ সরকার কবীরউদ্দীন, ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেনসহ বহুজনের সাথে আলাপ হয়। এরা সবাই শৈশব ও কৈশোরের বন্ধু। জানালেন, সোনাদীঘি মাঠের গাছের ছায়ায় খেলাধুলা করেই তারা বড় হয়েছেন। এই দীঘি তাদের শৈশবের সাঁতারের স্বাক্ষী। তারা সকলেই একটা সুন্দর শহীদ মিনার চান, কিন্তু স্মৃতিময় গাছেদের জীবনের বিনিময়ে নয়। গাছ ও সবুজবলয় রেখে শহীদ মিনার নির্মাণের জোরালো আওয়াজ তাদের। মানববন্ধন, সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ, স্মারকলিপি পেশের মাধ্যমে গাছ বাঁচিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের আন্দোলন চলছে।
সোনাদীঘির ইতিহাস
খুব প্রাচীন না হলেও রাজশাহী বিশেষ শহর। কাজী মোহাম্মদ মিছের, কালীনাথ চৌধুরী, এবনে গোলাম সামাদ, আনারুল হক আনা কিংবা মাহবুব সিদ্দিকী রাজশাহী নিয়ে বই লিখেছেন। বইগুলোতে রাজশাহী শহরের দীঘি ও গাছেদের কথা আছে। পদ্মা, স্বরমঙ্গলা, জামদহ, বারাহী, আত্রাই নদীবাহিত পলিতে গড়ে উঠেছে রাজশাহী শহর। বিলসিমলা, সাপারা, বগামারী, ভুগরইল, গাইডহরাবিল এখন বিলীন। রাজশাহীর বিজয়নগরের দেওপাড়াতে ১৮৬৫ সনে ব্রিটিশ কর্মকর্তা মেটকাফ প্রাচীন এক শিলালিপি উদ্ধার করেন। জানা যায়, ঐতিহাসিক পদুমশাহরসহ বহু দীঘি খনন করেন রাজা বিজয় সেন। নদী গবেষক হিসেবে পরিচিত ইতিহাসবিদ মাহবুব সিদ্দিকীর ‘বাংলাদেশের বিলুপ্ত দীঘি, পুষ্করিণী জলাশয়’ বইটি ২০২০ সনে প্রকাশ করে বিশ্বসাহিত্য ভবন। বইটিতে রাজশাহীর বিলুপ্ত দীঘিদের বিবরণ আছে।
‘মহারাণী’ হেমন্ত কুমারী দেবী ১২৭৬ বাংলায় মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিয়ে করেন পুঠিয়ার মহারাণী শরৎসুন্দরী দেবীর পুত্র যতীন্দ্র নারায়ণকে। বিয়ের তিন বছর পর স্বামী মারা যান। মাত্র ১৮ বছর বয়সে পুঠিয়া জমিদারীর দায়িত্ব নেন হেমন্ত কুমারী। অনলাইন মুক্তবিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া জানায়, জনকল্যাণকর কাজের জন্য তাকে ‘মহারাণী’ খেতাব দেয়া হয়। রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাস, সংস্কৃত কলেজ, দাতব্য চিকিৎসালয়, ডাকঘর, অনাথ আশ্রম ও স্নানঘাট নির্মাণ সহযোগিতার পাশাপাশি টলটলা পানির সোনাদীঘিও তার অবদান। রাজশাহী শহরে জীবন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন হয়ে এখনো টিকে আছে বিশেষ স্থাপনার কিছু ঢপকল। সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে মহারানী হেমন্তকুমারী রাজশাহীজুড়ে প্রচুর ঢপকল স্থাপন করেন এবং আর দীঘি খনন করেন। সোনাদীঘিকে তিনি কেবল পানীয় জলের জন্য সুরক্ষিত করেছিলেন।
সোনাদীঘির আশেপাশের বহু প্রবীণজনের সাথে আলাপে জানা যায়, মালোপাড়া, রাজারহাতা, কুমারপাড়া, রানীবাজার, সব্জীপাড়া, গণকপাড়া মহল্লার মানুষ নিয়মিত এই দীঘি থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতেন। দীঘির চারধার ঘিরে ছিল প্রাচীন পাম গাছের সারি। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলের চেয়ার ও কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছিল। ষাটের দশকে সোনাদীঘিতে উৎসবমুখর বাৎসরিক সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। গোসল, কাপড় ধোয়াসহ বহুবিধ কাজ শুরু হয়নি তখনো দীঘিতে। মুক্তিযুদ্ধের আগেও এই দীঘির পানি অনেকেই ব্যবহার করেছেন। স্বাধীন দেশে নিদারুণভাবে পরাধীন হতে থাকে এই দীঘি। নানাভাবে এই দীঘি দখল ও দূষিত হতে থাকে। সোনাদীঘির পাশে দুটি বড় মাঠ ও সবুজবলয় ছিল। একটি মাঠে নিয়মিত হাডুডুসহ নানা খেলা আয়োজিত হতো। অন্যপাশের সবুজবলয়টিতে বহু প্রাচীন গাছ ছিল। শতবর্ষী বট, নিম, কদম, কড়ই ছিল।
