নূর হোসেনের আত্মদান নিয়ে গৌরব করার অবস্থা দেশে আছে কি? 

পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে, সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে, মানুষ নির্ভয়ে অবাধে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারলে নূর হোসেনকে স্মরণ করা প্রকৃতপক্ষে একটি তামাশা ছাড়া আর কিছু হয় না।

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 11 Nov 2023, 05:22 AM
Updated : 11 Nov 2023, 05:22 AM

আমাদের অনেক কিছুই এখন দিবসকেন্দ্রিক। দিবসেরও শেষ নেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দিবস আছে। কোনো কোনো দিনতো একাধিক দিবস থাকে। কোনোটা জাতীয় দিবস, কোনোটা আবার আন্তর্জাতিক দিবস। তবে আমাদের দেশে রাজনৈতিক কারণে কিছু দিবস বিশেষ গুরুত্ব পায়। রাজনৈতিকভাবে আমাদের দেশ এখন চরম বিভক্ত হওয়ায় সব দিবস আবার সব রাজনৈতিক দলের কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে না। তবে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর– এই তিনটি দিবস এখনো প্রায় দলমতের কাছেই এখনো সমান গুরুত্ববহ বলেই মনে হয়। 

১০ নভেম্বরও আমাদের দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। তবে সূচনায়  এই দিনটি যতটা ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছিল, এখন সম্ভবত ততটা উজ্জ্বল নেই। আমাদের অর্জন ও বিজয় যেমন আছে, তেমনি বিজয় হাতছাড়া হওয়ার ঘটনাও কম নয়। আমরা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করি, পাই আবার পেয়ে হারাইও। এটা বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশ হলো আন্দোলনের দেশ, প্রতিবাদের দেশ, আত্মদানের দেশ। বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আন্দোলনে বিজয় অর্জন করি। কিন্তু অর্জিত বিজয়কে আমরা সংহতও করতে পারি না, ধরেও রাখতে পারি না। আমাদের ত্রুটি কোথায়, কেন আমরা পেয়েও হারাই তা নিয়ে আমাদের গভীর কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আমরা সাধারণত কোনো কিছুর গভীরে না গিয়ে তাৎক্ষণিকতায় মেতে উঠি। 

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনের কথা মনে করেই উপরের কথাগুলো বলা হলো। প্রতি বছর ১০ নভেম্বর আমরা নূর হোসেন দিবস পালন করি। তাঁর সাহসী আত্মদানের কথা বক্তৃতায় বলি। কিন্তু নূর হোসেন যে লক্ষ্যে বুক-পিঠে স্লোগান লিখে মিছিলে নেমে শহীদ হয়েছিলেন, সেই লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবও এখন সম্ভবত এক রকম পাওয়া যাবে না। একপক্ষ বলবেন, হ্যাঁ, স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মাধ্যমে নূর হোসেনের এক দাবি ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক' পূরণ হয়েছে। অন্যরা হয়তো বলবেন, পোশাক পরা স্বৈরাচারের পতন হলেও দেশের ওপর চেপে বসেছে গণতন্ত্রের ছ্দ্মাবরণে কর্তৃত্ববাদী শাসন।

নূর হোসেনের আরেক দাবি ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক'। তো, গণতন্ত্র কি সত্যি মুক্তি পেয়েছে? এখানেও এক রকম জবাব পাওয়ার আশা করা যায় না। একপক্ষ বলবেন, দেশে এখন গণতন্ত্র পুরো মুক্ত অবস্থায় আছে। শেখ হাসিনা হলেন ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’, তিনি যেহেতু টানা তিন মেয়াদে দেশের শাসনভার পেয়েছেন, সেহেতু গণতন্ত্র অবশ্যই মুক্ত অবস্থায় আছে। 

