Published : 19 Jan 2013, 08:17 PM
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গর্বের মুহূর্তগুলো শুরু থেকেই তোপের মুখে পড়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদের। তারা এসব নিয়ে গল্প বানায়, গল্প লেখে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে। শুরু হয় ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেছিলেন দিয়ে, শেষ হয় আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে ওসমানী কেনো আসেননি বলে। এসব অপপ্রচারের প্রতিটির তথ্যপ্রমাণসহ দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া দলটির উত্তরসূরীরাও একইরকম বিকৃতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। কথাটা বলছি মুজিবনগর কমপ্লেক্সের আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানের একটি ভাস্কর্য প্রসঙ্গে।
দেখা যাচ্ছে মিত্রবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল জগৎসিং অরোরা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পুর্বাঞ্চল প্রধান লে. জেনারেল এ.কে নিয়াজীর সঙ্গে ওই টেবিলে তৃতীয় একজন উপস্থিত! কে এই ব্যক্তি, আমাদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তার কি ভূমিকা! সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে ঠিক ওইরকম একটা ছবির ফটোশপ ভার্সন দেখার দূর্ভাগ্য আমার হয়েছিলো এক পাকিস্তানী ফোরামে। সেখানে বলা হয়েছিলো ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পাঠানো একজন প্রতিনিধির সামনে এই আত্মসমর্পন করেছেন নিয়াজী, আত্মসমর্পনের শর্তগুলোও তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন। অথচ ইতিহাস ও তার উপাত্ত বলে ঠিক ওই জায়গায় মাটিতে হাটু গেড়ে বসেছিলেন একজন সাংবাদিক! সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কমপ্লেক্স প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রথম প্রহর মুজিব নগর। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে শপথ নেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার। যুদ্ধকালে এটাই ছিলো বাংলাদেশের রাজধানী। সেই গৌরবময় ইতিহাসকে ধরে রাখতে ১৯৯৮ সালে সেখানে মুজিব নগর কমপ্লেক্স নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। সে বছর ১৭ এপ্রিল প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৬৬ একরের বিশাল আয়তনের কমপ্লেক্সে পিকনিক স্পট, মোটেলসহ নানা পর্যটন সুবিধাদি থাকবে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনা দিয়ে তুলে ধরা হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গৌরবগাঁথা। ডেইলি সানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ছয় দফার রূপক হিসেবে সেখানে ছয়টি গোলাপ বাগানের পাশাপাশি যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মানচিত্র থাকবে সেসময়কার সেক্টরগুলোসহ। আরো থাকবে মুক্তিযুদ্ধ মিউজিয়াম এবং বিভিন্ন ভাস্কর্য যা মুক্তিযুদ্ধের একেকটি অধ্যায়ের স্মারক।
জায়গাটি নিয়ে বিতর্কের শুরু আসলে বছর তিনেক আগে। কমপ্লেক্সে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্যটি নাকি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এই অভিযোগে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। বিভিন্ন ইভেন্টের (যেমন শপথ গ্রহন, শরণার্থীর স্রোত, আত্মসমর্পন) পাশাপাশি ৪০ জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য সেখানে স্থাপন করার কথা। এর মধ্যে ২৯টি তৈরি হয়েছিলো যার একটি জিয়ার (সম্ভবত রেডিওতে ঘোষণা দিচ্ছেন ধরনের)। রেসকোর্সের সত্যিকার আত্মসমর্পনের জায়গাটা শিশুপার্ক বানিয়ে উধাও করে দিলেও তাতে তার মুক্তিযোদ্ধার তকমা যায় না। তাছাড়া শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ভাস্কর্যে যদি ইতিহাসের স্বার্থে খন্দকার মোশতাককে রাখা যায়, জিয়াতো সে তুলনায় নিস্পাপ শিশু। যাহোক, পুরো ব্যাপারটির দায়িত্বে টেরাকোটা শিল্পী গোপাল চন্দ্র সরকার এবং নির্মাণে এমএম বিল্ডার্স (যদিও তাদের ওয়েবসাইটে এটা প্রজেক্ট হিসেবে উল্লিখিত নয়) বলে লেখা হয়েছিলো ওই সম্পর্কিত ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে ।
আরো জানা গেছে বিএনপি-জামাত জোট এই প্রকল্পটি বন্ধ করেনি, চালিয়ে যেতে অনুমোদন দিয়েছে! এবং ২০০৫ সালের ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র প্রকল্পে ওই বাংলাদেশের মানচিত্রের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপিত করেন তখনকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব থাকা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক মোঃ রেজাউল করিম। মানচিত্রের আইডিয়াটুকু বিএনপি সরকারের সংযুক্তি কিনা তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
আমাদের আলোচিত ছবিটির অবস্থান ওই বাংলাদেশের মানচিত্রেই। সেখানে নানা ধরণের ঘটনার শৈল্পিক রূপ দেওয়া হয়েচ্ছে ভাস্কর্যে। কিন্তু এই নির্দিষ্ট ভাস্কর্যটি তৈরির জন্য কী উপাত্ত ব্যবহার করেছেন এর নির্মাতারা? এখানে তৃতীয় চেয়ার আসলো কোথা থেকে? ওই চেয়ারে বসা কে?
সাইড থেকে যা দেখা যাচ্ছে তাতে গোফ থাকলে না হয় রূপক অর্থে বঙ্গবন্ধূর অশরীরি উপস্থিতি মেনে নেওয়া যেত মুজিব কোট ছাড়াই। কোনো ছবি থেকে করা হয়েছে এই ভাস্কর্য? পাকিস্তানী সেই ফোরাম থেকে? কে সাপ্লাই দিলো এই ছবি? এর উত্তর জানাটা জরুরী হয়ে পড়েছে। প্রকল্পের বাহারি একটা ওয়েবসাইট আছে। সেখানে এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে সিমসান মল্লিকের নাম লেখা হয়েছে। দুটো কনটাক্ট নাম্বারের একটিও কার্যক্ষম নয় বলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলো না।
পোস্টে ১৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশিত খবরের কাটিং এবং মূল ছবিটি সংযুক্ত করা হলো যেখানে তৃতীয় চেয়ার বলে কিছু নেই; সেখানে সেই সাংবাদিকটি মাটিতে হাটুগেড়ে বসে আছেন বলে দেখা যাচ্ছে।
স্বাধীনতার ইতিহাস এবং এর বিকৃতিরোধে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের অনেক দায়। মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মতো এমন অসাধারণ উদ্যোগে যদি এমন একটি মারাত্মক ভুলকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহলে তা হবে ইতিহাস বিকৃতিকে সমর্থন করা। তীব্র নিন্দা জানিয়ে আমরা আশা করছি এ ব্যাপারে যথাযথ অনুসন্ধান হবে এবং দায়ীদের কারণ দর্শানোর পাশাপাশি শাস্তি দেওয়া হবে। যে বা যারা আমাদের ইতিহাস জানে না, তার বা তাদের কোনো যোগ্যতা নেই আমাদের ইতিহাসের স্মারক স্থাপনায় যুক্ত থাকার।
মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা : ব্লগার বেলের কাঁটা।