১৯২১ সালে মূলত পানীয় জলের সংকট দূর করতেই খনন হয় সোনাদীঘি। সোনাদীঘির সাথে পদ্মা নদীর সংযোগ ছিল, বর্ষায় নতুন পানি প্রবেশ করত দীঘিতে। সোনাদীঘি ঘিরে গড়ে উঠেছিল উন্মুক্ত বিনোদন চত্বর ও সবুজবলয়।
সোনাদীঘির পাড়ে ১৮৯৮ সালে তৈরি হয়েছিল সুপ্রাচীন রাজশাহী সরকারি সার্ভে ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এই চত্বরে রোপণ করা হয় বহু গাছ। পরে ২০১৮ সালে সোনাদীঘিকে ঘিরে নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি সরিয়ে নেয়া হয়। আর এখানেই রাজশাহী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণকাজ চলছে। এ কাজের জন্য চারধারের সকল গাছ কেটে ফেলার অপতৎপরতা চলছে। সোনাদীঘির পাড়ে হঠাৎ এক বহুতল ভবন পুরো এলাকার বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশে এক দৃশ্যযন্ত্রণা তৈরি করেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের শৈলী ও দৃশ্যরূপের ক্ষেত্রে চারধারের বহুতল দালানগুলি নকশাকারের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বহুতল দালানে ঘেরা ছাড়া একটা মুক্ত শহীদ মিনারের ছবি হয়তো আমরা পাব না। এই দৃশ্যযন্ত্রণা আরও বেশি বাড়বে যদি এখানকার টিকে থাকা শেষ গাছগুলোও কেটে ফেলা হয়।
২০২০ সনে গণমাধ্যমে ‘নতুন রূপ পাচ্ছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সোনাদীঘি’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় খবরের কাগজে। সংবাদটিতে সোনাদীঘি ঘিরে একটি নকশা পরিকল্পনাও প্রকাশিত হয়। নকশাটিতে দেখা যায় এক ছোট্ট সোনাদীঘির চারপাশ জুড়ে বহুতল ভবন এবং কংক্রিটের সব স্থাপনা। এমনকি দীঘির পানিতেও কংক্রিটের স্থাপনা। ১৯৮০-৮১ সন থেকে সোনাদীঘির চারধারে স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয় এবং কংক্রিটের কারাগারে বন্দী হয় ঐতিহাসিক এই চত্বর। ২০০৯ সনে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘এনা প্রপার্টিজের’ সাথে ১৬ তলা বিশিষ্ট ‘সিটি সেন্টার’ নির্মাণের মাধ্যমে সোনাদীঘি ঘিরে নতুন উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করে সিটি করপোরেশন। ২০১৩ সনের পর এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কাজ বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে আবার ২০১৮ থেকে নতুন উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, সোনাদীঘির সোন্দর্যবর্ধনের জন্য সিটি করপোরেশন এখানে রাতের বেলা আলোকায়ন করতে চায়। কিন্তু সোনাদীঘির মতো সবুজবলয়ে এমন আলোকায়ন পাখি ও পতঙ্গের জন্য আলোকদূষণ তৈরি করবে। ২০২৩ সনের ২৯ নভেম্বর পুন:নির্মিত সোনাদীঘি জামে মসজিদ উদ্ধোধন করেন রাসিক মেয়র।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রকল্পে কী আছে?