এর বিরুদ্ধে বলা মানুষের সংখ্যা দেশে একেবারে কম নেই। আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধীরা দিবানিশি ক্লান্তিহীনভাবে বলে চলছেন, দেশে আসলে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রের মূল সৌন্দর্য হলো বহু দলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। নানা মত ও পথের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করবে। সবাই তার বিশ্বাস বা মত বিনা বাধায় প্রকাশ করবেন। ভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে দেশ শাসনের অধিকার কোন দলের। যে দল শতকরা ৫১ ভাগ ভোটারের সমর্থন সংগ্রহ করতে পারবে, দেশ শাসনের হক সেই দলের। আর যারা শতকরা ৪৯ ভাগ ভোটারের মন জয় করতে পারবে, তাদের বসতে হবে বিরোধী দলের আসনে। বিরোধী দলও আসলে সরকারের অংশ। সরকার ভুল করলে, জনবিরোধী কোনো নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তার বিরোধিতা করবে। শুধু বিরোধিতা করলেই হবে না, সরকারের ভুলটা কী বা কোথায় এবং কী করলে, কীভাবে করলে ভালো হতো, সেটাও খোলাসা করে বলতে হবে। মাঠ গরম করা বক্তৃতা নয়, জনচিত্ত জয় করার মতো কাজ করতে হবে। কিন্তু এমন আদর্শ অবস্থা কি আমাদের দেশে আছে? 

বিচারপতি সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন এরশাদ। তার ক্ষমতা দখলের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল বিরোধিতা। এরশাদ যত বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তত বছর দেশ আন্দোলনমুক্ত ছিল না। সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখলের সময় নির্বাচন দিয়ে দ্রুত ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে সেটা আর রক্ষা করে না। এরশাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে এরশাদের শাসনকালজুড়েই ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের কখনো যুগপৎ, কখনো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে আন্দোলন। এরশাদ চেষ্টা করেছেন বিরোধী দলের ঐক্যে ভাঙন ধরাতে। কিছু সফলতা পেলেও মোটাদাগে তিনি ব্যর্থই হয়েছেন। ১৯৮৬ সালের ৭ মে দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮-দলীয় জোট অংশ নিলেও বিএনপির নেতৃত্বের ৭-দলীয় জোট এবং বাম দলগুলোর ৫-দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। আবার বিএনপিঘেঁষা জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিলে ওই নির্বাচনেই এরশাদের বিদায় নিশ্চিত হতো। বিরোধী দলের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ব্যাপক ভোট ডাকাতির মাধ্যমে এরশাদের জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে জয় পায়। এরশাদ ভোটে জিতেও বিরোধী দলের বিরোধিতা থেকে রেহাই পাননি। 

নির্বাচনের এক বছরের মধ্যে আবার বিরোধী দলীয় জোটগুলো একযোগে আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশে তৈরি হয় টানটান উত্তেজনা। এরশাদ কঠোর অবস্থান নিয়েও মানুষকে ঘরে রাখতে পারেননি। পুলিশ-বিডিআর নামিয়ে, যানবাহন চলাচল বন্ধ করিয়েও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঠেকানো যায়নি। বিক্ষুব্ধ মানুষের সমাবেশ-মিছিল বন্ধ করতে গুলি বর্ষণ করতেও দ্বিধা করেনি এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া সশস্ত্র পোশাকি বাহিনী। গুলিতে নিহত হন অন্তত দুইজন। একজন নূর হোসেন, অন্যজন সৈয়দ আমিনুল হুদা। নূর হোসেন ঢাকাতেই থাকতেন। আর আমিনুল হুদা টিটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে ক্ষেতমজুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগঠিত করতে নিজ উপজেলা কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে চলে গিয়েছিলেন। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য টিটো বাজিতপুর থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে ঢাকা এসেছিলেন। কারণ বিরোধী জোটসমূহের ডাকা কর্মসূচি ব্যর্থ করতে এরশাদ সারাদেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টিটো আর তার বাড়ি ফিরে যেতে পারেননি। এমনকি তার মরদেহটিও গায়েব করেছিল এরশাদের পেটোয়া বাহিনী। 

টিটোর মৃত্যুর খবর তাৎক্ষণিকভাবে জানতে না পারায় তার ব্যাপারটি অনেকেরই গোচরে আসেনি। কিন্তু নূর হোসেনের মৃত্যু মানুষকে বেশি আবেগ তাড়িত করেছিল। ১০ নভেম্বর সমাবেশ বা মিছিলে তার উপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমীভাবে। নূর হোসেন তার বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে রাস্তায় নেমেছিলেন। পিঠে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক' আর বুকে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক'। বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে আগে আর কেউ মিছিলে নেমেছিলেন বলে জানা নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি। আবার এভাবে তিনি শত্রু পক্ষের নিশানার মধ্যে ছিলেন। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে টার্গেট করেই হয়তো গুলি ছোড়া হয়েছিল। যারা এই টার্গেট করেছিল তাদের নিশানা ব্যর্থ হয়নি। 

আওয়ামী লীগ সভাপতি  শেখ হাসিনারও নজরে পড়েছিলেন নূর হোসেন। শেখ হাসিনা একটি হুড খোলা গাড়িতে করে সমাবেশ উপস্থিত হয়েছিলেন।  গাড়িতে চড়ে জনতার মধ্য দিয়ে চলার সময় তার চোখ গিয়েছিল নূর হোসেনের গায়ে ওই লেখা স্লোগানের দিকে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল তার মন । নূর হোসেনকে কাছে ডেকে তাকে সতর্ক করেছিলেন। 'ওরা টোকাই কেন' বইতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, 'মনে পড়ে আমি তাকে বলেছিলাম, জামাটা গায়ে দাও, একি সর্বনাশ করছ, ওরা যে তোমাকে গুলি করে মারবে।' নূর হোসেন মাথাটা এগিয়ে দিল আমার কাছে। বলল, 'জান দিয়া দিমু আপা, আপনে শুধু মাথায় হাত বুলাইয়্যা দেন।' শেখ হাসিনা লিখেছেন, 'আমার হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ নূর হোসেন গাড়ির পাশে হাঁটল। তারপর কখন যেন জনতার স্রোতে হারিয়ে গেল।'

এর কিছুক্ষণ পরেই গুলির শব্দ। স্লোগান অংকিত বুক-পিঠ ঝাঁঝরা হয়েছিল মুহূর্তে। রক্তে ভেসেছিল রাজপথ। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পুলিশ তার গুলিবিদ্ধ দেহ জোর করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে অতি গোপনে জুরাইন কবরস্থানে নিয়ে তড়িঘড়ি সমাহিত করেছিল। তার মৃত্যু দেশের মানুষকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান তাকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা– ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। কবিতার শেষ কটি লাইন : “উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে/ বুকে-পিঠে রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য স্লোগান / বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ শহরে টহলদার / ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা / নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়। বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে /তার বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।” 

নূর হোসেন, টিটো, তাজুল, সেলিম-দেলোয়ারসহ অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে? না। এরশাদ পতনের পর দেশে ৬টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তি পায়নি। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত বা সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া গণতন্ত্রের আর কোনো চিহ্ন দেশ শাসনে কিংবা রাজনৈতিক দল পরিচালনায় দেখা যায় না। বিএনপি-জামায়াতকে গণতন্ত্রের মিত্র মনে করেন না অনেকেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের চ্যাম্পয়ন দাবিদার হলেও দেশে এখনো গণতান্ত্রিক শাসন শক্ত ভিত্তি পায়নি। নির্বাচনব্যবস্থা বিতর্কিত হওয়ার একক দায় হয়তো আওয়ামী লীগের নয়। তবে একেবারে দায়মুক্ত নয় কোনোভাবেই। 

প্রতি বছর এখনও নূর হোসেন দিবস পালন করা হয়, তার সাহসিকতার প্রশংসা করা হয়। কিন্তু পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে, সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে, মানুষ নির্ভয়ে অবাধে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারলে নূর হোসেনকে স্মরণ করা প্রকৃতপক্ষে একটি তামাশা ছাড়া আর কিছু হয় না। 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত থাকে বলে এক সময় যারা স্বস্তিবোধ করতেন, এখন তারাও বর্তমান সরকারের অনেক কাজকর্মে অস্বস্তিবোধ করছেন। শেখ হাসিনার সরকার দেশের অনেক উন্নতি করেছেন, অনেক কিছুতেই উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ আর শূন্য ঝুলির দেশ নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার সক্ষমতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল ইত্যাদি নতুন এক বাংলাদেশের চিত্রই তুলে ধরছে। কিন্তু এত সাফল্যের পরও মানুষের মনে কিন্তু সুখ ও স্বস্তির অভাব রেয়েছে। ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য মানুষের যে আকুতি তা যদি অপূর্ণই থাকে তাহলে নূর হোসেনের আত্মদান নিয়ে গৌরব করা যায় কি?