সরেজমিনে সোনাদীঘি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সাদাজমিনে লালরঙে হাতে লেখা একটা পরিবেশসম্মত সাইনবোর্ড। লেখা আছে, ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এর জন্য নির্ধারিত স্থান’। যদিও সাইনবোর্ডটির কোণা ঢেকে ফেলেছে এক রাজনৈতিক নেতার প্লাস্টিকের ব্যানার। পাশেই টানানো হয়েছে পরিবেশবিনাশী প্লাস্টিকের ব্যানারে শহীদ মিনার প্রকল্পের সরকারি বিবরণ। হলুদের ভেতর কালো কালিতে প্রিন্ট দেয়া এই বিবরণ থেকে নির্মিতব্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের একটা সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়।
রাজশাহী জেলা পরিষদের দেয়া এই পাবলিক বিবরণ থেকে জানা যায়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় হলো স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটি ২০২৩ সনের ১০ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনুমোদনের স্মারক নং-৪৬.৪২.৮১০০.০০০.০৫২.১৫.১৮৮৪। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজশাহী জেলা পরিষদ এবং পরিষদের রাজস্ব তহবিল থেকে এর অর্থায়ন হচ্ছে। নাটোরের মীম ইঞ্জিনিয়ারিং ডেভলপমেন্ট লিমিটেড এই প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে সাত কোটি আশি লাখ ষোল হাজার পাঁচশত আশি টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদকাল ২০২৫ সনের ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত।
সোনাদীঘি রক্ষা আন্দোলন
সোনাদীঘি রক্ষায় রাজশাহীর নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। পরিবেশকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী ও পেশাজীবীদের পাশাপাশি এই আন্দোলনে নানা সময়ে জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদরা সংহতি জানিয়েছেন। সোনাদীঘির পাড়ে যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় এমএ বিএলের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য ছিল। ভাস্কর্যের সাথে একটি পাথরের শিলালিপিতে একটি ঘটনার বিবরণ আছে। ‘পদ্মাগর্ভে নিমজ্জমান নারীদ্বয়ের বিপন্ন অবস্থা দর্শনে তাহাদের প্রাণরক্ষার নিমিত্ত তদন্তে আত্মপ্রাণ তুচ্ছ করিয়া পদ্মাবক্ষে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন এবং তাহাদের উদ্ধার সাধন করিয়া স্বয়ং পদ্মাগর্ভে নিমজ্জিত ও অন্তর্হিত হইয়া অনন্তের ক্রোড়ে আশ্রয় লাভ করিয়াছেন’।
শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১২৯৫ বাংলার ১৬ বৈশাখ তার জন্ম। পদ্মানদীতে দু-জন ডুবে যাওয়া নারীকে উদ্ধার করে নিজে মারা যান ১৩২৩ বাংলার ১২ পৌষ। ২০১২ সনে বহুতল ভবন নির্মাণের সময় সোনাদীঘির পাড় থেকে এই ঐতিহাসিক ভাস্কর্যটি সরানো হয়। এই ভাস্কর্য সরানোর বিরুদ্ধে রাজশাহীবাসী তখন আন্দোলন করেন। নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যের প্রাণ বাঁচানোর এই ঘটনা রাজশাহীবাসীর কাছে এক বিরল গর্বের উদাহরণ। সোনাদীঘিসহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ পরিকল্পনায় আমরা আশা করব এই ভাস্কর্যকে আবার যথাযথ মর্যাদায় সোনাদীঘি চত্বরে স্থাপন করা হবে।
২০১৭ সালে একাধিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এনা প্রপার্টিজ সিটি সেন্টার নির্মাণ করতে গিয়ে দীঘির পশ্চিমপাড়ের অংশ কৌশলে দখল করে ভরাট করেছে। রাজশাহীর তৎকালীন সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এর প্রতিবাদ করেন এবং সোনাদীঘি অস্তিত্ব রক্ষায় ২০১৭ সনের ৩০ এপ্রিল নগরীতে বিশাল মানববন্ধনের নেতৃত্ব দেন। ২০১৭ সালেই সোনাদীঘি রক্ষার প্রস্তাব জানিয়ে সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে একটি পত্রিকায়। তারা লিখেছে, দখলের কবলে পড়ে সোনাদীঘি এখন মৃতপায়। ২০১৭ সনে সোনাদীঘির ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আন্দোলনে নামে ‘রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘রাজশাহী ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদ’ ও ‘রাজশাহী নাগরিক সমন্বয় কমিটি’। তারা রাজশাহীর সোনাদীঘি ও ভুবনমোহন পার্ক দখলমুক্ত করে ঐতিহ্য রক্ষা করে এসব গণপরিসর উন্নয়নে ১০ দফা দাবি জানান।
কিন্তু রাষ্ট্র সোনাদীঘির প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষা করতে তৎপর হয়নি। সোনাদীঘির জলাশয় এবং চারধারের গাছপালাসহ সবুজবলয়কে কেন্দ্রীয় মনোযোগে রেখে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়নি। বরং এর চারধারে কেবলমাত্র কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে এর প্রতিবেশগত বৈশিষ্ট্য বদলে ফেলা হচ্ছে। আমরা আশা করব রাজশাহী জেলা পরিষদ এবং রাসিক সোনাদীঘিসহ চারপাশের গাছেদের জীবন বাঁচিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করবে।